মেসি, আপনার জন্য বিশেষণের ঝুলিতে টান পড়ছে
আর্জেন্টাইন রূপকথার বয়স হলো চার দিন। লেখাজোখাও কম হলো না। চারপাশে বিশেষণের প্রকট অভাব। আর কীই-বা লেখা যায়? আর কীই-বা লেখা সম্ভব! সেই যে ২০০৪ সালে বার্সেলোনার জার্সিটা গায়ে চড়ালেন, লেখা হচ্ছে তখন থেকেই। লিওনেল মেসির প্রতিভা না হয় অফুরন্ত, কিন্তু ভাষা? বর্ণ, শব্দ ও বাক্য মিলিয়ে যে ভাষা, তার তো সীমাবদ্ধতা আছে। মেসির সামনে ভাষাও নুইয়ে পড়ছে।
অথচ কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, মাঠে মেসি প্রতিদিন একই কাজ করেন। বাঁ পায়ের ‘ঝরনা’য় ভাসিয়ে দেন প্রতিপক্ষকে। মেসির দল পাল্টে যায়, প্রতিপক্ষও পাল্টায়, কিন্তু এ দৃশ্য যেন চিরকালীন। বাঁ পায়ের ‘কলমে’ রোজারিওর ছেলেটি লিখে চলছেন তাঁর রূপকথার গল্প।
আর সেই গল্পকে দর্শক ও পাঠকের কাছে তুলে ধরতে ধরতে স্বয়ং সংবাদকর্মীরাই এখন বেকায়দায়। আর কত বিশেষণ ব্যবহার করা যায়! মেসির মতো জাদুকরদের কীর্তি প্রতিদিন আলাদা আঙ্গিকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরা তো সহজ কম্মো নয়। এই দেখুন, আবারও ‘জাদুকর’ শব্দটিই লিখতে হলো!
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে—‘এনিগমা’। বাংলা অর্থ প্রহেলিকা, ধাঁধা। আরও সহজ করে বললে, যে বিষয়টা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। আচ্ছা, মেসির ক্যারিয়ারও কী এমন কিছু? মানে তাঁকেও কি ‘এনিগমা’ বলা যায়?
মাইকেল অ্যাপটেড পরিচালিত ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এনিগমা’ সিনেমাটা দেখা থাকলে কিছু ধারণা পেতে পারেন। শত্রুশিবিরের ‘কোড’ ভাঙতে এলাহি কারবার! মেসিকেও কি তাই মনে হয় না? না মানে পরিকল্পনা তো আর কম হলো না! সেই ২০০৪ সাল থেকেই তো মেসিকে থামাতে নানা পদের পরিকল্পনা করে আসছে মেসির প্রতিপক্ষ দলগুলো। কিছু লাভ হলো?
১৭ বছর বয়সে যখন শুরু করেছিলেন, তখন না হয় প্রতিপক্ষ তাঁর শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে খুব কম জানত। তারপর? এত কৌশল আর মার্কিং করে কী লাভ হলো! একবার কিন্তু অনেকেই ভেবেছিলেন, এই মেসি আর যা–ই হোক সর্বকালের সেরাদের কাতারের নয়।
২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে হার, এরপর ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকা ফাইনালেও হার। অবসরই তো নিয়ে নিলেন। বলেই দিয়েছিলেন, অনেক চেষ্টা করেছি। আমার পক্ষে আর্জেন্টিনাকে সাফল্য এনে দেওয়া সম্ভব নয়।
সেই মেসি সবার অনুরোধে ফিরেও এলেন। কিন্তু সাফল্য সহসা ধরা দেয়নি। বরং রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আর্জেন্টিনার বিদায়ের পর মেসির মুখখানি দেখে মনে হয়েছে ‘মরণের পরে’ সিনেমার কোনো দৃশ্য।
তখন কে ভেবেছিল, মেসির জীবনের সেলুলয়েডের পাতার শেষটায় এত রোমাঞ্চ, এত আনন্দ! দেখে চোখ ভিজে আসে। সব ঘাটের জল খেয়ে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব মানুষটিও হয়তো বিশ্বকাপে মেসির শেষ অঙ্ক দেখে আশায় বলতে পারেন, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল!’
হ্যাঁ, ৩৫ বছর বয়সে—যখন লোকে বলে ‘চল্লিশে চালসে’ হওয়ার কাতারে চলে যাচ্ছে—মেসি জাতিকে একসূত্রে গাঁথার আলো জ্বালিয়েছেন বিশ্বকাপের জ্যোতির্বলয়ে। তার আগে ২০১০, ২০১৪ কিংবা ২০১৮—এই তিনটি বিশ্বকাপেই তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই তিন বিশ্বকাপ মিলিয়ে করেছিলেন মাত্র ৫ গোল।
কিন্তু ৩৫–এ পা রেখে যখন সবাই বুট তুলে রাখার ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে যান, মেসি সেই বয়সে এ বিশ্বকাপে করলেন ৭ গোল! করিয়েছেন আরও ৩টি। মাঠ না হয় মেসির জন্য ‘থিয়েটার’, সেখানে যেকোনো চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু ‘সহকর্মী’দের মনেও একই আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটা সবার নেই। সে জন্য ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো নেতৃত্বগুণ থাকতে হয়। প্রয়াত কিংবদন্তিই একদা বলেছিলেন, ‘মেসির কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নেই।’
কী আশ্চর্য! সেই মেসির মুখেই যখন শোনা যায়—‘ভাইয়েরা, কাকতাল বলে কিছু হয় না। তোমরা জানো, এই টুর্নামেন্ট আর্জেন্টিনায় হওয়ার কথা ছিল। সৃষ্টিকর্তার খেয়ালেই তা এখানে (ব্রাজিল) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কারণ, আমরা যেন মারাকানা থেকে ট্রফিটা জিততে পারি। আমাদের জন্য বিষয়টি আরও সুন্দর হলো। চলো, সবাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নেমে শিরোপা জিতে বাড়ি ফিরি।’
মেসি এই কথাগুলো বলেছিলেন কোপা আমেরিকা ফাইনালের আগে। তখন থেকেই কি তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের অঙ্কুরোদ্গম, যা ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে স্রেফ ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দিল! তা নয় তো কী! সেই দৃশ্যগুলো মনে করুন। ডাচ কোচ লুই ফন গালের চোখে চোখ রেখে কথা বলা, ম্যাচ শেষে মাইক্রোফোনের সামনে রাগে অগ্নিশর্মা হওয়া, যেন আরেক ম্যারাডোনা!
যেকোনো ফুটবলারই মাঠে নিজের আঁচড় রেখে যেতে চান। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে চান। আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার রদ্রিগো দি পলের বেলায় চিরন্তন এ কথাই কেন মিথ্যা হয়ে যায়? মেসির ‘দেহরক্ষী’—এই তকমা তো আতলেতিকো মাদ্রিদ মিডফিল্ডারের জন্য আপত্তিকরও হওয়ার কথা। অথচ দি পল কেন মেসির দেহরক্ষী নামেই খুশি। আবার গর্ব করেই বলেন, ‘মেসির জন্য আমি যুদ্ধে যেতেও রাজি।’
দি পল একাই কি মেসির অর্চনা করেন? না। গোটা দলটাই মেসিমুখী। লাওতারো মার্তিনেজ, আনহেল কোরেয়া, এমিলিয়ানো মার্তিনেজ...আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়দের কাছে মেসির অবস্থান যে কী, এটা স্পষ্ট হয় বিশ্বকাপ জেতানো অ্যাস্টন ভিলার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজের একটি কথায়। তাঁর মতে, ‘মেসি কথা বললে সবার চুপ করে থাকা উচিত, এমনকি তিনি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হলেও।’ মেসির গুরুত্ব এতটাই!
যে দলের বাকি খেলোয়াড়েরা শুধু একজনের জন্য জীবন দিতে চান, শুধু তাঁর জন্য বিশ্বকাপ জিততে চান, তখন মনে একটি প্রশ্ন জাগে—ফুটবল কি এর আগে এমন কিছু দেখেছে? হয়তো দেখেছে, হয়তো না।
কিন্তু দুনিয়াজুড়ে এত ফুটবলারের মধ্যেও শুধু তাঁর জন্য প্রায় দুই দশক ধরে সতীর্থ, ভক্ত ও সংবাদকর্মীদের ভাষার ঝুলিতে টান পড়ছে, চাই নতুন বিশেষণ। এই ‘এনিগমা’ ভাঙা না পর্যন্ত এটাই চলবে। কেউ আছেন, মেসি নামের ‘এনিগমা’ ভেঙে সবাইকে উদ্ধার করবেন!