এমবাপ্পে+ম্যানচেস্টার সিটি=ভালোবাসার গল্প
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ম্যাচের তখন ৭৮ মিনিট। গুটি গুটি পায়ে মাঠ ছাড়ছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। টাচলাইনের ওপাশে তাঁর বদলি হয়ে নামার অপেক্ষায় ব্রাহিম দিয়াজ। তখনই ম্যাচের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটি পেলেন এমবাপ্পে। যে পুরস্কারের লোভ থাকে রিয়ালের সবার, আরেকটু গভীরে তাকালে বলতে হয়, পৃথিবীর সব ফুটবলারই এমন একটা মুহূর্তের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। স্ট্যান্ডিং ওভেশন! মানে, বার্নাব্যুর দর্শক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখালেন এমবাপ্পেকে।
বার্নাব্যুর দর্শকদের আসন থেকে তোলা, তাঁদের সম্মান আদায় করে নেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। যেমনটা নয় ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের দর্শকদের কাছ থেকেও একই সম্মান আদায় করে নেওয়া। মনকে ভরিয়ে দেওয়া ফুটবল না খেললে যেমনটা আসলে কোনো ক্লাবের দর্শকদের কাছ থেকেই আদায় করে নেওয়া সম্ভব না। পরিসংখ্যান ঠিক এই জায়গাতেই রিয়ালের কয়েক ‘ভদ্রলোক’কে মিলিয়েছে একই মোহনায়।
চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউটে রিয়ালের হয়ে ‘হ্যাটট্রিকম্যান’দের সবাই মাঠের দর্শকদের কাছ থেকে এই সম্মানটুকু পেয়েছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে রোনালদো নাজারিও; ভলফসবুর্গ, বায়ার্ন মিউনিখ ও আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো; চেলসি ও পিএসজির বিপক্ষে করিম বেনজেমা এবং কাল রাতে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে এমবাপ্পে। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের হয়ে তাঁর প্রথম হ্যাটট্রিক।
এমবাপ্পে মাঠের এক প্রান্তে যখন ইতিহাস গড়ছিলেন, তখন সেই গড়ার তোড়ে অন্য প্রান্তে ভাঙনের খেলা চলছিল। ম্যাচ শেষে সিটি কোচ পেপ গার্দিওলার কথায় সেই ইঙ্গিত, ‘কিছুই চিরস্থায়ী নয়।’
পার্থক্যটা অন্য জায়গায়। আগের হ্যাটট্রিকগুলোর কোনোটাই যুগসন্ধিক্ষণের নয়, যে সময়টি এখন চলছে সিটিতে। ইংল্যান্ড ও ইউরোপ দাপিয়ে বেড়ানো সিটির রাজত্বের অবসান ঘটানোর সিলমোহর এমবাপ্পের এই হ্যাটট্রিক। রিয়ালে এমবাপ্পে কেন এসেছেন, তার উত্তরও ৬১ মিনিটের মধ্যে ফরাসি তারকার করা গোল তিনটি। এমন সব ম্যাচের জন্যই তো তাঁকে নিয়ে আসা রিয়ালের, আর এমবাপ্পের কাজ হলো এই ম্যাচগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করে বিশ্বসেরার মুকুট পরে রিয়ালের ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা নেওয়া।
বার্নাব্যুতে শেষ বাঁশি বাজার পর ঠিক এ কথাটাই বলেছেন এমবাপ্পে, ‘আমি রিয়াল মাদ্রিদে ইতিহাস গড়তে চাই।’
এমবাপ্পে মাঠের এক প্রান্তে যখন ইতিহাস গড়ছিলেন, তখন সেই গড়ার তোড়ে অন্য প্রান্তে ভাঙনের খেলা চলছিল। ম্যাচ শেষে সিটি কোচ পেপ গার্দিওলার কথায় সেই ইঙ্গিত, ‘কিছুই চিরস্থায়ী নয়।’ অর্থাৎ, কালও যে রাজত্ব টিকে ছিল, আজ তা নাও থাকতে পারে।
অনেকটাই নদীর ভাঙা-গড়ার মতোই। চ্যাম্পিয়নস লিগ নামের সুগভীর এই নদীতে এমবাপ্পে যখন এক পাড় গড়ছিলেন, তখন সেই গড়ার তোড়ে গার্দিওলার পাড় ভেঙে খানখান। ভাঙা-গড়ার এই খেলায় যে পাড় টিকে থাকে সে-ই তো ‘সিকান্দার’—এমবাপ্পে টাচলাইনের ওপাশে যাওয়ার পর তাঁকে স্বয়ং গার্দিওলার বুকে টেনে নেওয়াটা সেই অনুচ্চারিত স্বীকৃতিও।
স্বীকৃতির প্রসঙ্গে উঠে আসে আরও অনেক কথা। এই এমবাপ্পেই রিয়ালে যোগ দিয়ে নিজের প্রথম ১১ ম্যাচে মাত্র ৩ গোল করায় কত কথা শুনেছেন! ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ হবে—এমনও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু মৌসুমের এই পর্যায়ে এসে ৩৮ ম্যাচে তাঁর ২৮ গোলের পরিসংখ্যান প্রমাণ করে রিয়াল মৌসুমের পর মৌসুম তাঁর অপেক্ষায় থেকে মোটেও ভুল করেনি। পাকা জহুরি যেমন রত্ন চেনে, তেমনি সেই রত্নও জানে আলোর বিপরীতে ঠিক কোন সময়ে নিজের ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে দিতে হয়।
ইউরোপসেরার প্রতিযোগিতায় গত কয়েক মৌসুম ধরে রিয়াল-সিটিই সবচেয়ে বড় ম্যাচ। এবার প্লে–অফে দুই লেগ মিলিয়ে সিটির ৬-৩ গোলের হারে ৪ গোলই এমবাপ্পের। বার্নাব্যুর দর্শকেরা তাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে বাধ্য।
মোহাবিষ্টের মতো আসন ছেড়ে সেই উঠে দাঁড়ানোর পেছনে কি নস্টালজিয়াও আছে?
ফিরতি লেগে এমবাপ্পের গোল তিনটি একবার স্মরণ করা যাক। রাউল আসেনসিওর আন্তমহাদেশীয় দূরত্বের নিখুঁত পাসকে প্রথম স্পর্শে আলতো লবে সিটি গোলকিপার এদেরসনের মাথার ওপর দিয়ে জালে পাঠিয়েছেন। এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে তুলে নিয়েছেন হ্যাটট্রিক। তারপর আঙুল দিয়ে তিনটি গোল বুঝিয়ে উদ্যাপনে স্মরণ করেছেন লিওনেল মেসিকে। ২০১১ সালে মায়োর্কার বিপক্ষে ওভাবেই গোল উদ্যাপন করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।
তবে স্যান্ডউইচের মতো এ দুটি গোলের মাঝে দ্বিতীয় গোলটিই সবচেয়ে সুন্দর। বলতে পারেন, রিয়ালের আক্রমণভাগকে যদি একটি ‘বর্শা’ ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সেটার একদম পূর্ণমাত্রার ব্যবহারে তুলে নেওয়া গোল!
ফেদে ভালভের্দে, রদ্রিগো, জুড বেলিংহাম, ভিনিসিয়ুস ও এমবাপ্পে—এঁরাই তো রিয়ালের মূল আক্রমণভাগ? ৩৩ মিনিটের গোলে কী দেখা গেল? মাঠের ডান প্রান্তে রদ্রিগো থেকে ভালভের্দে, তাঁর কাছ থেকে বল বেলিংহামের পায়ে, সেখান থেকে পেলেন ভিনিসিয়ুস, ক্রস করলেন ততক্ষণে বাঁ প্রান্তে চলে যাওয়া রদ্রিগোকে। ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার সিটির খুশানভকে ‘নাটমেগ’ করে ফিনিশিংয়ের জন্য বলটা এগিয়ে দিলেন এমবাপ্পের সামনে। ততক্ষণে ঝড়ের গতিতে ছুটে এসেছেন সিটি ডিফেন্ডার ইয়োস্কো গাভারদিওল। পায়ের এক ডজে এমবাপ্পে তাঁকে শুধু ফেলেই দেননি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিয়াল সমর্থকদের ভাষায়, ‘জন্মভূমি ক্রোয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন!’
তারপর ঠান্ডা মাথার গোল। তিন রকম পরিস্থিতিতে তিন রকম ফিনিশিংয়ে এই একই ফল দেখে কি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে মনে পড়ে?
রিয়ালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা কিন্তু এমবাপ্পের আদর্শ। প্রথম গোলটি করার পর উদ্যাপনেও স্মরণ করেছেন রোনালদোকে। চলতি মাসের শুরুতে আল ওয়াসলের বিপক্ষে গোল করে নতুন যে উদ্যাপন করেছেন আল নাসর তারকা, সেভাবেই হাতটা ওপরে তুলে নিচে নামিয়েছেন।
ফরাসি তারকা কি আদর্শকে ছুঁতে পারবেন? রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি বলেছেন, ‘ক্রিস্টিয়ানোর মানে পৌঁছানোর সামর্থ্য তার আছে। সে জন্য পরিশ্রম করতে হবে...সে ক্রিস্টিয়ানোর মানে পৌঁছাতে পারে, তবে কাজটা সহজ হবে না।’
সহজ যে হবে না, সেটা সবাই জানেন। তবে মিলটা হলো, ২০১৮ সালে রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর এ সাত বছরে তাঁর জুতা জোড়া পরার জন্য একদম আদর্শ কাউকে পায়নি মাদ্রিদের ক্লাবটি—এ কথাটি এখন একটু সংশোধন করে বলতে হবে, এমবাপ্পে আসার আগ পর্যন্ত। কারণ ফিনিশিংয়ে একই ধারা ও বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠার ক্ষমতা। সুপার কাপ ক্লাসিকোয় গোল করেছেন, ফিফা আন্তমহাদেশীয় কাপ ও মাদ্রিদ ডার্বিতেও জাল খুঁজে পেয়েছেন। সিটির সঙ্গে এই লড়াইটি শ্রেষ্ঠত্বের হলেও এমবাপ্পের জন্য বিষয়টি একটু আলাদা। বলা ভালো, বেশ সহজ। তাঁর সাবেক ক্লাব এএস মোনাকোর এক্স পোস্ট দেখে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যায়, ‘এমবাপ্পে ও ম্যানচেস্টার সিটি, ভালোবাসার গল্প।’
কেন? মঁশিয়ে এমবাপ্পে ছাড়া রিয়ালের আর কোনো খেলোয়াড় যে গার্দিওলার দলের বিপক্ষে কখনো হ্যাটট্রিক করতে পারেননি! শুধু কি তাই, ইউরোপসেরার এ প্রতিযোগিতায় সিটির বিপক্ষে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এমবাপ্পের গোল সবচেয়ে বেশি—৭ ম্যাচে ৭ গোল। এই পথে রিয়াল তারকা ছুঁয়েছেন ৮ ম্যাচে ৭ গোল করা লিওনেল মেসিকে! এই পথে রিয়াল তারকা বুঝিয়েছেন নিজের ব্যক্তিত্বকেও, ‘স্বপ্ন পূরণ করা অন্য বিষয়, আমি ভালো খেলতে চেয়েছি, যুগটা নিজের করে নিতে চেয়েছি, ইতিহাস গড়তে চেয়েছি রিয়ালে, তাই ব্যক্তিত্ব নিয়ে খেলেছি।’
এমবাপ্পের সেই ব্যক্তিত্বের ভেতরে একটি লোভও আছে। সেই লোভের পিছু ছুটতে থাকলে বার্নাব্যুতে কিংবা প্রতিপক্ষের মাঠে সামনে এমন রাত যে আরও আসবে, তা এখনই লিখে রাখতে পারেন, ‘এমন ম্যাচই আমরা খেলতে চাই। লোকে এসব রাতের কথাই বলেছে আমাকে, এখন তো নিজের চোখেই দেখছি এবং আমি এমন অনেক রাতের ভেতর বেঁচে থাকতে চাই।’
বার্নাব্যুতে কাল রাতে রিয়াল সমর্থকদের হৃদয়ে এমবাপ্পে নামটি খোদাই হয়ে গেছে। এই রাত তাঁকে দিয়েছে দুহাত ভরেও। মাত্র ২৬ বছর ৬১ দিন বয়সে ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে এমবাপ্পে ৫০০তম গোলে সংশ্লিষ্টও হলেন এই রাতে। ৩৫৮ গোলের পাশাপাশি গোল করিয়েছেন ১৪২টি। তবে গোল তো আসবেই। এমবাপ্পের আসল লক্ষ্য অবশ্য গোল নয়, শিরোপা! বিশ্বকাপ জেতা হলেও যে শিরোপাটি এখনো জেতা হয়নি তাঁর ক্যারিয়ারে। চ্যাম্পিয়নস লিগ! শুনুন এমবাপ্পের মুখেই, ‘শিরোপা জয়ই সবকিছু। ক্যারিয়ারে অনেক গোল করেছি। সেগুলো সব কি জলে যাবে, কারণ সব সময় তো শিরোপা জিততে পারিনি। অনেক গোলের পাশাপাশি যদি শিরোপাও জিততে পারি তাহলে (রিয়ালের) ওই পর্যায়ে উঠব।’
নদীর নতুন পাড় জাগলে লোকে তার ওপরই ভরসা নিয়ে দাঁড়ায়, ভাঙা পাড়ে নয়। নতুন পাড় মানেই তার পাশজুড়ে দিগন্তবিস্তৃত ভরা ফসলের খেত। এমবাপ্পে নামের নতুন পাড়ে ভরসা রেখে রিয়াল সমর্থকেরা এখন সেসব ফসল তুলে নেওয়ারই অপেক্ষায়।