ভিনিসিয়ুসের দুঃখে কাতর ব্রাজিলে তাঁর শহরও
সাও গনসালো রিও ডি জেনিরো থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট এক শহর। তেমন চাকচিক্য নেই, বোঝা যায় অঞ্চলটা একটু গরিব। ফ্ল্যামেঙ্গোর বয়সভিত্তিক একাডেমিটা এখানেই। যেখানে সবুজ কৃত্রিম টার্ফে আর দশজন কচিকাঁচার মতোই অনুশীলন করছিলেন পিয়েরে আমারো রিকার্দো। বিরতি নিতে মাঠ থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়ালেন বিশাল এক পোস্টারের নিচে। রিকার্দো যাঁকে আদর্শ মানেন—সেই ভিনিয়ুস জুনিয়রের পোস্টার।
ফ্ল্যামেঙ্গোর বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা ভিনিসিয়ুসও একসময় এ মাঠে অনুশীলন করেছেন। এখন রিকার্দোও তাঁর আদর্শ খেলোয়াড়ের পথ অনুসরণের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিন ধরে ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে স্পেনে যে তোলপাড় চলছে, সেসব খবরও জানা ১৮ বছর বয়সী ছেলেটির। তাঁর চোখে বিষয়টি ‘অমানবিক’।
কী বিষয়—তা একদম ভেঙে না বললেও চলে। ফুটবল–বিশ্বে তুলকালাম শুরু হওয়ায় প্রায় সবাই ঘটনাটা জানেন। গত রোববার ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে আরও একবার দর্শকের বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন ভিনিসিয়ুস। সেই ঘটনা গড়িয়েছে অনেক দূর।
ফিফা সভাপতি থেকে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়েরা ব্রাজিল তারকার পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্পেনেও এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। স্প্যানিশ ফুটবলে ভিনিসিয়ুস বারবার বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন (২০২১ থেকে এ পর্যন্ত ১০ বার), তাই প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে ব্রাজিলেও। দেশটির প্রেসিডেন্ট থেকে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়েরাও ভিনিসিয়ুসের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রিকার্দোর মতো উঠতি ফুটবলাররাও এ নিয়ে চিন্তিত। রিকার্দোর নিজের ভাবনা যেমন—তার মতো কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ থামবে না!
ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে গ্যালারি থেকে ভিনিসিয়ুসকে ‘বানর’ বলে কটূক্তি করা হয়েছে। এর আগেও গ্যালারি থেকে এমন সব কথা শুনেছেন ভিনিসিয়ুস। রিকার্দোর দুশ্চিন্তা এটা নিয়ে। তাঁর মতে, বর্ণবাদ দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে, ‘এটা দিন দিন আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে।’
রিকার্দোর নিজের দুশ্চিন্তার জায়গাও আছে। ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোর বয়সভিত্তিক দলে মিডফিল্ডার হিসেবে বেড়ে উঠছেন। প্রতিভা থাকায় তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বর্ণবাদের করাল গ্রাস দুশ্চিন্তায় ফেলেছে রিকার্দোকে। শৈশবে মায়ের কাছে শুনেছেন, একজন শ্বেতাঙ্গের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গকে দ্বিগুণ ভালো হতে হয়।
রিকার্দোর ভাষায়, ‘অনেকে এটাকে (বর্ণবাদ) পাত্তা দেয় না। আমাদের বিচার করা হয় চামড়ার রং দেখে। শৈশব থেকে মায়ের মুখে শুনছি, কালো মানুষদের দ্বিগুণ ভালো হতে হয়। এটাই নিয়তি।’ তবে রিকার্দো এই অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে চান। তাঁর আদর্শ ভিনিসিয়ুস যেমন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, রিকার্দোও তেমনি বর্ণবাদ জয় করেই শীর্ষদের কাতারে উঠে আসতে চান, ‘যা–ই ঘটুক না কেন, আমি উঠে আসবই।’
ফ্ল্যামেঙ্গো একাডেমির কর্মী এসকোলা ফ্ল্যামেঙ্গোর ভিনিসিয়ুসকে খুব ভালো মনে আছে। একাডেমির আদর্শ ছাত্রদের একজন ও খুব মিষ্টি একটা ছেলে ছিলেন ভিনিসিয়ুস—সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন এসকোলা। তাঁর কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েই একাডেমির সামনের ডেস্কে কাজ করা ৩২ বছর বয়সী মনিকা মন্তেইরো বললেন, ‘সে দুর্দান্ত একটা ছেলে ছিল। সবাইকে সম্মান দিত এবং নিবেদিতপ্রাণ। মাঠ ও মাঠের বাইরেও খুব ভালো ছিল।’
ভিনির উঠে আসার পথটাও জানালেন মনিকা মন্তেইরো। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ব্রাজিলের বেশির ভাগ কিংবদন্তি যেমন দারিদ্র্যপীড়িত খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে সেরা ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ভিনিসিয়ুসও তাঁদের একজন। সেই দুস্তর পথ চলার কথাও স্মরণ করলেন মন্তেইরো, ‘কাজটা তার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। পরিবারের সমর্থন ছিল, সঙ্গে পরিশ্রম তাকে এতটা উঁচুতে তুলে এনেছে। তার পুরো ক্যারিয়ারটাই আমার চোখের সামনে গড়ে উঠেছে। সে যেখানে পৌঁছাতে চেয়েছে, সেখানে যেতে পেরেছে। এভাবে তাকে ভুগতে দেখাটা খুবই দুঃখের, আমার রাগও হচ্ছে।’
ভিনিসিয়ুসের পুরো নাম ভিনিসিয়ুস হোসে পাইক্সাও দে অলিভেইরা। জন্ম সাও গনসালোর এক গরিব ঘরে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। রিয়ালে যোগ দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পরও ভিনিসিয়ুস কিন্তু শিকড় ভুলে যাননি। আগে যে পুরোনো ছোট্ট একটা ঘরে ভিনিসিয়ুসের পরিবার থাকত, সেই ঘরটাই এখন বড় করা হয়েছে এবং ভিনিসিয়ুসের পরিবার সেখানেই বসবাস করছে। বাসার পাশে রাস্তার দেয়ালে তাঁকে নিয়ে গ্রাফিতিও আঁকা হয়েছে—ব্রাজিলের জার্সি পরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন ভিনিসিয়ুস।
২২ বছর বয়সী এই উইঙ্গার নিজের এলাকার জন্যও বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করছেন। তাঁর ভিনি জুনিয়র ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে এলাকার গরিব শিশুদের স্কুলে যেতে সাহায্য করার পাশাপাশি প্রযুক্তিতেও দক্ষ করে তোলা হয়। আর আবশ্যিক হিসেবে ফুটবলার বানানোর প্রক্রিয়া তো আছেই।
ভিনিসিয়ুস বর্ণবাদের শিকার হওয়ার পর সাও গনসালো প্রশাসন তাদের ঘরের ছেলেকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও করেছে, ‘সাও গনসালো ও ব্রাজিল তোমাকে নিয়ে গর্বিত। আমাদের সব রকম সমর্থন রইল তোমার প্রতি।’
শুধু সাও গনসালো প্রশাসন কেন, ব্রাজিলের সংগীত তারকা গিলবার্তো গিল থেকে নেইমার ও রিচার্লিসনেরাও ভিনিসিয়ুসের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ব্রাজিলের সাধারণ মানুষও ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। স্থানীয় মার্কেটে ফুটবল খেলার সরঞ্জাম বিক্রি করেন ৬২ বছর বয়সী মার্সিয়া মারিয়া দা কস্তা। তাঁর মুখেই শুনুন, ‘এটা কেমন কথা! একটা ছেলেকে বানর বলা তো যুক্তিবুদ্ধির অতীত।’
ভিনিসিয়ুসের এলাকার ফোন বিক্রেতা ভিক্টর গ্যাব্রিয়েল ফেরেইরা অবশ্য মারিয়ার মতো এত ভদ্র সুরে বলেননি। মনের কথাটা বলেছেন সোজাসাপটা। বলার সময় টেনে এনেছেন নিজের দেশকেও, ‘বস্তি থেকে একটা কালো ছেলে বেড়ে উঠে নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে—ব্রাজিল এবং গোটা বিশ্বের এটা সহ্য হচ্ছে না, আর এটাই সত্যি।’