কোপা আমেরিকা
ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ–সতীর্থ আর মেসি–স্কালোনির কোচ লরেনৎসো কি আর্জেন্টিনার ‘বিভীষণ’ হবেন
শাস্ত্রীয় সংগীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার মর্যাদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আর এই পরম্পরা থেকেই তৈরি হয় ঘরানার। যুগের পর যুগ ধরে আবর্তিত হয় সে ধারা। এই ধারায় শিষ্য হয়তো সাফল্য, অর্জন কিংবা জনপ্রিয়তায় ছাড়িয়ে যেতে পারেন গুরুকেও। কিন্তু গুরু তবু গুরুই থেকে যান। যে কারণে পণ্ডিত রবিশঙ্কর সেতার বাজিয়ে পৃথিবী জয় করলেও তাতে গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মর্যাদা একটুও কমে না। শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো ফুটবলেও গুরু-শিষ্য পরম্পরার অবস্থান আলাদা। এই পরম্পরা কোচ ও খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কোচদের নিজেদেরও মধ্যে চলে আসছে অনেক বছর ধরে।
আর্জেন্টিনার ফুটবলে তেমনি এক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হোসে পেকারম্যানের হাত ধরে। বলা হয়, আধুনিক আর্জেন্টাইন ফুটবলের যে ধারা, তার অন্যতম পথপ্রদর্শক হলেন পেকারম্যান। আজকের লেখার মূল চরিত্র অবশ্য পেকারম্যান নন। তবে যাঁকে নিয়ে এই প্রতিবেদন, তিনি পেকারম্যানের দর্শন থেকে বেরিয়ে আসা এক কোচ, নেস্তর লরেনৎসো। গুরু-শিষ্যের জটিল সমীকরণে যিনি আবার ঘটনাচক্রে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লিওনেল স্কালোনি ও লিওনেল মেসির গুরুও বটে।
এ গুরু-শিষ্যই আগামী সোমবার ভোরে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জয়ের দ্বৈরথে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবেন। অর্থাৎ লরেনৎসোর সামনে চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে শিষ্যদের হারিয়ে নিজের দেশের বিপক্ষে কলম্বিয়াকে শিরোপা এনে দেওয়ার। এককথায় লরেনৎসোকে হতে হবে রামায়ণের বিভীষণ। রাবণের ছোট ভাই বিভীষণ যুদ্ধক্ষেত্রে ভাইয়ের বদলে রামের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং রামের সীতা উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। নিজ দেশের বিরুদ্ধে কলম্বিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে একই কাজ করতে হবে লরেনৎসোকেও। তবে বিভীষণ হয়ে শিরোপা জেতার চ্যালেঞ্জটাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও লরেনৎসোর এই পর্যন্ত আসাটা অনন্য এক গল্পই বটে।
খেলোয়াড় হিসেবে লরেনৎসোর ক্যারিয়ার মোটেই আহামরি ছিল না। জাতীয় দলের হয়ে যা শেষ হয়েছে মাত্র ১৩ ম্যাচেই। তবে এই কটি ম্যাচেই লরেনৎসোর কাছে বলার মতো এমন গল্প আছে, যা হয়তো এক শ ম্যাচ খেলা অনেক কোচের ক্যারিয়ারেও পাওয়া যাবে না। আর্জেন্টিনার ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা দলটির সদস্য ছিলেন লরেনৎসো। শেষ পর্যন্ত জার্মানিকে হারিয়ে শিরোপা জিততে না পারলেও, বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতাটুকুই তো যে কারও আমৃত্যু গল্প করার সম্বল হতে পারে। আর সেই ফাইনালের সতীর্থ যদি হন ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো কেউ, তবে তা তো সোনায় সোহাগা। ম্যারাডোনাকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে লরেনৎসো বলেছিলেন, ‘সে প্রতিদিন বিশেষ কিছু করে দেখাত।’
সেই লরেনৎসোর সামনে এবার সুযোগ ৩৪ বছরের সেই পুরোনো গল্পকে পেছনে ফেলে নতুন এক গল্প শুরুর। কোপা আমেরিকার ফাইনালে প্রতিযোগিতার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কলম্বিয়াকে কোপার শিরোপা এনে দিতে পারলে, সেটি নিশ্চিতভাবেই লরেনৎসোর ক্যারিয়ারে অনবদ্য এক গল্প হয়েই থাকবে। লরেনৎসোর কলম্বিয়া ইতিহাস গড়ার শেষ ধাপটি পেরোতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতেই থাকল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কলম্বিয়ার ডাগআউটে নিজের পারফরম্যান্সের দিকে ফিরে তাকালে, শান্ত স্বভাবের মানুষটি তৃপ্তির হাসি হাসার অনেক রসদই পাবেন।
২০২২ সালের রেইনালদো রুয়েদাকে সরিয়ে লরেনৎসোকে যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়, কলম্বিয়ার অনেকেই তাঁকে সেই পদে দেখতে চাননি। যে তালিকায় দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার কার্লোস ভালদেরামাও ছিলেন। তাঁদের চাওয়া ছিল মূলত দেশীয় কোনো কোচ। পাশাপাশি কলম্বিয়ানরা তাঁকে চিনত পেকারম্যানের সহকারী হিসেবে। ফলে এমন কোচ কলম্বিয়ার ফুটবলকে আদৌ সাফল্য এনে দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কাও ছিল কলম্বিয়ানদের। লরেনৎসো অবশ্য নিজের আদর্শ ও দর্শন নিয়ে সব সময় আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এরপরও তাঁর জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে সময় লাগেনি। যার শুরুটা হয় হামেস রদ্রিগেজকে দলে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর।
‘না, না, না’-রদ্রিগেজের ফেরার খবরে কলম্বিয়ানদের শুরুর প্রতিক্রিয়া ছিল এমন। তবে হাল ছাড়েননি লরেনৎসোও। শুরু করেন রদ্রিগেজকে কলম্বিয়া জাতীয় দলে ফেরানোর মিশন, যা একই সঙ্গে কোচ হিসেবে এবং দল ব্যবস্থাপনায় লরেনৎসোর হার না মানা মনোভাবকেও তুল ধরে। লরেনৎসো যখন দায়িত্ব নেন, রদ্রিগেজ তখন খেলছিলেন কাতারের আল রায়ান ক্লাবে। অর্থাৎ শীর্ষ সারির ফুটবল থেকে রদ্রিগেজ তখন অনেক দূরে। অনেকেই তখন সাবেক এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের এপিটাফও লিখে ফেলেছিল। কিন্তু রদ্রিগেজের সামর্থ্য পেকারম্যানের সহকারী হিসেবে খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন লরেনৎসো। ফলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন আর্জেন্টাইন এই কোচ।
এরপর তিনি নিজে কাতারে গিয়ে দেখা করেন রদ্রিগেজের সঙ্গে। কলম্বিয়ান ফরোয়ার্ডকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, কাতার থেকে বেরিয়ে আরও শক্তিশালী কোনো লিগে খেলতে। এই পরামর্শ মেনে রদ্রিগেজ আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে পাড়ি জমান গ্রিসে। অলিম্পিয়াকোসের হয়ে খেলা শুরু করেন। সেটি ছিল রদ্রিগেজের জাতীয় দলে ফেরার প্রথম ধাপ। সেখান থেকে তিনি চলে আসেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সাও পাওলোতে। কিন্তু ফিটনেসের জন্য সুযোগ পাচ্ছিলেন না রদ্রিগেজ।
তখন তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন লরেনৎসোই। বলেছিলেন, ‘দুশ্চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে হবে।’ কোচের কাছ থেকে ভরসা পেয়ে অন্য এক লড়াই শুরু করেন রদ্রিগেজ, যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে এসেছে কোপা আমেরিকার ফাইনালে। কোপার এবারের আসরের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও একসময় জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে থাকা এই ফুটবলার। রদ্রিগেজের পুনরুত্থানের পুরোটাই মূলত লরেনৎসোরই দান।
লরেনৎসো নিশ্চয়ই একজন ফুটবলারকে তাঁর ক্যারিয়ার ফিরিয়ে দিতে এত কিছু করেননি। বাস্তবতা হচ্ছে, একজন গভীর চিন্তক ও ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে লরনেৎসোর রদ্রিগেজকে প্রয়োজন ছিল। ৩৩ বছর বয়সী এই ফুটবলারকে ছাড়া যে পূর্ণতা পাচ্ছিল না তাঁর ফরমেশন। রদ্রিগেজকে ফিরিয়েই ৪-৩-৩ ফরমেশনকে কার্যকরভাবে ৪-৩-১-২-এ বদলে দিতে পেরেছিলেন লরেনৎসো।
কেন রদ্রিগেজকে মরিয়া হয়ে দলে চেয়েছিলেন, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লরেনৎসো বলেছিলেন, ‘মাঝমাঠকে অটুট রাখতে আমার এটা করা দরকার ছিল। এর ফলে বলের নিয়ন্ত্রণও অনেক বেশি আমাদের কাছে থাকে। এটি আমাদের আগ্রাসী থাকতেও সহায়তা করে। তবে এটাই আমাদের খেলার একমাত্র পদ্ধতি নয়। আমরা ম্যাচের মধ্যেই কৌশলে পরিবর্তন নিয়ে আসি।’ তাঁর এই কৌশলই এখন ২৩ বছর পর কোপার দ্বিতীয় শিরোপার কাছাকাছি নিয়ে গেছে কলম্বিয়াকে।
কোপা আমেরিকায় কলম্বিয়ার ম্যাচগুলোর দিকে তাকালে লরেনৎসোর এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। গতি আর শক্তির প্রয়োগ করে আক্রমণে গিয়ে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে চায় তাঁর দল। মাঠের একটি কোনাও ফাঁকা ছেড়ে দেয় না কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা। জায়গা সংকুচিত করে এবং মুহুর্মুহু প্রেসিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন তাঁরা। যার ফল হচ্ছে লরেনৎসোর কলম্বিয়া এখন টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত। একটি দলকে এভাবে সব উজাড় করে দিয়ে খেলায় উদ্বুদ্ধ করা মোটেই সহজ নয়, কিন্তু এই কঠিন কাজ ম্যাচের পর ম্যাচে করে যাচ্ছেন লরেনৎসো। দলের জন্য খেলোয়াড়দের নিবেদন কেমন, তা বোঝাতে গিয়ে লরেনৎসো বলেন, ‘এমন একটি দল তৈরি করা সহজ নয়। কিন্তু এই দলের কেউ কেউ ক্লাবের চেয়ে জাতীয় দলে বেশি ভালো খেলে।’
একটি দলকে শিকড় থেকে গড়ে তোলার এই শিক্ষা লরেনৎসো পেয়েছিলেন পেকারম্যানের কাছ থেকে। খেলোয়াড় এবং কোচ, উভয় ভূমিকাতেই পেকারম্যানকে গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন লরেনৎসো। তবে কোচ হিসেবে শিক্ষাটা ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও সুদৃঢ়। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০০ সালে খেলা ছাড়ার পরই পেকারম্যানের ডাক পান লরেনৎসো। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিতই পেকারম্যানের ছায়াসঙ্গী হিসেবে ছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনায় তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন অনূর্ধ্ব-২০ দলকে নিয়ে। এরপর পেকারম্যানের কোচিং স্টাফ হিসেবে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপেও যান লরেনৎসো। যে দলে লিওনেল মেসির পাশাপাশি রাইটব্যাক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনিও। লরেনৎসোর সঙ্গে স্কালোনির আরও একটি মিল আছে। দুজনই জাতীয় দলের হয়ে ১৩ নম্বর জার্সি পরে খেলেছিলেন।
কোপার ফাইনালে অবশ্য এই মিল-অমিল, গুরু-শিষ্য ও জাতীয়তাবোধের আবেগকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকতে হবে লরেনৎসোকে। যেখানে তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ হবে আর্জেন্টিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটিকে থামিয়ে কলম্বিয়াকে শিরোপা জেতানো। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আর্জেন্টিনার এই দলের নাড়ি-নক্ষত্রের অনেকটাও আবার তাঁর জানা। এখন অদম্য আর্জেন্টিনাকে থামাতে লরেনৎসো ‘বিভীষণ’ হয়ে উঠতে পারেন কি না, সেটা দেখার অপেক্ষায় পুরো কলম্বিয়া।