এপিটাফ থেকে জেগে উঠছে ইতালিয়ান ফুটবল
আঙুলের কড় গুনে একটু পেছনে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে ইউরোপের মঞ্চে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর উল্লাসের দৃশ্য। যদিও সেই দৃশ্যগুলোয় ধুলা জমছে অনেক বছর ধরে। ধুলা জমেছে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর ইউরোপীয় শিরোপাতেও। গত ১৩ বছরে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর ট্রফি ক্যাবিনেটে জমা হয়নি ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের নতুন কোনো শিরোপা। ২০১০ সালে সর্বশেষ ইন্টার মিলানের হাত ধরে ইউরোপ সেরার ট্রফির দেখা পেয়েছিল ইতালি।
তিন ইতালিয়ান ক্লাবের একসঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার ঘটনারও পেরিয়ে গেছে এক যুগের বেশি সময়। এর মধ্যে অনেকে ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের এপিটাফও লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু ইতালির ফুটবলের বীজটা যে আরও গভীরে। সেই বীজই এখন আরেকবার মহিরুহ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ১৭ বছর পর আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে ফিরে এসেছে ৩ ইতালিয়ান দল। এ যেন ইতালিয়ান ফুটবলের নতুন জাগরণ!
ইতালিয়ান ফুটবলের রেনেসাঁর পতাকা হাতে এগিয়ে এসেছে একসময়ের পরাক্রমশালী দল এসি মিলান, সিরি ‘আ’ থেকে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন ইন্টার ও ডিয়েগো ম্যারাডোনার স্মৃতিবিজড়িত ক্লাব নাপোলি। এটা নিশ্চিত, এই তিন ক্লাবের একটি সেমিফাইনালে থাকছেই। নাপোলি ও এসি মিলান শেষ আটেই একে অপরের মুখোমুখি।
দৃশ্যপট থেকে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর হারিয়ে যাওয়া আকস্মিক কোনো ব্যাপার ছিল না। প্রায় দুই দশক ধরে ইউরোপীয় ক্লাবগুলোয় মালিক হয়ে আসছেন ইউরোপ-এশিয়ার ধনকুবেররা। যা এক ধাক্কায় পুরো চিত্রটা নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। আর এ জায়গাতেই মূলত পিছিয়ে পড়ে ইতালিয়ান ক্লাবগুলো। ক্লাবমালিকেরা তাঁদের ক্লাবগুলোকে মাঠের ফুটবলের জন্য প্রস্তুত করার বদলে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রচারণা ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা শুরু করে। যার ফলে ক্রমে পিছিয়ে পড়তে পড়তে একসময় কোণঠাসা হয়ে পর্দার অন্তরালে চলে যায় ক্লাবগুলো। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ইতালির পতনের সঙ্গেও বিষয়টি অনেকটা জড়িয়ে। ইতালিতে নতুন প্রতিভার আগমন প্রায় থমকে যায়।
তবে অন্ধকার টানেলের শেষ নাকি আলো থাকে। সেই আলোর ঝলকানিই বোধ হয় এবার দেখতে শুরু করেছে ইতালির ক্লাব ফুটবল। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগমন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে ক্লাব ফুটবলকে। বর্তমানে ইন্টার মিলান ও এসি মিলানসহ সিরি ‘আ’র সাতটি ক্লাবের মালিক বিদেশি। যাঁদের পাঁচজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন কানাডার ও আরেকজন চীনের।
ইতালির ফুটবলের এই রেনেসাঁর অংশ হয়ে চলতি মৌসুমে জাদুকরি রূপে সামনে এসেছে নাপোলি। কয়েক মৌসুম ধরেই তাদের উত্থানের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এবার তো ৩৩ বছর পর লিগ শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তেই পৌঁছে গেছে নাপোলি। লুসিয়ানো স্পালেত্তির কোচিং–দর্শনই মূলত বদলে দিয়েছে নেপলসের ক্লাবটিকে। খিচা কাভারেস্কাইয়া ও ভিক্তর ওসিমেনের মতো প্রতিভার উপস্থিতি তাদের খোলনলচে বদলে দিয়েছে।
ইতালিয়ান লিগের সর্বশেষ প্রতিনিধি হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল ইন্টার। কয়েক মৌসুম ধরে উত্থান-পতনের ভেতর দিয়েই নিজেদের যাত্রাটা অব্যাহত রেখেছে তারা। দুই বছর আগে লিগ শিরোপা জিতলেও অর্থনৈতিক কারণে খেলোয়াড় ছেড়ে দিতে হয় তাদের। দায়িত্ব ছেড়ে দেন শিরোপা জেতানো কোচ আন্তেনিও কন্তেও। এরপরও পুরোপুরি লক্ষ্যচ্যুত হয়নি ক্লাবটি। লিগে পথ হারালেও চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ আটে খেলছে তারা। ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে নিজেদের যাত্রা তারা কতটা দীর্ঘায়িত করতে পারে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
একসময় ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি ছিল মিলান। বিশ্বসেরা তারকাদের পদচারণে মুখর ছিল মিলানের আঙিনা। সেই মিলানই এক দশকের বেশি সময় ধরে ছিল পর্দার অন্তরালে। মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে রীতিমতো হারিয়ে যেতে বসেছিল ক্লাবটি।
মার্কিন মালিকের অধীনে নতুন করে ফিরে এসেছে তারা। সিরি ‘আ’র বর্তমান চ্যাম্পিয়নও মিলানই। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দল নিয়ে উঠে এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে। তবে ইউরোপের মঞ্চে মিলানের লাল উৎসব ফিরবে কি না, সেটি দেখতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।