ওর্তেগার সেভই তাহলে প্রিমিয়ার লিগের ট্রফি এনে দিচ্ছে সিটিকে
বলা হয়, গোলরক্ষকেরা যেদিকে হেঁটে যান, সেদিকে ঘাস ওঠে না। প্রবাদবাক্য হয়ে যাওয়া এই কথা সব সময় সত্য নয়। এই গোলরক্ষকেরাই অনেক সময় শুষ্ক মাটিতেও ফোটাতে পারেন সুবাস ছড়ানো ফুল। গত রাতে যেমন ফুটিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটির বদলি গোলরক্ষক স্টেফান ওতের্গা।
টটেনহামের বিপক্ষে ম্যানচেস্টার সিটির ২-০ গোলে জেতা ম্যাচটা বেঞ্চ গরম করেই কাটিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ওর্তেগার। ম্যাচে পেপ গার্দিওলা যতই পরিবর্তনই আনুন, এদেরসনের বিশ্বস্ত দুটি হাতকে বদল করার ভাবনা হয়তো ভাবনার আশপাশেও ছিল না। ৩১ বছর বয়সী ওর্তেগার জন্য এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালে জার্মানির নিচের সারির ক্লাব আর্মিনিয়া বেলেফেল্ড থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে আসার পর কালকের ম্যাচটা ধরলে দুই বছরে সিটির হয়ে লিগে খেলেছেন মাত্র ১১ ম্যাচ, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩২টি।
বেশির ভাগ সময় বেঞ্চে বসেই একটি প্রিমিয়ার লিগ ও একটি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ পাঁচটি শিরোপা জেতা হয়ে গেছে জার্মান এই গোলরক্ষকের। গত রাতেও হয়তো আরও একটি ম্যাচে বেঞ্চে বসে কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই টটেনহাম হটস্পার্স স্টেডিয়ামের বেঞ্চে বসেছিলেন ওর্তেগা। ম্যাচের ৬১ মিনিট পর্যন্ত সবকিছু সেই অনুযায়ীই চলছিল। ৫১ মিনিটে আর্লিং হলান্ডের গোলে এগিয়েও গিয়েছিল সিটি। কিন্তু বিপত্তিটা বাধে ৬২ মিনিটে। দেয়ান কুলুসেভেস্কির দূরের পোস্ট উদ্দেশ করে করা ক্রসটিকে জালের ঠিকানা দেখাতে স্লাইড করেছিলেন টটেনহাম ডিফেন্ডার ক্রিস্টিয়ান রোমেরো।
বলের নাগাল তো পাননি, উল্টো রোমেরো গিয়ে সরাসরি আঘাত করেন এদেরসনকে। দুজনের সংঘর্ষের দৃশ্যই বলে দিচ্ছিল ধাক্কাটা কতটা গুরুতর ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর উঠে দাঁড়ালেও এদেরসনের শরীরী ভাষা ও অভিব্যক্তিতে অস্বস্তিটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে এদেরসনকে মাঠে রাখার ঝুঁকি নেননি গার্দিওলা। তাঁর বদলি হিসেবে ৬৯ মিনিটে মাঠে নামান ওর্তেগাকে।
একই সময়ে জেরেমি ডকুকে নামিয়ে তুলে নেওয়া হয় কেভিন ডি ব্রুইনাকেও। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের সেরা দুই খেলোয়াড়কে হারানোকে সিটি সমর্থকেরা হয়তো বিপদের পূর্বাভাস হিসেবেই দেখছিল। বদলি হওয়ার পর এদেরসনের অভিব্যক্তিতে হতাশা ও ক্ষোভ ছিল স্পষ্ট। অন্যদিকে মাঠে নেমে শুরুতেই কুলুসেভেস্কির শট রুখে দিয়ে দলকে গোল খাওয়া থেকে বাঁচান ওর্তেগা। ম্যাচের আসল মুহূর্তটা আসতে তখনো ঢের বাকি।
১ গোলে এগিয়ে থাকলেও, টটেনহামের একের পর আক্রমণে ঝড়ে বারবার টাল হারাচ্ছিল সিটি। মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় কাঙ্ক্ষিত সমতাসূচক গোলটি পেয়ে যেতে পারে স্পার্সরা। এমন পরিস্থিতিতেই ৮৬ মিনিটে গোলের সুবর্ণ এক সুযোগ আসে টটেনহাম ফরোয়ার্ড সন হিউং-মিনের সামনে। নিজ অর্ধে ব্রেনান জনসনের হাই প্রেসিংয়ে বলের দখল হারান ম্যানুয়াল আকাঞ্জি।
দৌড়ে এসে সেই বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সিটির বক্সের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন সন। টটেনহাম অধিনায়কের পায়ে বল যাওয়ার পরই গার্দিওলা ধরে নেন সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। নিশ্চিত গোল আশঙ্কা করে সন শট নেওয়ার আগেই হতাশায় সাইডলাইনের পাশেই চিত হয়ে শুয়ে পড়েন সিটির স্প্যানিশ কোচ। কিন্তু পরের মুহূর্তে যা ঘটেছে সেটা সম্ভবত গার্দিওলা নিজেও আশা করেননি।
ওয়ান-অন-ওয়ানে নিশ্চিত গোলের পজিশনে থাকা সনের শট অবিশ্বাস্যভাবে পা ছড়িয়ে ঠেকিয়ে দেন ওর্তেগা। ম্যাচ ও মৌসুমের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি মোটেই সাধারণ কোনো সেভ কোনো ছিল না। একে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ মুহূর্তে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজের অনন্যসাধারণ সেভটির সঙ্গে।
সেদিন ঠিক একইভাবে রান্দাল কোলো মুয়ানির শট ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ-স্বপ্নভঙ্গের দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মার্তিনেজ। কাল রাতে ওর্তেগার সেই সেভটিকেও নিশ্চিতভাবে ‘মোমেন্ট অব দ্য সিজন’ বলা যায়। ৮৬ মিনিটে সনের শট জালে জড়ালে ম্যাচে ১-১ সমতায় ফিরত টটেনহাম। যা হয়তো পরের কয়েক মিনিটের জন্য ম্যাচের গতিপথই বদলে দিত।
আর এ ম্যাচে পয়েন্ট হারানো মানে শেষ দিনে শিরোপা রেসের লাগামটা আর্সেনালের হাতে চলে যাওয়া। ওর্তেগার সেই সেভ শিরোপা রেসে সিটিকে রীতিমতো নতুন জীবনদান করেছে। ম্যাচ শেষে সিটি কোচ গার্দিওলা সরাসরিই বলেছেন, ‘সে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। নয়তো আর্সেনালই চ্যাম্পিয়ন হতো।’
ওর্তেগার এই সেভ যেমন সিটিকে নতুন জীবন দিয়েছে, তেমন হৃদয় ভেঙেছে আর্সেনাল সর্থকদের। এই ম্যাচে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী টটেনহামের জয়ের আশাতেই প্রার্থনায় বসেছিলেন গানার সমর্থকেরা। কিন্তু ওর্তেগার এই সেভ যেন তাঁদের ২০ বছর পর লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে পানি ঢেলে দিল। শেষ দিন ওয়েস্ট হামকে হারিয়ে সিটি যদি শিরোপা জেতে, তবে এই সেভটিকেই বিবেচনা করা হবে শিরোপা নির্ধারক হিসেবে।
যেখানে নায়ক হবেন মৌসুমজুড়ে চিত্রনাট্যের বাইরে থাকা অখ্যাত এক গোলরক্ষক।
ওর্তেগার এই সেভ আরও অনেক বছর আর্সেনাল সমর্থকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক লিভারপুল কিংবদন্তি জেমি ক্যারাঘারও। স্কাই স্পোর্টসে গ্যারি নেভিলের সঙ্গে এক আলাপে ক্যারাঘার বলেছেন, ‘ওর্তেগাকে আমরা ম্যাচসেরা নির্বাচন করেছি। কারণ, আজ রাতে এককভাবে ম্যানচেস্টার সিটিকে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাটা জিতিয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে মৌসুম শেষে অনেক কথা হবে।
ওর্তেগা যদি গোলটি না বাঁচাত, তবে আর্সেনাল প্রিমিয়ার লিগ জিতে যেত। এটা ছিল সেই মুহূর্ত, যখন শিরোপা আর্সেনালের হাত থেকে সিটি হাতে চলে গেছে।’ আর্সেনাল সমর্থকদের জন্য সেই মুহূর্তটির প্রভাব কেমন হবে, তা জানিয়ে ক্যারাঘার আরও বলেন, ‘আজ থেকে ৫, ১০ বা ১৫ বছর পরও এই মুহূর্ত তাদের তাড়া করে বেড়াবে। যদি এর মধ্যে আর্সেনাল লিগ জেতে, তারপরও।’
ওর্তেগার এই সেভ আর্সেনালের চিরদুঃখের কারণ হবে কি না, তা জানতে আগামী রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেটি যদি না–ও হয়, তবু জার্মান গোলরক্ষকের তৈরি করা এই মুহূর্ত বারবার দৃষ্টান্ত হয়ে ফিরে আসবে। অথচ এই মুহূর্ত না এলে প্রথম সারির সব শিরোপা জেতার পরও ওর্তেগার নাম হয়তো বিস্মৃতিতেই তলিয়ে যেত। বয়স ৩১ পেরিয়ে যাওয়া, কখনো জাতীয় দলে না খেলা একটি ক্লাবের দ্বিতীয় গোলরক্ষককে কে আর মনে রাখবে! কিন্তু পরশু রাতের পর বিস্মৃত হওয়ার সেই শঙ্কা ধুয়েমুছে দিলেন ওর্তেগা।