লুইস ফিগো, ডেভর সুকার, ফাবিও ক্যানাভারো, আন্দ্রেয়া পিরলো, ফ্রান্সেসকো টট্টি, জাভি হার্নান্দেজ, মানুয়েল নয়ার, মেসুত ওজিলদের মতো কিংবদন্তিদের উত্থানে যে মঞ্চের নেপথ্য ভূমিকা ছিল, সেটি অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ।
ছোটদের এই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা থেকে ফিগো-পিরলো-জাভিদের বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার শুরু। পরশু শেষ হওয়া অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোও তেমন কিছু ভবিষ্যৎ তারকার আবির্ভাবের বার্তা দিয়েছে, যাঁরা নিজেদের নৈপুণ্য ও ফুটবলশৈলীতে গড়ে দিয়েছেন ম্যাচের ভাগ্য।
জর্জিয়ার বাতুমিতে শনিবার রাতে ফাইনালে স্পেনকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে ৩৯ বছর পর ছোটদের ইউরো জিতেছে ইংল্যান্ড। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরোতেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংলিশরা। এর আগে ২০১৭ সালে জিতেছিল অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ। একটা ট্রফির জন্য ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ৫৭ বছর ধরে হাহাকার থাকলেও বয়সভিত্তিক দলগুলো যে নিয়মিতই সাফল্যের চূড়ায় উঠছে, তা তো সাম্প্রতিক ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা তরুণদের অনেকেই পরে হয়তো জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন। হয়ে উঠবেন বড় তারকা। এমন সম্ভাবনাময়ীদের মধ্যে যাঁর নাম শুরুতেই বলতে হয়—গিওর্গি সুদাকভ। জীবনের বাস্তবতা যত নিষ্ঠুরই হোক, কীভাবে সয়ে নিতে হয়; সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ ইউক্রেনের এই মিডফিল্ডার।
ইউক্রেন প্রসঙ্গে বুঝে ফেলার কথা, রুশ আগ্রাসনে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে হামলা চালান, আর সবার মতো দিগ্বিদিক ছুটছিলেন সুদাকভ। প্রাণ বাঁচাতে শেষে আশ্রয় নেন একটি বাংকারে। একা নন; সঙ্গে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকা। সে সময় ফুটবল হয়ে উঠেছিল গৌণ। জীবন বাঁচানোই আসল। খেলতে নামা দূরে থাক, অনুশীলন করার মতোও পরিস্থিতি ছিল না।
সেই সুদাকভ এখন আলোচনায় ফুটবলের কারণেই। অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোয় ইউক্রেনকে শিরোপা জেতাতে পারেননি। স্পেনের কাছে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়তে হয়। কিন্তু সর্বোচ্চ ৩ গোল করে সুদাকভ জিতেছেন গোল্ডেন বুট!
এবারের প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বুটের পুরস্কারটা চমক হয়েই এসেছে। সেটা গোলসংখ্যা ও গোলদাতার সংখ্যা দুই দিক থেকেই। ২০০২ সালের পর প্রথমবার ৪টির কম গোল করে গোল্ডেন বুট জেতার নজির দেখা গেল এবার। তা-ও একজন-দুজন নন; পুরস্কারটা যৌথভাবে জিতেছেন ৩ জন। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ ইউক্রেনের গিওর্গি সুদাকভের সঙ্গে রানার্সআপ স্পেনের সের্হিও গোমেজ ও আবেল রুইজ।
সাধারণত এক পুরস্কার একাধিক খেলোয়াড় জিতলে এর মালিকানা যৌথভাবে ভাগাভাগি করে নেন। তবে গোমেজ, রুইজ, সুদাকভদের জন্য উয়েফাও রেখে দিয়েছিল চমক। ৩ জনকেই খুশি করতে আলাদা তিনটি গোল্ডেন বুট উপহার দিয়েছে ইউরোপীয় ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
শক্তিশালী ফ্রান্সকে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে দেওয়ার ম্যাচে জোড়া গোল করে আবারও ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হন সুদাকভ। ওই ম্যাচ শেষে ইনস্টাগ্রামে লেখেন, ‘একজন ইউক্রেনীয় হিসেবে গর্বিত। এই দলের অংশ হতে পেরেও গর্বিত।’
শাখতার দোনেৎস্ক একাডেমি থেকে উঠে আসা এই মিডফিল্ডার মূল দলে সুযোগ পান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তখন থেকেই দলের নিয়মিত মুখ। জাতীয় দলেও অভিষেক হয়েছে ২ বছর আগে। চেলসির উইঙ্গার মিখাইলো মুদরিকের সঙ্গে মাঝমাঠে সুদাকভের বোঝাপড়া ছিল অসাধারণ। মুদরিক আগামী মৌসুমেই তাঁকে চেলসি সতীর্থ হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাঁর সে ইচ্ছার কথা ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও দিয়েছেন।
তবে সুদাকভ আপাতত পরিবারকেই সময় দিচ্ছেন। জীবনের কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে আসা ফুটবলারকে ইদানীং বাড়তি দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। ২০ বছর বয়সী তরুণ যে এখন এক রাজকন্যার বাবাও।
সুদাকভ যদি হন ছোটদের ইউরোর সবচেয়ে বড় চমক, তাহলে গোমেজকে নির্দ্বিধায় এবারের আসরের সেরা আবিষ্কার বলা যায়। ম্যানচেস্টার সিটির এ তরুণ ক্লাবের হয়ে খেলেন বাঁ পাশের উইংব্যাক হিসেবে। তবে ইউরোয় জায়গা বদলে খেলেছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। ৩ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের একজন হওয়ার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করান ২টি। মাঠে ছিলেন ৪৬৯ মিনিট। ফাইনালে স্পেন ইংল্যান্ডের কাছে না হারলে হয়তো গোমেজই পেতেন সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি।
এর আগে গোমেজ ও রুইজ স্পেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে ইউরো জিতেছেন, বিশ্বকাপে হয়েছেন রানার্সআপ। পর্তুগিজ ক্লাব ব্রাগার ফরোয়ার্ড রুইজের সঙ্গে আক্রমণভাগে তাঁর বোঝাপড়া দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। গোমেজ ৮৫.৪ শতাংশ নির্ভুল পাস বাড়িয়েছেন, ট্যাকল জিতেছেন ৩ বার, প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়েছেন ১৭ বার।
গোমেজের আরেকটি বিশেষ দিক ছিল শৃঙ্খলা। যে ৫ ম্যাচে একাদশে ছিলেন, প্রতিটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেললেও হলুদ বা লাল কার্ড দেখেননি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সিটির হয়ে গত মৌসুমে ২৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন গোমেজ। পেপ গার্দিওলা ছোটদের ইউরোয় তাঁর পারফরম্যান্স দেখে থাকলে আগামী মৌসুমে নিশ্চয়ই আরও বেশি সুযোগ পাবেন।
একটা জায়গায় অবশ্য গোমেজের চেয়ে এগিয়ে রুইজ। গোমেজ কখনো স্পেন জাতীয় দলে ডাক না পেলেও রুইজ এরই মধ্যে ২টি ম্যাচ খেলেছেন। আরেকটি কীর্তিও গড়েছেন রুইজ। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে ম্যাচের ২০ সেকেন্ডে গোল করে হয়েছেন আসরের ইতিহাসে দ্রুততম গোলদাতা।
সুদাকভ, গোমেজ, রুইজ যৌথভাবে গোল্ডেন বুট জিতলেও আসরের সেরা খেলোয়াড় কিন্তু তাঁদের কেউ হননি। টুর্নামেন্ট-সেরার স্বীকৃতি যাঁর কপালে জুটেছে, তাঁকে নিয়ে সে রকম আলোচনাই ছিল না। তিনি অ্যান্থনি গর্ডন। ৩৯ বছর পর ইংল্যান্ডকে অনূর্ধ্ব-২১ শিরোপা জেতাতে বড় অবদান রেখেছেন গর্ডন।
অথচ শিরোপাজয়ী ইংলিশ দলে ছিলেন লিভারপুলের হার্ভি এলিয়ট ও কার্টিস জোন্স, আর্সেনালের এমিল স্মিথ রোর মতো পরিচিত মুখেরা। তবে মাঠের পারফরম্যান্সে তাঁদের ছাড়িয়ে গেছেন গর্ডন। ২২ বছর বয়সী এই উইঙ্গারকে এভারটন থেকে ৪ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে (৬২১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা) কেন ছাড়িয়ে নিয়েছে নিউক্যাসল, সেটারই নমুনা দেখিয়েছেন। আসরে ২টি গোল ও ১টি অ্যাসিস্ট করেছেন। ইংলিশদের আক্রমণগুলো গতি পেয়েছে তাঁরই সুবাদে। সব মিলিয়ে মাঠে ছিলেন ৪০৮ মিনিট। গর্ডনকে টুর্নামেন্ট-সেরা ঘোষণা করতে গিয়ে উয়েফার প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষক প্যানেল জানিয়েছে, পুরো টুর্নামেন্টে তাঁর খেলার মান ছিল উচ্চপর্যায়ের।
নিউক্যাসলে উইঙ্গারের ভূমিকায় দেখা গেলেও অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোয় গর্ডনকে সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলিয়েছেন ইংল্যান্ডের কোচ লি কার্সলি। মাঠে জায়গা বদলালেও মানিয়ে নিতে তাঁর একটুও সমস্যা হয়নি। দুই দশক পর আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলবে নিউক্যাসল। সেই দলে নিশ্চিতভাবেই থাকবেন গর্ডন। অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোর ছন্দটা আগামী মৌসুমে ধরে রাখতে পারলে আরও বড় ক্লাবের সুনজর পড়তে পারে তাঁর ওপর।