ঘুরে দাঁড়াতে যা করতে হবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে
৭৫ বছর পর গত মৌসুমে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে খেলার টিকিট পেয়েছিল ব্রেন্টফোর্ড। যেখানে ওরা টিকে আছে এবারও। এমন এক দলের কাছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো পরাশক্তি গতকাল ৪ গোল হজম করেছে। একটা গোল শোধ করতে পারেনি, অথচ ম্যাচে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকা খেলেছেন শুরু থেকে।
কয়েক বছর ধরেই ইউনাইটেডের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিম্নগামী। সেই অর্থে ব্রেন্টফোর্ডের কাছে এই হারটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। বিস্ময়কর হচ্ছে হারের ধরনটা। ম্যাচ শুরুর ৩৫ মিনিটের মধ্যেই ৪টা গোল খেয়েছে ইউনাইটেড। প্রিমিয়ার লিগ যুগে এত অল্প সময়ে আর কখনো কোনো দলের কাছে ৪ গোল খায়নি ইউনাইটেড। তা–ও যদি প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার সিটি বা লিভারপুলের মতো দল হতো, ইউনাইটেড সমর্থকেরা সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন। ব্রেন্টফোর্ডের কাছে এমন হার! ১৯৩৭ সালের পর এই প্রথম ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে ইউনাইটেডকে হারিয়েছে দলটা।
এই ম্যাচেও ইউনাইটেডের সমস্যাগুলো চোখে পড়েছে, খুব নতুন কিছু নয়। বরং প্রত্যেকটি গোলের নেপথ্যে ভূমিকা রাখল ইউনাইটেডের পরিচিত সমস্যাগুলোই।
কোচ হিসেবে এরিক টেন হাগের যোগ্যতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন নেই। কৌশলগত দিক দিয়ে আধুনিক কোচদের মধ্যে তিনি অন্যতম সেরা, এটা তিনি গত কয়েক বছরে আয়াক্সের কোচ থাকা অবস্থাতেই প্রমাণ দিয়েছেন। ইউনাইটেডের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাই টেন হাগকে ঘিরে সমর্থকদের উচ্চাশারও কমতি ছিল না। সেই আশার পালে হাওয়া লাগায় প্রাক্–মৌসুমে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলকে ৪-০ হারানোর আনন্দ। সেই ইউনাইটেড লিগ শুরু হওয়ার পর হারল প্রথম দুই ম্যাচেই।
কোচ হিসেবে টেন হাগ প্রথাগত ডাচ ঘরানার। ৪-৩-৩ ছকে খেলাতে পছন্দ করেন দলকে। তাঁর আয়াক্সও এই ছকেই খেলত, এভাবেই ডাচ লিগসহ ঘরোয়া টুর্নামেন্ট জিতেছে তারা। তবে এই ছকে খেলার জন্য একাদশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ থাকতে হয়।
একজন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের দুই পাশে দুজন ‘নাম্বার এইট’ মিডফিল্ডার থাকতে হয়। রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার যেহেতু একজনই থাকেন (সিঙ্গেল পিভোট), তাঁকে বহুমুখী কাজে দক্ষ হতে হয়। দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে থেকে ট্যাকল-ইন্টারসেপ্টের মাধ্যমে রক্ষণকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া, আগে থেকে বিপদ আঁচ করে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভন্ডুল করে দেওয়া, গোলকিপার যেন দুই সেন্টারব্যাকের পাশাপাশি তাঁকেও ছোট পাস দিতে পারেন, নিজের অবস্থানের মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে নিচ থেকে আক্রমণের গাঁথুনি দেওয়ার কাজ শুরু করা, পাশের দুই ‘নাম্বার এইট’-কে সামনে ওঠানামা করার সুযোগ করে দেওয়া ইত্যাদি।
৪-২-৩-১ ছকে খেললে যে কাজগুলো রক্ষণের সামনের থাকা দুজন মিডফিল্ডার ভাগাভাগি করে করতে পারেন, ৪-৩-৩ ছকে সে কাজগুলোই একজনকে করতে হয়। ম্যানচেস্টার সিটির রদ্রি ও ক্যালভিন ফিলিপস, লিভারপুলের ফাবিনিওর যে দক্ষতাটা আছে। যে কারণে তাঁরা নির্দ্বিধায় ৪-৩-৩ ছকে খেলতে পারেন।
কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলটায় এমন কোনো খেলোয়াড় নেই যিনি ৪-৩-৩ ছকে তিন মিডফিল্ডারের মাঝে থেকে এই কাজগুলো করতে পারেন। ব্রাজিলের ফ্রেদ, স্কটল্যান্ডের ম্যাকটমিনে, সাবেক আয়াক্স তারকা ডনি ফন ডে বিক, নতুন আসা ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন কিংবা যুবদলের জেমস গারনার—কেউই ৪-৩-৩ ছকে সিঙ্গেল পিভোট হিসেবে খেলার মতো দক্ষ নন। কয়েক বছর ধরে ইউনাইটেড এই পজিশনের জন্য কোনো খেলোয়াড় কিনছেও না। তারা কেনে আক্রমণপ্রিয় মিডফিল্ডার, খেলতে দেয় রক্ষণাত্মক ভূমিকায়। সমাধান কী করে হবে!
ব্রাইটনের বিপক্ষে লিগের প্রথম ম্যাচেও একই সমস্যা দেখা গেছে। মাঠে ইউনাইটেড যখনই ৪-৩-৩ ছকে খেলছিল, কখনো ফ্রেদ, আবার কখনো ম্যাকটমিনে একক রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ওই ভূমিকাটা পালন করার চেষ্টা করেছেন। রক্ষণনির্ভর কাজগুলো মোটামুটি করতে পারলেও, নিচ থেকে নিখুঁত পাসের মাধ্যমে আক্রমণের গাঁথুনি শুরু করা, কিংবা প্রেস এড়িয়ে বল সামনে পাঠানোর কাজগুলো কোনোভাবেই করতে পারছিলেন না দুজনের কেউই। ওদিকে ‘ম্যান মার্কিং’ কৌশলের সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে ইউনাইটেডের প্রত্যেকের পেছনে একজন করে খেলোয়াড়কে ‘প্রেস’ করার কাজে লাগিয়েছেন ব্রাইটনের কোচ গ্রাহাম পটার। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, রক্ষণ আর মাঝমাঠের লড়াইয়ে হেরে আক্রমণের শক্তিই দেখাতে পারল না ইউনাইটেড। হারল ২-১ গোলে।
গত রাতে ব্রেন্টফোর্ড ব্রাইটনের দেখানো চিত্রনাট্যই মেনে চলল পুরোপুরি। নিজেদের মাঠে সে কৌশল মেনে রোনালদোদের তারা চেপেও ধরল আরও ভালোভাবে। প্রথমার্ধে ৪ গোল তো সেভাবেই এল! ব্রাইটনের বিপক্ষে একক মিডফিল্ডার হিসেবে ফ্রেদ/ম্যাকটমিনের ব্যর্থতা টেন হাগকে উদ্বুদ্ধ করল ওই পজিশনে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনকে খেলানোর জন্য। কারণ একটাই, ফ্রেদ বা ম্যাকটমিনের চেয়ে এরিকসেনের সফল পাস দেওয়ার ক্ষমতা, পেছন থেকে আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষমতা ঢের বেশি।
কিন্তু এরিকসেনের পাসিং দক্ষতার দাম দিতে গিয়ে টেন হাগ ভুলেই গেলেন, আদতে এরিকসেন যে একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার! ট্যাকল বা ইন্টারসেপ্ট করে প্রতিপক্ষের প্রেস এড়ানোর ক্ষমতা তাঁর তেমন নেই। ১৮ মিনিটে করা ব্রেন্টফোর্ডের দ্বিতীয় গোলটা দেখুন, গোলকিপার দাভিদ দা হেয়ার কাছ থেকে বল নিতে গিয়ে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায় নেমে যাওয়া এরিকসেন স্বদেশি ম্যাথিয়াস ইয়ানসেনের প্রেসের তোপে টিকতেই পারলেন না। বল হারালেন, ইয়েনসেনও গোল করার সুযোগ নিতে ভুল করলেন না।
গত মৌসুমে এই ব্রেন্টফোর্ডেই খেলেছিলেন এরিকসেন। হৃদ্যন্ত্রের সমস্যার কারণে এককালে অবসরের চিন্তা করা এই মিডফিল্ডারকে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সুযোগ এনে দিয়েছিল এই ব্রেন্টফোর্ডই। এবার সেই ব্রেন্টফোর্ড থেকেই এরিকসেন নাম লিখিয়েছেন ইউনাইটেডে। ব্রেন্টফোর্ডের কোচ টমাস ফ্র্যাঙ্ক প্রেসের মুখে সাবেক শিষ্যর দুর্বলতা বেশ ভালোই জানতেন। নাহলে গোটা ম্যাচে ইয়ানসেনকে এরিকসেনের পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে বলবেনই বা কেন!
তবে ইউনাইটেডের সবচেয়ে বড় সমস্যা কিন্তু এটা নয়। একক রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারে এমন কেউ না থাকার চেয়েও বড় সমস্যা, ইউনাইটেডের গোলকিপার দাভিদ দা হেয়া। শুধু এরিকসেনই নন, ফ্র্যাঙ্ক জানতেন, ইউনাইটেডের রক্ষণভাগের কোনো খেলোয়াড়েরই প্রেস এড়ানোর তেমন দক্ষতা নেই। বিশেষ করে দাভিদ দা হেয়ার। মানুয়েল নয়্যার, আলিসন বেকার, এদেরসন মোরায়েসদের মতো আধুনিক গোলকিপারদের যুগে দাভিদ দা হেয়া বড্ড সাবেকি।
আলিসন বা এদেরসনরা যেমন গোলকিপার হলেও, ছোট ছোট পাসে পেছন থেকে আক্রমণ গড়তে পারেন, প্রতিপক্ষের প্রেসের মুখে বলকে তাড়াতাড়ি সুবিধাজনক অবস্থানে পাঠিয়ে দিতে পারেন, দা হেয়া ওসব পারেন না। অবশ্য শট ঠেকানোর ক্ষমতা ও রিফ্লেক্স অসাধারণ থাকার কারণে এত দিন দা হেয়ার এই দুর্বলতা নিয়ে অত বেশি কথাও ওঠেনি। উঠেছে এই গত দুই-তিন মৌসুম ধরে। এই দুই তিন-মৌসুমে তাঁর শট ঠেকানোর ক্ষমতা ও রিফ্লেক্সের অবনতিও হয়েছে যথেষ্ট বাজেভাবে। প্রমাণ, গত রাতে ব্রেন্টফোর্ডের প্রথম আর তৃতীয় গোলটা।
টেন হাগের কৌশলে খেলানোর জন্য আধুনিক একজন গোলকিপার বড্ড দরকার ইউনাইটেডের, যিনি চাপের মুখে দা হেয়ার মতো খেই হারিয়ে বল বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বলের দখল হারাবেন না। সঙ্গে দরকার একজন আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারেরও।
কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এ সমস্যাগুলো তো আজকের না, তাই না!