বাংলাদেশ ১ (১১): ১ (১১) ভারত
দীর্ঘ প্রায় আড়াই ঘণ্টার অচলাবস্থা শেষে ঘড়িতে রাত তখন ১০টা ৪০ মিনিট। ম্যাচ শুরুর সময় ধরলে প্রায় ৫ ঘণ্টা। মঞ্চে এলেন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান। সঙ্গে সাফের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক। কী ঘোষণা দেবেন সাফ সম্পাদক, চলতে থাকে সেই আলোচনা।
সব আলোচনার অবসান ঘটিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের চূড়ান্ত ফল-বাংলাদেশ-ভারত যৌথ চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশের পুরো দলই তখন পর্যন্ত মাঠে ছিল। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের শিরোপা হারাতে হারাতে অন্তত যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সান্ত্বনা পেয়েছেন আফঈদা খন্দকারেরা। তাঁরা উল্লাস করেন কিছুক্ষণ। কিন্তু ভারতের অধিনায়ক-সহ অধিনায়ক ছাড়া অন্যরা মাঠে আসেননি। সে এক লম্বা নাটক!
সেই নাটকে ঢোকার আগে বলে রাখা ভালো, ৯০ মিনিট শেষে যোগ করা সময়ে চার মিনিটের তৃতীয় মিনিটেও বাংলাদেশ এক গোলে পিছিয়ে ছিল। মরিয়া চেষ্টায় সাগরিকার নাটকীয় গোলে ম্যাচে ফেরে স্বাগতিক বাংলাদেশ। প্রাণ ফেরে কমলাপুর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। রুদ্ধশ্বাস সেই মুহূর্তটা পেরিয়ে টাইব্রেকারে যা হলো সেটির জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না কেউই। দুই দলই নিজেদের প্রথম ১১ শটে গোল করেছে। কিন্তু এরপর হঠাৎ সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের এই ফাইনালে প্রথমে জয়ী ঘোষণা করা হলো ভারতকে!
টাইব্রেকারে ম্যাচের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়াই নিয়ম ফুটবলে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী টুর্নামেন্টের বাইলজে তাই আছে। কিন্তু এই রাতটা ব্যতিক্রম হয়ে দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার ম্যাচ কমিশনার ডি সিলভা জয়াসুরিয়া দিলান হঠাৎ টাইব্রেকার বন্ধ করে ম্যাচের রেফারিকে ডেকে টস করতে বলেন। রেফারিও দুই দলের অধিনায়ককে টস করতে ডাকেন। টসে জিতে ভারত মেতে ওঠে শিরোপা জয়ের উল্লাসে।
৮ মিনিটে করা শিবানীর গোলে এগিয়ে যাওয়া, যোগ করা সময় পর্যন্ত সেটা ধরে রেখেও টাইব্রেকারে যাওয়া, টাইব্রেকারে শুরু থেকেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থেকে চাপের মধ্যে শট নেওয়া-সেই রুদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে টসের মাধ্যমে যেন মুক্তি পেয়েছে ভারতের মেয়েরা।
কিন্তু ম্যাচ কমিশনারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ মানেনি। তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ দল। আর এতে ম্যাচে তৈরি হয় দীর্ঘ অচলাবস্থা। ফুটবল মাঠে কত বিচিত্র ঘটনাই তো ঘটে। কিন্তু এভাবে টাইব্রেকার থামিয়ে টস! বিশ্ব ফুটবলে এমন ঘটনা আর আছে কি না, তা গবেষণার বিষয়। টুর্নামেন্টের বাইলজে এমন কিছু লেখা থাকলে কোনো বিতর্কই ছিল না। কিন্তু সেটি তো নেই। তাহলে ম্যাচ কমিশনার কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত দিলেন, তা বিস্ময়কর। তবে প্রশ্ন আসে, দু দলই-বা কীভাবে টস করতে গেল!
এ সব নিয়ে ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বাফুফের ভাষ্য মতে, ম্যাচ কমিশনার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন এবং টাইব্রেকার যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আবার শুরু করতে চান। তাই ভারতকে অনুরোধ করেন ম্যাচ শুরু করতে। কিন্তু তখন বেঁকে বসে মাঠ থেকে উঠে যায় ভারত। তাদের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিয়েছেন ম্যাচ কমিশনার, সেটি আবার প্রত্যাহার কেন-এই প্রশ্ন তুলে ভারত আর খেলতে রাজি হয়নি।
৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষার পর বাংলাদেশকে জয়ী ঘোষণা ঘোষণা করা হবে, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু ৩০ মিনিট পেরিয়েও ঘোষণা আর আসে না। দুই দলকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার চেষ্টা চলে লম্বা সময় ধরে। কখন সিদ্ধান্ত আসবে, চলতে থাকে সেই অপেক্ষা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বাফুফে জানায় মাঠে ঘোষণা করা হবে সিদ্ধান্ত। আর সেই সিদ্ধান্ত হলো দুই দলকে যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা। সাফ কর্তৃপক্ষ সেই ঘোষণা দেয়।
তার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকেন মাঠে। তাঁরাও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ। টাইব্রেকারে ভারতের নেহার নবম শটটি আটকে দেন বাংলাদেশের গোলকিপার। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জয়োল্লাস শুরু। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই সেটি থেমে যায়। নেহাকে আবার শট নিতে দেন নেপালের রেফারি। কারণ, আগেবার নেহা শট নেওয়ার আগেই গোললাইন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের গোলকিপার। নেহার নেওয়া পরের শটে গোল হয়েছে। দুদলই প্রথম ১০ শটে গোল করার পর দুই গোলকিপার শট নিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বর্না যান শট নিতে এবং গোলও করেন। ভারতের গোলকিপার আনিকা দেবীও গোল করেন।
কমলাপুর স্টেডিয়ামে এর আগে সাফ বয়সভিত্তিক ফুটবলে তিনটি ফাইনাল খেলে সবকটিই জিতেছে বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিভাগে ২০২১ সালে ভারতকে হারিয়েই শিরোপা জেতে ঘরের মেয়েরা। এই মাঠে অনূর্ধব-১৫ বিভাগে জেতে ২০১৭ সালে, নেপালকে ১-০ গোলে হারিয়ে। গত বছর অনূর্ধ্ব-২০ বিভাগে ফাইনালে জেতে নেপালকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে। আজ অনেক নাটকীয়তার পর সেই জয়ের রেকর্ড ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
তবে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের সঙ্গে দলীয় বোঝাপড়া, দুটোতেই ভারতের মেয়েরাই এগিয়ে ছিল। ৮ মিনিটে তারা এগিয়ে যায়। রক্ষণ দুর্বলতায় স্বাগতিকেরা পিছিয়ে পড়ে। ভারতীয় মিডফিল্ডার নিতু লিন্ডার থ্রু বল বাংলাদেশের দুই ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলেছে, বল পান লেফট উইঙ্গার শিবানী দেবী৷ বাংলাদেশের গোলরক্ষক স্বর্ণা রানী পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে বক্সের সামনে এসেও বলের লাগান পাননি৷ শিবানীর বুদ্ধিদীপ্ত প্লেসিংয়ে বল চলে যায় জালে। বাংলাদেশ খুব ভালো সুযোগ সেভাবে তৈরি করতে পারেনি।
তারপরও শেষটা ভালোই হলো। অনেক নাটকীয়তার পর অন্তত হাসিমুখ নিয়েই আফঈদারা মাঠ ছেড়েছেন।