রোনালদোর দলের কোচ: ৫ বছরে ছাঁটাই ৮ জন, টিকে আছেন শুধু টেন হাগ
ক্লাব ফুটবল হোক কিংবা জাতীয় দল—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর প্রভাব সম্পর্কে সবার জানা। অনেকেই মনে করেন, রোনালদো শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও প্রভাব খাটান। এমনকি দলের কোচ কে হবেন, সেটাও নাকি তাঁর ইশারাতেই হয়।
গত কয়েক বছরের ইতিহাসও সে কথাই বলছে। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোনালদো যেসব দলে খেলেছেন, সেসব দলের ৮ জন কোচ চাকরি হারিয়েছেন। বরখাস্ত হওয়ার তালিকায় আছেন পর্তুগাল জাতীয় দলের সাবেক কোচ ফার্নান্দো সান্তোসও। এই ৮ কোচের কেউ কেউ ব্যর্থতার কারণে চাকরি হারিয়েছেন, এটা যেমন সত্যি, তেমনি কারও কারও ক্ষেত্রে রোনালদোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল।
সেদিক থেকে সৌভাগ্যবানই এরিক টেন হাগকে বলতে হবে। গত পাঁচ বছরে রোনালদোকে কোচিং করানো প্রধান কোচদের মধ্যে শুধু টেন হাগই চাকরি হারাননি। উল্টো রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে থাকতে টেন হাগের একাদশে একরকম ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ওঠা রোনালদো ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্লাব ও কোচকে নিয়ে বোমা ফাটিয়ে ইউনাইটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন। সেই টেন হাগ ইউনাইটেডে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
২০১৯ সাল থেকে এ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোনালদোর দলের বরখাস্ত হওয়া কোচরা হলেন মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি, মরিসিও সারি, আন্দ্রেয়া পিরলো, ওলে গুনার সুলশার, রাল্ফ রাংনিক, ফার্নান্দো সান্তোস, রুডি গার্সিয়া এবং সর্বশেষ লুইস কাস্ত্রো। প্রথম তিনজন ছিলেন জুভেন্টাসের, চতুর্থ ও পঞ্চম জন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের, শেষ দুজন আল নাসরের আর ষষ্ঠজন পর্তুগাল জাতীয় দলের।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন রোনালদো। সেই সময় ইতালিয়ান ক্লাবটির কোচ ছিলেন আলেগ্রি। ২০১৮-১৯ মৌসুমে দলকে সিরি ‘আ’ ট্রফি (স্কুদেত্তো নামে পরিচিত) জেতানোর পরও চাকরি হারাতে হয় তাঁকে।
আলেগ্রির জায়গায় জুভেন্টাসের কোচ হয়ে আসেন সারি। তাঁর অধীনও ২০১৯-২০ মৌসুমে সিরি ‘আ’ ধরে রাখে তুরিনের বুড়িরা। কিন্তু অন্য প্রতিযোগিতাগুলোয় দল ভালো করতে না পারায় সারির ওপরও ছাঁটাইয়ের খড়্গ নেমে আসে।
জুভেন্টাসে এরপর রোনালদোদের কোচের দায়িত্ব পান ইতালিয়ান কিংবদন্তি পিরলো। তাঁর কোচিংয়ে দলটি কোপা ইতালিয়া ও ইতালিয়ান সুপার কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এর চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় ৯ মৌসুম পর লিগ শিরোপা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া। পরিণাম—পিরলোর বিদায়।
২০২১ গ্রীষ্মকালীন দলবদলের একদম শেষ ভাগে সবাইকে চমকে দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফেরেন রোনালদো। কিন্তু ইংলিশ ক্লাবটিতে তাঁর দ্বিতীয় অধ্যায় মোটেও সুখকর হয়নি। সে বছরের ২১ নভেম্বর ওলে গুনার সুলশার ছাঁটাই হওয়ার পর রেড ডেভিলদের কোচ হন ‘গেগেনপ্রেসিংয়ে গডফাদার’খ্যাত রাল্ফ রাংনিক। জার্মান এই কোচ রোনালদো ও তাঁর সতীর্থদের সামনে ‘কড়া হেডমাস্টার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে রাংনিকের কোচিংয়ে খুব বেশি সাফল্য পায়নি ইউনাইটেড। দলটি তাঁর সময়ে ২৯ ম্যাচ খেলে জিততে পারে মাত্র ১১টি। তাই দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসের মধ্যে তাঁকে বিদায় নিতে হয়।
রাংনিক বিদায় নেওয়ার পর ইউনাইটেডের কোচ করে আনা হয় এরিক টেন হাগকে। এই ডাচ কোচের সঙ্গে শুরু থেকেই রোনালদোর দূরত্ব সবার সামনে আসে। নানা কারণে পর্তুগিজ তারকাকে শাস্তিও দেন টেন হাগ। একপর্যায়ে তাঁকে একাদশের বাইরেও রাখতে শুরু করেন।
এতে টেন হাগের ওপর ক্ষোভ জন্মে রোনালদোর। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটান ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ শুরুর কদিন আগে সাংবাদিক পিয়ার্স মরগানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। ওই সাক্ষাৎকারে ইউনাইটেডেরও অনেক সমালোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন।
টেন হাগের ইউনাইটেডের মতো কাতার বিশ্বকাপে ফার্নান্দো সান্তোসের শুরুর একাদশে উপেক্ষিত হয়ে পড়েন রোনালদো। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে মাত্র ১ গোল পাওয়ায় দলের অধিনায়ক হওয়ার পরও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে তাঁকে বসিয়ে রাখেন পর্তুগাল কোচ সান্তোস। পর্তুগালকে ২০১৬ ইউরো ও ২০১৯ নেশনস লিগের শিরোপা জেতানো সান্তোস রোনালদোর জায়গায় সুযোগ দেন তরুণ গনসালো রামোসকে। তাঁর হ্যাটট্রিকে সুইসদের ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে পর্তুগিজরা। তাই মরক্কোর বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালেও রোনালদোকে বসিয়ে রাখেন সান্তোস।
কিন্তু এবার তাঁর কৌশল কাজে লাগেনি। বদলি হিসেবে নামা রোনালদোও কিছু করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত মরক্কোর কাছে হেরে ছিটকে পড়তে হয় পর্তুগালকে। ওই দিন সান্তোসকে বরখাস্ত করে পর্তুগিজ ফুটবল ফেডারেশন (এফপিএফ)।
এর পরের গল্পটা তো সবার জানা। কাতার বিশ্বকাপ শেষে সবাইকে অবাক করে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে নাম লেখান রোনালদো। সেই সময় ক্লাবটির কোচ ছিলেন রুডি গার্সিয়া। কিন্তু রোনালদো আল নাসরে যোগ দেওয়ার চার মাসের মধ্যে চাকরি চলে যায় গার্সিয়ার। রোনালদোর সঙ্গে ফরাসি এই কোচের মনোমালিন্য তৈরি হওয়াতেই ছাঁটাই হতে হয় বলে গুঞ্জন ছিল।
গার্সিয়ার পর আল নাসরের কোচ হন রোনালদোর স্বদেশি লুইস কাস্ত্রো। গত পাঁচ বছরে রোনালদো যত কোচের অধীন খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে কাস্ত্রোর কোচিংয়েই সবচেয়ে সফল ছিলেন। তাঁর সময়ে ৪৮ ম্যাচে ৪৭টি গোল ও ১৬টি গোলে সহায়তা করেন রোনালদো।
কিন্তু সৌদি প্রো লিগের নতুন মৌসুমে প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র একটি জয় এবং এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম ম্যাচে ইরাকি ক্লাব আল শোর্তার সঙ্গে ড্রয়ের পর কাস্ত্রোকে ছাঁটাই করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি আল নাসর।
বর্তমানে আল নাসরে কোচ এসি মিলানকে সিরি ‘আ’ জেতানো স্তেফানো পিওলি। গত শনিবার আল ইত্তিফাককে ৩-০ গোলে হারিয়ে পিওলির আল নাসর-অভিষেক রাঙিয়ে রেখেছেন তাঁর শিষ্যরা। গোল পেয়েছেন রোনালদোও।
আল নাসরের সঙ্গে রোনালদোর চুক্তির মেয়াদ ফুরাবে আগামী বছরের ৩০ জুন। তবে পিওলির সঙ্গে চুক্তিটা আরও দীর্ঘ—২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। রোনালদো দলে থাকা অবস্থায় পিওলি কত দিন চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেন, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।