বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স—ওরা নাস্তানাবুদই হবে! সাম্প্রতিক অতীতের বিশ্বকাপগুলোর দিকে তাকিয়ে এমন কিছু কারও মনে হতে পারে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন মানে যেন হতাশা নিয়ে বিদায়। ফ্রান্সের নিজেদের ইতিহাসই এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জেতার পর পরেরবার প্রথম রাউন্ডে কোনো ম্যাচ না জিতেই বিদায় নিতে হয়েছিল জিনেদিন জিদানদের। এরপর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের কেউই পরেরবার ফাইনালে দূরে থাক সেমিফাইনালও খেলতে পারেনি।
যদি শেষ তিন বিশ্বকাপ বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ইতালি, স্পেন ও জার্মানির কেউই গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। ফ্রান্স কি পারবে এই ইতিহাসের এই ধারা বদলাতে? দিদিয়ের দেশমের নেতৃত্বে ফ্রান্সের যে দলটি বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছে, তাদের সামর্থ্য আছে নতুন গল্প লেখার। ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার সে ধারায় দেশম ব্লুজদের কোন কৌশলে খেলাতে পারেন, সেটি নিয়েই এই বিশ্লেষণ।
তারার মেলা
ফ্রান্সের একাদশ হোক কিংবা ফর্মেশন—সেটা সব সময় বদলাতে থাকে। তারকাবহুল স্কোয়াড থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে ভারসাম্য তৈরিতে কিছুটা বিপাকে পড়তে হবে দেশমকে। তবে ফ্রান্সের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা দলের তারকা খেলোয়াড়দের চোট। ইতিমধ্যে পল পগবা, এনগোলো কান্তে, ক্রিস্তোফার এনকুকুরা দল থেকে ছিটকে গেছেন। দলে তারকা ও বিকল্প খেলোয়াড়ের অভাব না থাকলেও, এভাবে একের পর এক চোট দেশমের পরিকল্পনাকে ওলট-পালট করে দিতে যথেষ্ট।
তবে এই ধাক্কা সামলে নিতে পারলে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ ধরে রাখার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে দেশমের মূল ফর্মেশন হতে পারে এমন। ডিফেন্সে লুকাস হার্নান্দেজ, রাফায়েল ভারানে এবং জুলস কুন্দেকেই হয়তো মূল দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে। আলাদাভাবে বিবেচনা করলে তিনজনই এ সময়ের সেরা ডিফেন্ডারদের তালিকায় থাকবেন।
তবু এই রক্ষণ দলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পুরোপুরি কার্যকর হতে পারবে কি না, সে শঙ্কা রয়েই যায়। সে সঙ্গে চোটের সঙ্গে লড়তে থাকা ভারানের কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। বিকল্প হিসেবে ইউপামেকানো, থিও হার্নান্দেজ ও ইব্রাহিমা কোনাতেদের প্রস্তুত থাকতে হবে। উইং ব্যাক হিসেবে থাকতে পারেন কিংসলে কোমান ও ফেরলান্ড মেন্দি। কান্তে ও পগবা না থাকায় মিডফিল্ডে জুটি বাঁধতে পারেন অরলিয়েন চুয়ামেনি ও আদ্রিয়েন র্যাবিয়ট।
আর ফরোয়ার্ড লাইনে কিলিয়ান এমবাপ্পে ও করিম বেনজেমার সঙ্গে থাকতে পারেন আঁতোয়ান গ্রিজমান। গ্রিজমান অবশ্য কিছুটা নিচের দিকে খেলবেন। সে ক্ষেত্রে উসমান দেম্বেলে ও অলিভিয়ের জিরুকে হয়তো বদলি হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
আক্রমণের নেতৃত্বে এমবাপ্পে-বেনজেমা
ফ্রান্স মূলত পজেশনভিত্তিক ফুটবল খেলতেই বেশি পছন্দ করে। যেখানে মাঠজুড়ে স্বাধীনতা নিয়ে চষে বেড়াতে চায় তারা। ফ্রান্স দলের আক্রমণে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হতে পারে চুয়ামেনিকে। মাঝমাঠের এই খেলোয়াড় দুই লাইনের মাঝে তৈরি হওয়া চাপকে অনায়াসে কমিয়ে দিতে পারেন এবং আক্রমণভাগকে সচল করতে পারেন।
আক্রমণ তৈরিতে ফ্রান্স অবশ্য শুরুতে একটু নড়বড়ে থাকে। সাধারণত তারা ব্যাক থ্রি দিয়ে শুরু করে। তবে এই কৌশলে অনমনীয় হওয়ার বিপদ হচ্ছে চুয়ামেনির মতো খেলোয়াড় দলে না থাকলে বিপাকে পড়তে হতে পারে দেশমের দলকে। পাশাপাশি এমন বিল্ডআপে প্রচুর সাইড পাস দেখা গেলেও এতে সামনে এগোনোর সমস্যা তৈরি হয়। এভাবে আক্রমণে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেন্টার ব্যাক, উইং ব্যাক এবং মিডফিল্ডারদের প্রচুর ঘাম ঝরাতে হয় এবং তাঁদের জন্য অনেক সময় কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ধরনের আক্রমণে পিভটের (রক্ষণ ও আক্রমণভাগের সমন্বয়ের কাজ যিনি করেন) নিচে নেমে এসে দায়িত্ব পালন করার ওপর নির্ভর করতে হয়। দলটি অবশ্য নিজেদের খেলার ধরন প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। তারা যখন ব্যাক-ফোর কৌশল নিয়ে খেলে, তখন ডান পাশের মিডফিল্ডের খেলোয়াড়কে বিল্ডআপে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয়। যদি তাঁর জোন ধরে বল যায়, তবে তাঁকে হয় ব্যাকে এসে যোগ দিতে হয় কিংবা রাইট ব্যাক হিসেবে খেলতে হয়। ফলে প্রকৃতপক্ষে উইং ব্যাকে খেলা খেলোয়াড়টি সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পান।
মিডল থার্ডে ফ্রান্সের খেলার গতি বাড়ানোর কাজ করবেন গ্রিজমান ও বেনজেমার মতো খেলোয়াড়েরা। ব্যক্তিগত শৈলী ও দলীয় সমন্বয়ে তাঁরা এ সময় সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। আক্রমণের এ পর্যায়ে উইং ব্যাকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। তাঁদের মূল কাজটা হয় স্ট্রাইকার এবং অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের জন্য জায়গা বের করে দেওয়া।
দেশম বিশ্বকাপে আক্রমণ তৈরির ক্ষেত্রে কিছু খেলোয়াড়ের নৈপুণ্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করবেন। যেখানে গ্রিজমানের সঙ্গে বেনজেমাকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তাঁর খেলার ধরন দুই-তিন টাচেই ফ্রান্সকে ধারাবাহিক সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। যদিও নিচে নেমে এসে খেলা তৈরিতে খুব বেশি অংশগ্রহণ থাকে না বেনজেমার। তবে অ্যাটাকিং থার্ডে বেনজেমার কিছু মুভমেন্ট ও পায়ের জাদু প্রতিপক্ষ রক্ষণকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে যথেষ্ট।
গোল করার একাধিক পথ খোলা রেখে আক্রমণের ধারা তৈরি করে ফ্রান্স। তবে প্রতিপক্ষের জন্য দুঃস্বপ্ন হতে পারে যখন বাড়তি বিল্ডআপ ছাড়াই মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে চিতার গতিতে প্রতিপক্ষ ডি-বক্সে ঢুকে এমবাপ্পে ফিনিশগুলো করবেন। এমবাপ্পের একক শৈলীর এই গোলগুলোও ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে যথেষ্ট।
আর ডিফেন্স নিয়ে এই ছেলেখেলায় বেনজেমাও কম যান না। প্রতিপক্ষ রক্ষণকে কোণঠাসা করে ফেলা কিংবা গোলকিপারকে নাস্তানাবুদ করে গোল আদায় করে নেওয়ায়ও ওস্তাদ ব্যালন ডি’অরজয়ী তারকা। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে যে কটি দল সেরা আক্রমণ নিয়ে খেলতে যাচ্ছে, ফ্রান্স তার অন্যতম। এখন ছন্দটা ধরে রাখতে পারলেই হয়।
রক্ষণে যেমন ফ্রান্স
ফ্রান্স সাধারণত রক্ষণের ক্ষেত্রে মিড-ব্লক রেখে খেলতে পছন্দ করে। তারা যদি ব্যাক-ফোর কিংবা ব্যাক-থ্রি নিয়ে খেলে, তবে এই কৌশল নানাভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে তিনজন ব্যাক নিয়ে খেললে, তারা ওপরে দিকে আগ্রাসী ফুটবল খেলবে, যাতে প্রতিপক্ষের থার্ডেই বল পুনরুদ্ধার করে নেওয়া যায়। বিশেষ করে এমবাপ্পের মতো গতিময় খেলোয়াড় থাকায় মিড-ব্লক রেখে দারুণভাবে পরিকল্পনা সাজাতে পারেন দেশম। যেখানে পরিকল্পনা থাকে বল নিজেদের থার্ডে পৌঁছানোর আগেই প্রতিপক্ষের আক্রমণ শেষ করে দেওয়ার।
কৌশল বদলে ফ্রান্স যদি ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে শুরু করে, তবে কিছু কিছু বিষয় তাদের বদলাতে হতে পারে। যদিও মৌলিক বিষয়গুলোর খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। এমন পরিকল্পনায়ও তারা জোন ধরে মার্ক করতে চাইবে। এ সময় মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে বাধ্য করবে উইং ধরে আক্রমণে যেতে, যেখানে ফুল ব্যাক অপেক্ষায় থাকবেন আক্রমণ ঠেকানোর জন্য।
তবে ফ্রান্সের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে ডান পাশের উইং ব্যাক পজিশনের খেলোয়াড় কে হবেন, তা নিয়ে। এক বছর ধরে এই পজিশনে বেঞ্জামিন পাভার, জুলস কুন্দে এবং কিংসলে কোমানকে বাজিয়ে দেখেছেন দেশম। যদি বিশ্বকাপে উইং ব্যাক থেকে ঠিকঠাক ফল না আসে, তবে ভুগতে হতে পারে দলটিকে।
হাই-প্রেসিংয়ের ক্ষেত্রে তারা সাধারণত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার দ্বারা চালিত হয়। চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষের পিভটের জন্য জায়গা সংকুচিত করে দিতে, যা নিজেদের ফরোয়ার্ড লাইনের খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণে আরও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
শেষ কথা
চোট ফ্রান্সের বিশ্বকাপ অভিযানে বড় ক্রীড়নক হয়ে উঠতে পারে। তবে দলটিতে এমন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা চাইলে একাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন। মাঠের বাইরে সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা এমবাপ্পে এবং গত বিশ্বকাপ খেলতে না–পারা বেনজেমা—দুজনেরই আছে আলাদাভাবে নিজেদের প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ।
সে সঙ্গে ইতিহাসের ধারা বদলানোর প্রত্যয় তো থাকবেই। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ফেবারিট হিসেবে যাওয়া ফ্রান্সের সুযোগ আছে ট্রফি ধরে রাখার। বাকিটা কেবল মাঠের খেলায় ঠিকঠাক অনুবাদের অপেক্ষা।