মেসি–বেনজেমারা এখন যেন ‘আরব্য রজনীর গল্প’, আমরা ‘শাহরাজাদ’
বিশ্ব ফুটবলের দলবদলের বাজারে হঠাৎ করেই ঘুরতে শুরু করেছে ‘আরব্য ছড়ি’। সেই ছড়ি আর কেউ নয়, ঘোরাচ্ছে সৌদি আরব। তাদের মায়াবি সেই ছড়ি (ছড়ির জায়গায় অর্থও পড়তে পারেন) ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এরই মধ্যে বশীভূত করে ফেলেছে। গুঞ্জন আছে—সেই মায়া লিওনেল মেসি, করিম বেনজেমা, লুকা মদরিচসহ ইউরোপের ফুটবলের অনেক প্রতিষ্ঠিত তারকাকেই ডাকছে।
শিরোনাম পড়েই হয়তো পাঠক বুঝে ফেলেছেন, এটা প্রতীকী। মেসি-বেনজেমাদের এখন ‘আরব্য রজনীর গল্প’ আর আমরা যাঁরা প্রায় প্রতিদিন সৌদি আরবের ফুটবলে তাঁদের খেলার সম্ভাবনা নিয়ে নানা ধরনের খবর পাঠককে দিয়ে যাচ্ছি, সেই সাংবাদিকদের ‘শাহরাজাদ’ বলার কারণ আছে। সেই কারণে যাওয়ার আগে ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ আর শাহরাজাদ নিয়ে একটু বলে আসা যাক।
প্রাচীনকালে আরবের এক বাদশাহ শাহরিয়ারের মনে নারীদের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল। সেই অবিশ্বাস থেকে তিনি ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নেন। প্রতি রাতে কোনো কুমারীকে বিয়ে করতেন, পরের দিন ভোরে সেই নারীকে হত্যা করতেন! এভাবে তিন বছর চলার পর একদিন তাঁর রাজ্যে আর কোনো কুমারী খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেচারা উজির তো পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। কোনো কুমারী পাওয়া যায়নি—এ কথা বাদশাহকে বললে নিশ্চিত তাঁর গর্দান যাবে।
মেসির সৌদি আরবের ফুটবলে যাওয়ার গুঞ্জনের শুরু রোনালদোর সেখানকার ফুটবলে নাম লেখানোর পর থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে ৪ জানুয়ারি ইতালির ওই সংবাদমাধ্যমটির খবরটি দিয়েই মেসির আরব্য ফুটবলের গল্প শুরু। সেই থেকে ধরলে এখন পর্যন্ত কেটেছে ১৪৯টি রজনী।
চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে নিজের ভবনে যেতেই উজিরের বড় মেয়ে শাহরাজাদ এগিয়ে এসে বাবার এমন অবস্থার কারণ জানতে চায়। পুরো বিষয় মেয়েকে খুলে বলেন তিনি। বিদ্যা আর বুদ্ধিতে তুখোড় শাহরাজাদ বাবার প্রাণ বাঁচাতে নিজেই বাদশাহ শাহরিয়ারকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেয়। যেমন কথা, তেমন কাজ। কিন্তু বুদ্ধিমতী শাহরাজাদ বাদশাহকে রাত জেগে গল্প শোনাতে শুরু করে। ভোরবেলা সে গল্পটা এমন জায়গায় থামিয়ে দেয়, যে পরের অংশটা শোনার অতৃপ্তি থেকেই যাবে। গল্পের পরের অংশ শোনার জন্য বাদশাহ আর শাহরাজাদকে হত্যা করতে পারে না। এভাবে বাদশাহ শাহরিয়ারকে শাহরাজাদ এক হাজার এক রাত গল্প শোনায়, যে গল্প আসলে কাল্পনিক আর মুখরোচকও বটে!
মেসি-বেনজেমা-মদরিচদের আরব্য ফুটবলে যাওয়ার গল্পও অনেকটা সে রকমই হয়ে উঠেছে। আজ এটা শোনা যায় তো পরের দিন সেটা অন্য রকম। আর প্রতিটি খবরই এমন জায়গায় গিয়ে শেষ হচ্ছে যে পরের খবরটা জানার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। কখনো কখনো তো সকালে একধরনের খবর আসে তো বিকেলে শোনা যায় অন্য খবর।
দু-একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। বার্তা সংস্থা এএফপি খবর দিয়েছিল—আগামী মৌসুমে সৌদি আরবে খেলার চুক্তি সেরে ফেলেছেন মেসি। সেই খবরেই আবার বলা হয়—তবে মেসি সৌদি আরবের কোন ক্লাবে খেলবেন, সেটি এখনো জানা যায়নি। তার মানে, ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র গল্পের মতোই মেসিকে নিয়ে পরের খবরটি জানতে আপনি উন্মুখ থাকবেন! পরের দিন অবশ্য শোনা গেল অন্য গল্প। মেসির বাবা ও এজেন্ট হোর্হে মেসি এএফপির খবরটিকে ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দেন।
মেসি-বেনজেমাদের আরব্য ফুটবলে নাম লেখানোর বিষয়ে সকালের খবর বিকেলে বদলে যাওয়ার উদাহরণও কম নেই। মেসির সৌদি আরবে খেলার বিষয়েই বলা যাক। ফ্রান্সের ফুত মেরকাতো পত্রিকা গত মঙ্গলবার সকালে খবর দিয়েছিল—মেসির বাবা হোর্হে সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলালের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার দুই বছরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছেন। বিকেলেই আবার শোনা গেল অন্য গল্প। সেখানে তাঁর বার্সেলোনায় যাওয়ার সম্ভাবনার কথা।
গত পরশু বেনজেমার সৌদি আরবের ফুটবলে যাওয়া নিয়ে খবরটিই ধরুন। বাংলাদেশ সময় পরশু সন্ধ্যায় খবর এল—৪০ কোটি ইউরোর বিনিময়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল ইত্তিহাদে যেতে চাওয়ার বিষয়টি তিনি রিয়াল মাদ্রিদকে জানিয়ে দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি সেটি সেদিনই ঘোষণা দেবেন বলে খবরও আসে। পরে বেনজেমা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি তো এখনো মাদ্রিদেই আছেন। আপাতত, রোববারের ম্যাচ নিয়ে ভাবছেন। বেনজেমার এ কথা থেকেই কী বুঝবেন আপনি! আরব্য রজনীর আরেকটি গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকতেই হচ্ছে এ নিয়ে!
একই দিন মদরিচকে নিয়ে খবরটাও ছিল এ রকমই। বিকেলের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর দিল—ক্রোয়েশিয়ার তারকা রিয়ালকে সৌদি আরবের ফুটবলে প্রস্তাব পাওয়া আর খেলতে চাওয়ার ইচ্ছার ব্যাপারে বলেছেন। রাতেই আবার খবর আসে—সৌদি আরবে যাবেন না মদরিচ, রিয়ালের সঙ্গে তাঁর নতুন চুক্তি প্রায় নিশ্চিত।
এ তো গেল মেসি-বেনজেমাদের ‘আরব্য ফুটবলের গল্প’, কিন্তু আমরা কীভাবে ‘শাহরাজাদ’! ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’তে সুলতান শাহরিয়ারকে শাহরাজাদ যে গল্পগুলো শুনিয়েছে, এর কোনোটিই তার নিজের বানানো নয়। গল্পগুলো তিনি কোথাও শুনেছেন অথবা পড়েছেন। মেসি-বেনজেমাদের সৌদি আরবের ফুটবলে খেলতে যাওয়ার যে খবরগুলো আমরা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি, সেগুলোও সে রকমই। ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিদিন এ বিষয়ে যে খবরগুলো দিচ্ছে, সেগুলোই যাচাই–বাছাই করে আমরা আমাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।
এ খবরগুলো তুলে ধরতে গিয়েও কম বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে না আমাদের। এমনিতে তো ভুয়া খবর খুঁজে বের করার জন্য ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক ‘রিউমার স্ক্যানার’-এর চাপ আছে। নেট দুনিয়ায় ‘রিউমার’ ছড়ানো ওয়েবসাইটের অভাব তো আর নেই। ‘রিউমার’ ছড়ানো সে রকম কোনো ওয়েবসাইট থেকে ‘ভুয়া খবর’ না বুঝে আমাদের পাঠকদের উপস্থাপন করলে পাঠকের সমালোচনা যেমন হজম করতে হয়, প্রতিষ্ঠানেও পড়তে হয় চাপের মুখে। তাই প্রতিটি খবরই আমাদের খবরের উৎস যাচাই–বাছাই করে দিতে হয়।
এর ওপর আবার পাঠকদের দিক থেকেও চাপ আছে। সেটা শুধু সমালোচনার বিষয়ই নয়। সঠিক ওয়েবসাইট বা সংবাদমাধ্যম থেকে সঠিক খবর দিয়েও অনেক সময় পাঠকদের তোপের মুখে পড়তে হয় আমাদের। কখনো কখনো ‘রিউমার’ ধরে নিয়ে কোনো খবর এড়িয়ে গেলেও সমস্যা। তখন কোনো কোনো পাঠক প্রশ্ন করেন—অমুকে এ খবরটি দিল আর আপনারা দিলেন না। তাহলে কি আপনারা এই খেলোয়াড়টিকে পছন্দ করেন না!
মেসির সৌদি আরবের ফুটবলে খেলার খবর নিয়ে এ রকম দুটি অভিজ্ঞা আমারই হয়েছে। প্রথমটি গত ৪ জানুয়ারির। সেদিন ছিল বুধবার, আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বিকেলবেলায় বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম, শুনছিলাম পছন্দের গান। ঠিক সেই সময় পরিচিত এক পাঠকের ফোন আসে—মেসি নাকি সৌদি আরবের ফুটবলে খেলার জন্য প্রস্তাব পেতে চলেছে, আপনারা খবরটি দিলেন না তো! পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ইতালির একটি সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছে, মেসিকে সৌদি আরবে খেলার প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছে আল হিলাল।
আরেক পরিচিত এক পাঠকের ফোন পাই গত মঙ্গলবার। অফিসের কাজ শেষে বাসায় গিয়ে একটু বসেছি। এমন সময় ফোন দিয়ে সেই পাঠক বললেন, আপনাদের প্রথম আলোকে আমরা এত বিশ্বাস করি আর আপনরাই এমন একটি খবর দিলেন! জানতে চাইলাম, আপনি কোন খবরটির কথা বলছেন? এর উত্তরে তিনি মেসির বাবার সৌদি আরবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়ার খবরটির কথা বললেন। আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম—দেখুন, এ খবরগুলো আমরা নিজেরা তো আর তৈরি করি না। ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমের খবরগুলোই আপনাদের জন্য আমরা উপস্থাপন করি। এ কথার পথ ধরেই মেসিকে নিয়ে এএফপির দেওয়ার খবরটির প্রসঙ্গ আসে। ওই পাঠক একজন মেসি-ভক্ত। তাই তিনি মেসির সৌদি আরবের ফুটবলে যাওয়ার কোনো খবরই বিশ্বাস করতে পারেন না! তাঁর কথা—এএফপি বা যারাই মেসির সৌদি আরবে যাওয়ার খবর দিক—এটা সত্যি হতে পারে না। মেসির মতো কেউ টাকার কারণে সৌদি আরবে যাবে, এমনটা তিনি মানতে পারেন না। তাঁর মতে, মেসি শেষ পর্যন্ত বার্সেলোনাতেই ফিরবেন।
তা, মেসির সৌদি আরবের ফুটবলে যাওয়ার গুঞ্জনের শুরু রোনালদোর সেখানকার ফুটবলে নাম লেখানোর পর থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে ৪ জানুয়ারি ইতালির ওই সংবাদমাধ্যমটির খবরটি দিয়েই মেসির আরব্য ফুটবলের গল্প শুরু। সেই থেকে ধরলে এখন পর্যন্ত কেটেছে ১৪৯টি রজনী। মেসির সঙ্গে পিএসজির চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে এ মাসেরই শেষে। তিনি মুক্ত খেলোয়াড় হয়ে যাবেন। এরপর ইউরোপ বা সৌদি আরবের যে ক্লাবেই নাম লেখান, দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ককে। তাই এটা নিশ্চিত যে মেসির আরব্য ফুটবলে যাওয়ার আগের গল্পটা সহস্র এক রজনী হওয়ার সুযোগ নেই। সৌদি আরবের ফুটবলে তিনি নাম লেখানোর পর সেটা সহস্র এক রজনীর হতে পারে!
আপাতত মেসি নতুন কোনো ক্লাবে নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর সৌদি আরবের ফুটবলে নাম লেখা নিয়ে আমাদের ‘শাহরাজাদ’দের গল্প বলাও (পড়ুন, খবর দেওয়া) থামে!