যে কারণে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের এমন পতন
কালের স্রোতে অনেক ক্লাবই ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবল থেকে। বিজেএমসি, ওয়াপদা, পিডব্লিউডি, ফায়ার সার্ভিস, ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা, আজাদ, ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, ইয়ংমেনস ফকিরেরপুল...কত কত নাম! সর্বশেষ তাতে যোগ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয়ে গেছে একসময় ঢাকার ফুটবলের বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত ক্লাবটি।
বেশির ভাগ সময় নিস্তরঙ্গ বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে একটু ঢেউই তুলেছে খবরটা। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র শুধু একটা দল নয়, একটা আবেগ। সেই আবেগ ধারণ করে আশির দশকের শুরুতে ঢাকার শীর্ষ ফুটবলে আগমন মুক্তিযোদ্ধার। ক্লাবটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অঙ্গসংগঠন, যা চলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সংসদের আয়ের অংশ দিয়ে ক্লাবটি দীর্ঘদিন ভালোভাবেই পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে সে সময় ঢাকার তিন প্রধান দল আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্স থেকে জাতীয় দলের ১৪ জন খেলোয়াড় টেনে এনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছিল দলটি। মহসিন, জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, নকীব, রকিব, মিজান, মামুন জোয়ারদার, রুমি, মুন, আতা—সে সময়ের সেরা ফুটবলারদের বেশির ভাগ চলে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধায়। কাজী সালাউদ্দিন ছিলেন সেই দলের কোচ। ওই বছরই কাতারের দোহায় একটি আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রই খেলেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের মোড়কে। ইয়েমেনের বিপক্ষে পেয়েছিল দারুণ এক জয়।
প্রথম মৌসুমেই ফেডারেশন কাপ জেতে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৯৭ ও ২০০০ সালে লিগ শিরোপা ঘরে তোলে। এএফসি কাপে দুবার খেলে তুর্কমেনিস্তানের ক্লাবের বিপক্ষে তাদের মাঠে জয় পায়। জিতেছে ভারতের ম্যাকডাওয়েল কাপও। কিন্তু উজ্জ্বল সেই অতীতের পাশে মুক্তিযোদ্ধা আজ এক দীর্ঘশ্বাস।
মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে সংগঠক হিসেবে যখন যারা এসেছে, বেশির ভাগই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। দলটাকে নিয়ে অনেকে ব্যবসা করেছে।
দেশের শীর্ষ ফুটবল থেকে এই প্রথম মুক্তিযোদ্ধার অবনমনে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন ক্লাবের সাবেক ফুটবলাররা। তাঁদেরই একজন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব। ১৯৯৪-৯৮ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার জার্সিতে টানা চারবার ঢাকার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা সাবেক ক্লাবের পতনের পেছনে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে দায়ী করছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে সংগঠক হিসেবে যখন যারা এসেছে, বেশির ভাগই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। দলটাকে নিয়ে অনেকে ব্যবসা করেছে। আমি ছেড়ে আসার পর থেকেই শুনে আসছি, ক্লাবে চাল কেনার টাকা নেই। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে তো পতন হবেই।’
আর্থিক সংকটে জেরবার মুক্তিযোদ্ধাকে এখন আর শীর্ষ লিগে মানায় না, এমনও বলছেন নকীব। বললেন কারণটাও, ‘অনেক বছর ধরেই দেখছি মুক্তিযোদ্ধার অবস্থা ভালো নয়। দলের জন্য ভালো বাজেট না থাকলে হয় না। গত বছর জাপানি এক ফুটবলার অনুদান এনেছে ক্লাবের জন্য। এটা ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। এমন ক্লাব প্রিমিয়ার থেকে নেমে যাওয়াই ভালো।’
ক্লাবের এই পতনের অনেক কারণ। পৃষ্ঠপোষকতা কতটা ছিল, বর্তমান নেতৃত্ব ঠিকমতো সব পরিচালনা করতে পেরেছে কি না, প্রশ্ন আসেই।
মুক্তিযোদ্ধায় দুই বছর খেলা আলফাজ আহমেদ বলছেন, পেশাদার দল চালানোর অনেক খরচ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে। এই অবস্থা যে এক দিনে হয়নি, মনে করিয়ে দিলেন সেটাও, ‘ক্লাবটির দুরবস্থা তো আজকের না। ২০১০-১১–এর দিকে কাঞ্চন, টিটু, মনিরা খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় নিজেরা চাঁদা তুলে দলটাকে বাঁচায়। কয়েক বছর ধরে ক্লাবটির পৃষ্ঠপোষকতা ঠিকমতো হয়নি বলে জানি। তবে কারণ যা–ই হোক, শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে গড়া দলের নেমে যাওয়া হতাশার।’
মুক্তিযোদ্ধায় ৯ বছর খেলেছেন জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার সাইফুর রহমান মনি। পেছনে তাকিয়ে বলছেন, ‘২০০৯-১০ সালের দিকে আমরা মুক্তিযোদ্ধার ফুটবলাররা কোথাও খেপ খেললে টাকা রাখতাম ক্লাবের জন্য। তা দিয়ে বাজার করে ক্লাবটাকে টিকিয়ে রেখেছিলাম।’
দুই মেয়াদে ১২ বছর মুক্তিযোদ্ধার কোচ ছিলেন শফিকুল ইসলাম মানিক। একবার ৯ বছর, একবার ৩ বছর। দুটি লিগ জয়ও তাঁর অধীনে। কোচ হিসেবে মানিকের প্রতিষ্ঠাও এই ক্লাবেই। সেই মানিক আজ ব্যথিত, ‘আমার হাত দিয়ে ১২-১৩টি ট্রফি জেতে মুক্তিযোদ্ধা। গোপালগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধার ভেন্যু নেওয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখি আমি। ক্লাবের এই পতনের অনেক কারণ। পৃষ্ঠপোষকতা কতটা ছিল, বর্তমান নেতৃত্ব ঠিকমতো সব পরিচালনা করতে পেরেছে কি না, প্রশ্ন আসেই। মালয়েশিয়ার কোচ তো ভালোই ছিলেন। তারপরও বলব, দুর্ভাগ্য তাদের এবার অবনমনের লড়াইটাও কঠিন হয়েছে।’
১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা প্রথমবার ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিল। তখনকার একটা স্মৃতি স্মরণ করেন মানিক, ‘সে সময় আমার সামনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ চৌধুরীকে বলেছিলেন, “আহাদ, মাঠে কেউ মুক্তিযোদ্ধাকে গালি দিলে আমার ভালো লাগে না। মুক্তিযোদ্ধা নাম বদল করে কিছু করা যায় কি না দেখো।”’
মানিক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটি নেই। যদ্দুর জানি, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ক্লাবটির প্রশাসক এখন। তবে আমার মনে হয়, অনেক দিন ধরে সঠিকভাবে ক্লাবটি পরিচালিত হয়নি। যার ধারাবাহিকতায় এই পরিণতি। গুলিস্তানে এরশাদ সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে জায়গা দিয়েছে। সেই জায়গাটা কাজে লাগানো যায়নি। ক্যাসিনো–কাণ্ডে সেই স্থাপনা বন্ধ হয়ে গেছে।’
তবে এ বছর ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক কোনো সংকট দেখছেন না ক্লাবটির ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম। আরিফুল পতনের পেছনে রেফারিংকে দায়ী করে বলছেন, ‘২০১৭ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ক্লাবকে সাত কোটি টাকা দিয়েছে। এই টাকায় হয় না, তারপরও আমরা বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে ক্লাব চালিয়েছি। এ বছর দেশিদের ২০ ভাগ, বিদেশিদের ৩ মাসের বেতন বাকি। আমি নিজে দেড় কোটি টাকা পাব ক্লাবের কাছে। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি দলটাকে বাঁচাতে।’
প্রিমিয়ার থেকে অবনমিত হয়ে ব্রাদার্স আবার ফিরেছে শীর্ষ ফুটবলে। মুক্তিযোদ্ধা কি পারবে ব্রাদার্সের মতো ফিরে আসতে? সময়ই জানে এই প্রশ্নের উত্তর।