চ্যাম্পিয়নস লিগে তারকা হওয়ার এই তো সুযোগ
চ্যাম্পিয়নস লিগ যদি হয় ক্লাব ফুটবলের মহাকাশ, তবে সেই আকাশে প্রতি মৌসুমে তারার মেলাও বসে ভরপুর। ইউরোপিয়ান ফুটবলের এ মহাকাশে চলে তারায় তারায় সংঘর্ষও। যেখানে শেষ হাসি একজন হাসলেও মৌসুমজুড়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে এ লড়াই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন।
এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগের ভাঁড়ার শূন্য করে চলে গেছেন অনেক তারকা। শেষ ষোলো শেষ হওয়ার আগেই দেখা মিলেছে তারকাপতনের মহোৎসবের। এখন পর্যন্ত যে নামগুলো বাদ পড়েছে, সেগুলো পিলে চমকানোর মতোই। লিওনেল মেসি, কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমার, রবার্ট লেভানডফস্কি, আনহেল দি মারিয়ার মতো তারকারা চ্যাম্পিয়নস লিগে এখন শুধুই দর্শক।
শুধু পিএসজির বিদায়েই মহাকাশের একাংশ ফাঁকা! এর আগে গ্রুপ পর্বে বার্সেলোনা-জুভেন্টাসের মতো দলের বিদায়েও দেখা গেছে তারকাপতন। তবে প্রকৃতি নাকি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই চ্যাম্পিয়নস লিগের আকাশও খালি থাকছে না। নতুন তারকারা আগামী দিনগুলোতে দখল নিতে যাচ্ছেন সেই আকাশের। সে তালিকায় আছে অখ্যাত কিছু নামও।
চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোর লড়াই এখনো শেষ হয়নি। দ্বিতীয় লেগের চারটি ম্যাচের খেলা এখনো বাকি। যেখান থেকে বিদায় নেবে আরও চারটি দল। অর্থাৎ এ পর্বেই তারকাপতনের ধারা আরও চলবে। আগামী বুধবার রাতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল।
ঘরের মাঠে ৫-২ গোলে হেরে পিছিয়ে থাকা লিভারপুলকে পরের পর্বে যেতে হলে রীতিমতো ইতিহাস বদলাতে হবে। অন্তত তিন গোলে জিতে সমতা ফেরাতে হবে। আর জিততে হলে সেই ব্যবধানকে নিয়ে যেতে হবে চারে। ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসটা ঝলমলে হওয়ায় লিভারপুলকে এখনো অনেকে হিসাবের খাতা বাদ দিতে রাজি নয়। তবে বাস্তবতা বলছে, কাজটা তাদের জন্য বেশ কঠিনই হবে।
রিয়াল-লিভারপুলের যে দলই টিকে থাকুক, শেষ পর্যন্ত এ সপ্তাহে আরও একঝাঁক তারকার বিদায় দেখতে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। লিভারপুল বিদায় নিলে নিভে যাবে মোহাম্মদ সালাহ, ভার্জিল ফন ডাইক, কোডি গাকপো এবং দারউইন নুনিয়েজদের আলো। আর নাটকীয় কিছুতে রিয়াল বিদায় নিলে নিভে যাবে করিম বেনজেমা, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগোদের বাতি।
তাই শেষ পর্যন্ত যে দলই বিদায় নিক, ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে আরও একবার দেখা যাবে একগুচ্ছ তারকাপতনের দৃশ্য। আর রিয়াল যদি টিকে যায়, তবে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে বেনজেমা-মদরিচদের ছাপিয়ে দলটির বড় নায়ক হয়ে উঠতে পারেন ভিনিসিয়ুস। গত মৌসুমে ফাইনালে গোল করলেও, সেবার দুর্দান্ত খেলা বেনজেমার আড়ালেই ঢাকা ছিলেন ভিনি। এবার সুযোগ আছে এককভাবে তারকা হওয়ার। অন্য দিকে লিভারপুলকে ‘মিরাকল’ উপহার দিতে হলে জ্বলে উঠতে হবে সালাহকেই। এখন পর্যন্ত ৮ গোল ও ২ সহায়তায় প্রতিযোগিতার সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়ও কিন্তু ‘মিশরের রাজা’ই।
রিয়াল-লিভারপুলের সঙ্গে একই দিন আরেক ম্যাচে মুখোমুখি নাপোালি ও আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট। প্রথম লেগে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকায় দারুণ ছন্দে থাকা নাপোলির পরের পর্বে যাওয়া এখন অনেকটা সময়ের ব্যাপার। এবারের মৌসুমে নাপোলির মধ্য দিয়ে আন্ডারডগদের নতুন উত্থান দেখেছে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল। আর ডিয়েগো ম্যারাডোনার স্মৃতিবিজড়িত ক্লাবটি উপহার দিয়েছে একাধিক তারকা ফুটবলারেরও, যাঁদের অন্যতম খিচা কাভারাস্কেইয়া ও ভিক্টর ওশিমেন।
জর্জিয়ার ২২ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড কাভারস্কেইয়াকে ধরা হচ্ছে এ মৌসুমের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। খেলার ধরন ও প্রভাবের কারণে তাঁর নামই হয়ে গেছে কাভারাডডোনা বা নতুন ম্যারাডোনা। কেউ কেউ আবার তাঁকে ডাকেন ‘জর্জিয়ান মেসি’ বলেও, যাঁর ড্রিবলিংয়ের দক্ষতাকে তুলনা করা হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি গারিঞ্চার সঙ্গে।
নাপোলি যদি চ্যাম্পিয়নস লিগে এ মৌসুমে বিশেষ কোনো চমক দেখাতে চায়, তবে কাভারস্কেইয়াকে তাঁর ছন্দ ধরে রাখতে হবে। চ্যাম্পিয়নস লিগে এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচ খেলে ২ গোল এবং ৪ গোলে সহায়তা করেছেন কাভারাস্কেইয়া। শুধু কাভারাস্কেইয়া জ্বলে উঠলেই অবশ্য হবে না, নাপোলির বড় কিছু করতে প্রয়োজন হবে ভিক্টর ওশিমেনকেও।
সম্প্রতি ইতালিতে সেরা বিদেশি অ্যাথলেটের পুরস্কার পেয়েছেন ওশিমেন। নাইজেরিয়ান এই ফরোয়ার্ড ইউরোপীয় মঞ্চে ৪ ম্যাচ খেলে করেছেন ২ গোল। এখন কাভারাস্কেইয়া ও ওশিমেন নাপোলিকে উৎসবের উপলক্ষ উপহার দিতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
ম্যানচেস্টার সিটির জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ যেন এক দুঃখের সাগর হয়ে আছে। কাছাকাছি গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসা এটাই যেন তাদের নিয়তি। সেই নিয়তি কি এবার বদলাতে পারবে পেপ গার্দিওলার দল। উত্তর পেতে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় লেগে কিন্তু অশনিসংকেত নিয়ে মাঠে নামবে তারা।
প্রথম লেগে আরবি লাইপজিগের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছে ম্যান সিটি দ্বিতীয় লেগে দারুণ কিছু করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে ইংলিশ পরাশক্তিকে। আর সেটি হলে এ মঞ্চে নায়ক হয়ে উঠতে হবে আর্লিং হলান্ডকে। অবিশ্বাস্য ছন্দ নিয়ে মৌসুম শুরু করেছিলেন হলান্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগেও পেয়েছিলেন উড়ন্ত শুরু।
কিন্তু সাম্প্রতিক কিছুটা যেন নিজের ছায়াতেই ঢাকা পড়ে গেছেন এই নরওয়েজিয়ান তারকা। প্রথম তিন ম্যাচে ৫ গোলের পর আর সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এখন সিটিকে বহুল আকাঙ্ক্ষার ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব এনে দিতে হলে জ্বলে উঠতে হবে হলান্ডকেই।
পিএসজিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে বায়ার্ন মিউনিখ। দলীয় শক্তিই মূলত বায়ার্নের সাফল্যের মূলমন্ত্র। একক কৃতিত্বের ঝলকানি দলটিতে তাই কমই দেখা গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তেমন কিছুর প্রয়োজন হতে পারে দলটির। আর সে সময় নায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ আছে সাদিও মানে-থমাস মুলার-জামাল মুসিয়ালাদের।
নাপোলির পর এ মৌসুমে আন্ডারডগ হিসেবে জাদু দেখাচ্ছে বেনফিকাও। পর্তুগিজ এ ক্লাব শেষ ষোলোর লড়াইয়ে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে ক্লাব ব্রুগাকে। বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন তারকা এনজো ফার্নান্দেজ জানুয়ারির বদলে চেলসিতে পাড়ি জমালেও সে প্রভাব বেনফিকার ওপর পড়েছে সামান্যই।
নিজেদের দিনে জোয়াও মারিও, রাফা সিলভারা নিজেদের দিনে যেকোনো পরাশক্তিকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারেন। আর প্রিমিয়ার লিগে ধুঁকতে থাকা চেলসিকে ইউরোপে পথ দেখাতে হলে নির্ভর করতে হবে বেনফিকা থেকে নিয়ে আসা এনজোর ওপরই।
সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে সামনের ম্যাচগুলো দিয়ে নতুন তারকার উত্থানের দারুণ একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছে। সম্ভাব্যদের কেউ কেউ আগে থেকেই তারকা। কারও আবার সুযোগ আছে নতুন তারকা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার। ক্লাব ফুটবলের মহাকাশে নিজের তারকাখ্যাতিটা কে এখন খোদাই করতে পারেন, সেটিই দেখার অপেক্ষা।