পেলে-গারিঞ্চা গেছেন, জিকো-সক্রেটিসরা এসেছেন। জিকো-সক্রেটিসদের পথ ধরে তাঁদের পরে এসেছেন রোমারিও-রোনালদো-রিভালদোরা। ‘থ্রি আর’ বিদায় নিতে না নিতেই ব্রাজিলের ফুটবলে আরেকটি প্রজন্মের আবির্ভাব হয়েছে। সেই প্রজন্ম কাকা-রোনালদিনিওদের। এরপর নেইমার এসেছেন। যদিও পূর্বসূরিদের মতো সুন্দর ফুটবলের শতদল হয়ে পূর্ণ বিকশিত রূপটা তিনি সেভাবে দেখাতে পারেননি ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি গায়ে, তবু পরম্পরাটা তো ধরে রেখেছিলেন!
কিন্তু এরপর? বিস্ময়বালক হয়ে অনেকেরই আবির্ভাব হয়েছে, ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগোরা সে দলেরই। কিন্তু ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ পেলে, জিকো, রোনালদো, রোনালদিনিও বা নেইমার হওয়ার সুবাস ছড়িয়ে আবির্ভূত হলেও সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন কই এঁরা! বরং একের পর এক ব্যর্থতায় নতুন পেলে বা নতুন রোনালদো কিংবা নতুন রোনালদিনিও অথবা নতুন নেইমার নামটাকেই যেন হাস্যকর করে তুলছেন তাঁরা।
একেকটা বিশ্বকাপ আসে, একেকটা কোপা আমেরিকা আসে; ব্রাজিলের ফুটবলকে হতাশার চাদর জড়িয়ে ধরে। ২০০২ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল, এর পর থেকে বিশ্বকাপ ব্রাজিলের জন্য শুধুই হতাশার গল্প রচনা করেছে। হতাশার গল্প শুধু শিরোপা না জেতায় নয়, ব্রাজিলের চিরায়ত সুন্দর ফুটবলই যে উধাও তাদের খেলা থেকে!
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়ার পর ব্রাজিলের ফুটবলের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ই বয়ে গেছে। বিশ্বকাপের পর প্রায় দুই বছর কোনো স্থায়ী কোচই ছিল না তাদের। বিদেশি, নাকি দেশি কোচ—দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই বিতর্ক শেষে এ বছরের জানুয়ারিতে স্থায়ী কোচ হিসেবে নিয়োগ পান দরিভাল জুনিয়র। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ঘোষণা দেন—ব্রাজিল দলটাকে নতুন করে সাজাবেন।
দরিভালের হাত ধরে নতুন পথচলার শুরুতেই হোঁচট খায় ব্রাজিল চোটের কাছে নেইমারকে হারিয়ে। সেটা অবশ্য দরিভালের জন্য ভালোই হয়েছিল। নেইমারের অনুপস্থিতিতে তিনি পেয়ে যান ব্রাজিলের ফুটবলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তারকাদের বাজিয়ে দেখার সুযোগ। এবারের কোপা আমেরিকাটা সেদিক থেকে দরিভালের জন্য ছিল বড় এক পরীক্ষার মঞ্চ। সেই পরীক্ষায় ব্যর্থ দরিভাল, ব্যর্থ ব্রাজিল। ব্যর্থ তাদের ফুটবলের বর্তমান ভিনিসিয়ুস জুনিয়র-রদ্রিগো আর ভবিষ্যৎ এনদ্রিক!
সুন্দর ফুটবল দূরে থাক, আজ উরুগুয়ের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে সময়ের চাহিদাও মেটাতে পারেননি রদ্রিগো-এনদ্রিকরা। নিষেধাজ্ঞার কারণে ভিনিসিয়ুস খেলতে পারেননি এই ম্যাচে। দরিভাল তাই প্রথমবারের মতো শুরুর একাদশে খেলান এনদ্রিককে। কিন্তু ব্রাজিলের ভক্ত-সমর্থকদের যারপরনাই হতাশ করেছেন রিয়াল মাদ্রিদগামী উঠতি তারকা। শুধু এনদ্রিকই নন, এ ম্যাচে ভুলে যাওয়ার মতো ফুটবল খেলেছে পুরো ব্রাজিল দলই।
রাফিনিয়া, রদ্রিগো, এনদ্রিক...নামগুলো তো খুব একটা মন্দ নয়। সময়ের তারকা ফুটবলারদের তালিকা করতে গেলে এ নামগুলো থাকেই। তাহলে কিসের অভাব এই ব্রাজিল দলে? কেন তারা সুন্দর ফুটবলের ফুল ফোটাতে পারছে না মাঠের সবুজে!
প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভারতের ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম নাম প্রয়াত রশিদ খানের একটা কথা খুব মনে পড়ছে। এক আড্ডায় এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো, খেলাটা সংগীতের মতোই ধ্রুপদি একটি বিষয়। সে তুমি ক্রিকেট বা ফুটবল, যে খেলার কথাই বলো। রেশমি সুন্দর একটা কাভার ড্রাইভ বা অনিন্দ্যসুন্দর ড্রিবল—এগুলো তো মালকোশ, পিলু, বৈরভী বা কলাবতী রাগের মতোই মসৃণ ও সুন্দর।’
ব্রাজিলের ফুটবলে এখন আসলে বড় অভাবটাই হচ্ছে এই ‘ধ্রুপদি’র। সবাই তো আর রশিদ খান, বড়ে গোলাম আলী বা ভীমসেন যোশি নন যে ধ্রুপদি সংগীতের সুরে মোহিত করে তুলবেন বিশ্বকে! তেমনি সবাই তো আর পেলে, গারিঞ্চা, রোনালদো বা রোনালদিনিও কিংবা নেইমার নন যে জাদুকরি পায়ের ছন্দে মাঠের সবুজে আঁকবেন আলপনা, হৃদয়ে দেবেন দোলা! আসলেই ব্রাজিলের ফুটবলে গারিঞ্চা, সক্রেটিস বা রোনালদিনিওর মতো একজন ধ্রুপদি প্লেমেকারের বড় অভাব।
ব্রাজিলের এই দলের মাঝমাঠের দিকেই তাকান—কে খেলছেন সেখানে? লুকাস পাকেতা আর ব্রুনো গিমারেস। কোথায় গারিঞ্চা-সক্রেটিস বা রোনালদিনিও আর কোথায় পাকেতা-গিমারেস! ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গেয়ে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলীকে জীবন্ত রেখেছিলেন রশিদ খান। কিন্তু এই গান যদি আবার কেউ কর্কশ কণ্ঠে গেয়ে শোনান! বড়ে গোলাম আলী আর রশিদ খানের না থাকার শূন্যতাটা আরও বাড়বে।
ব্রাজিলের ফুটবলের আসল রোগটাও এমনই। পেলে-গারিঞ্চার শূন্যতা পূরণ করেছিলেন জিকো-সক্রেটিস, জিকো-সক্রেটিসকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন রোমারিও-রোনালদো, রোনালদো-রোমারিওকে ফুটবলপ্রেমীরা দেখেছেন কাকা-রোনালদিনিও-নেইমারদের আয়নায়। কিন্তু এরপর যাঁরা আসছেন, তাঁরা শূন্যতা পূরণ করতে তো পারছেনই না, বরং বাড়াচ্ছেন।
রশিদ খানের সেই আড্ডার আরেকটা কথাও না বললেই নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো, শিল্পে তোমার শুধু প্রতিভা থাকলেই চলবে না, তোমাকে ভালো একজন ওস্তাদ ধরতে হবে—সে তুমি ছবিই আঁকো আর গানই করো বা খেলার জগতেই বিচরণ করো।’ এবার ব্রাজিল দলের এদিকটায়ও একবার তাকান—জিকো-সক্রেটিসদের যে দলটাকে বলা হয় বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা, সেই দলটার ‘ওস্তাদ’ কে ছিলেন? টেলে সান্তানা। যাঁর কাছে ফুটবলের প্রথম এবং শেষ কথাই ছিল সুন্দর ফুটবল। তা সেই কোচের প্রতিভাবান শিষ্যরা সুন্দর ফুটবল না খেলে কোথায় যাবেন!
আর এই ব্রাজিল দলের কোচ দরিভাল জুনিয়র। তিনি কতটা ভালো বা কতটা মন্দ, কতটা সুন্দর ফুটবলের পূজারি বা কতটা ফলনির্ভর যান্ত্রিক ফুটবলের উপাসক—এটা প্রমাণ করা বা বলার সময় হয়তো এখনো আসেনি। কিন্তু নিজের প্রথম বড় পরীক্ষায় তিনি ‘ফেল’। উরুগুয়ের বিপক্ষে আজ তিনি দলকে যে দর্শনে খেলিয়েছেন, সেটা কখনোই ব্রাজিলের ফুটবলের ভাবনার সঙ্গে যায় না। তুমি ভাই পাঁবচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, উরুগুয়ের মতো একটা দল তো তোমার আক্রমণের মুখে দেয়াল তুলে রেখেই পার পেতে চাইবে। এই দেয়াল ভাঙতে তুমি কতটা দক্ষতা দেখাতে পারলে, সেটাই দেখতে চাইবে পৃথিবী।
কিন্তু উরুগুয়ের বাস থামিয়ে রাখা ফুটবলের জবাবে দরিভাল তাঁর দলকে খেলালেন অনেক নিচে নামিয়ে। অপেক্ষায় থাকলেন বল কেড়ে নেওয়ার লোভে উরুগুয়ে ওপরে উঠে এলে প্রতি–আক্রমণে বাজিমাত করবেন। কিন্তু বারো মণ ঘি–ও পোড়েনি, রাধাও আর নাচেনি! বারো মণ ঘি পুড়বে কী করে, যোগ করা সময় মিলিয়ে ২০ মিনিট উরুগুয়ে খেলল ১০ জনের দল নিয়ে। এমন অবস্থায় যেখানে উরুগুয়ের সময় নষ্ট করার জন্য নানা বাহানা করার কথা, সেখানে ব্রাজিলের দু-একজন খেলোয়াড়কে দেখা গেল মাঠে অহেতুক গড়াগড়ি দিতে!
এটা দেখে কোপা আমেরিকা শুরুর আগে রোনালদিনিওর একটি কথা মনে পড়ে গেল। ‘এই দলে সবকিছুরই অভাব আছে। দৃঢ়তার অভাব, মনের আনন্দে খেলার অভাব, নিবেদনের অভাব। এবারের কোপা আমেরিকায় আমি ব্রাজিলের খেলাই দেখব না’—কোনো এক প্রচারণায় এমনটাই বলেছিলেন রোনালদিনিও।
কে জানে, উরুগুয়ের বিপক্ষে আজ ব্রাজিলের খেলা দেখেছিলেন কি না রোনালদিনিও। দেখে থাকলে বেচারা ভীষণ কষ্টই পেয়েছেন! শুধু তো আর দৃঢ়তা, মনের আনন্দে খেলা এবং নিবেদনের অভাবই নয়, ব্রাজিলের এই দলে যে একজন ধ্রুপদি প্লেমেকার আর একজন সুন্দর ফুটবলের পূজারি কোচেরও অভাব!