প্যারিসে এমবাপ্পের ‘অমরত্ব’ লাভের শেষ সুযোগ
সাত বছর আগের কৈশোর পেরোনোর অপেক্ষায় থাকা এক ফুটবলারকে মোনাকো থেকে নিয়ে আসে পিএসজি। প্রতিবছর দলবদলে এমন প্রচুর উদীয়মান খেলোয়াড় হাতবদল হন। সেসব দলবদলের ভিড়েও কিলিয়ান এমবাপ্পে নামের ১৮ বছর বয়সী সেই ফুটবলারের দলবদল ছিল বিশেষ কিছু। ১৮ কোটি ইউরোতে পিএসজিতে আসা এমবাপ্পে ছিলেন ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি ফুটবলার। এখনো দামি ফুটবলারের এই জায়গাটি এই ফরাসি ফুটবলারের দখলেই আছে। কৈশোর পেরোনোর অপেক্ষায় থাকা কোনো ফুটবলারের এমন দাম দেখে অনেকের চোখ তখন কপালে উঠেছিল।
তবে যাঁরা কাছ থেকে মোনাকোর খেলা অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানতেন পিএসজি মোটেই ভুল খেলোয়াড়ের পেছনে টাকার বস্তা ঢালেনি। তবে এটাও সত্য, ব্যক্তি এমবাপ্পে যতই বল পায়ে আলো ছড়ান, ইউরোপিয়ান সাফল্য ছাড়া পিএসজিতে অমরত্ব পাবেন না। ইউরোপিয়ান সাফল্যের জন্য এমবাপ্পের সামনে এখন মাত্র দুটি ধাপ। যার একটি ধাপের শুরু হবে আজ রাতে। সিগনাল ইদুনা পার্কে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল প্রথম লেগে আজ রাতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মুখোমুখি হবে পিএসজি।
গুরুত্বপূর্ণ এ ম্যাচের আগে বারবার সামনে আসছে ৭ বছর ধরে পিএসজিতে এমবাপ্পের পথচলাটা। পিএসজিতে এসে এমবাপ্পে শুরুতে সঙ্গী হিসেবে পান নেইমারকে। যিনি একই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হিসেবে ২২ কোটি ইউরোতে বার্সেলোনা ছেড়ে এসেছিলেন পিএসজিতে। নেইমার–এমবাপ্পেকে মিলিয়ে সে সময় পিএসজিকে ভাবা হচ্ছিল পরবর্তী সময়ের ফুটবল–রাজা।
মনে হচ্ছিল, ইউরোপিয়ান ফুটবলের রাজদণ্ডটা হাতে ওঠাটা কেবলই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু পিএসজিকে নিয়ে যখন বড় বড় স্বপ্ন বোনা হচ্ছিল, তখন আড়ালে মুচকি হাসছিল নিয়তি। টালিখাতায় তখন লেখা হচ্ছিল ভিন্ন এক গল্প। যে গল্পে ধনসম্পদে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী ক্লাবটির মহাদেশীয় অর্জনের হিসাবে লেখা হলো বিশাল এক ‘শূন্য’। এমনকি নেইমার–এমবাপ্পের পর লিওনেল মেসির মতো আশ্চর্য এক জাদুকর এসেও বদলাতে পারেননি সেই নিয়তি।
মেসির পিএসজিতে আসা ছাড়াও গত সাত বছরে অনেক কিছু বদলেছে। মেসি নিজেও ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। জাতীয় দলের শিরোপা খরা কাটিয়ে জিতে নিয়েছেন বিশ্বকাপ ট্রফিও। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও এখন ফুটবল খেলেন সৌদি আরবে। লিভারপুল ৩০ বছর পর এবং নাপোলি ৩৩ বছর পর লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধার করেছে। কিন্তু যা হয়নি তা হলো পিএসজির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। সর্বোচ্চ অর্জন ২০১৯–২০ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ফাইনালে হেরে রানার্সআপ হওয়া।
এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে এমবাপ্পের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে যত কথা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কথা হয়েছে তাঁর রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়া নিয়ে। যারা অবশ্য ২০১৭ সালেও তাঁকে কিনতে চেয়ে পারেনি। তবে ২০২১ সাল থেকেই এমবাপ্পের দলবদল যেন অমীমাংসিত এক থ্রিলার সিরিজ! প্রায় প্রতিবার দলবদলে একপর্যায়ে মনে হয়, এমবাপ্পের পিএসজি ছেড়ে রিয়ালে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনার সব পারদ উল্টে দিয়ে সেই পিএসজিতেই থেকে যান এমবাপ্পে।
এবার অবশ্য এমবাপ্পে–পিএসজি থ্রিলার সিরিজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। এমবাপ্পেকে ছাড়া এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করে দিয়েছে পিএসজি। দলবদলের খবর সামনে আসার পর লিগে এমবাপ্পেকে বেঞ্চে রেখেই নিজের ভবিষ্যৎ–কৌশল গুছিয়ে নিচ্ছেন কোচ লুইস এনরিকে। যিনি সরাসরিই বলেছেন, এমবাপ্পেকে ছাড়া তাদের এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে।
চ্যাম্পিয়নস লিগে অবশ্য এমবাপ্পেকে বাদ দিয়ে ভাবার দুঃসাহস দেখাননি এনরিকে। তাঁর ভালোই জানা, এমবাপ্পের মতো ম্যাচ–উইনারকে বেঞ্চে রেখে ইউরোপিয়ান শিরোপা জেতার স্বপ্ন শুধুই আকাশ–কুসুম কল্পনা। সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বার্সেলোনার বিপক্ষে জোড়া গোল করে সেই প্রমাণও দিয়েছেন এমবাপ্পে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, বড় মঞ্চে কেন তিনি অপরিহার্য।
এমবাপ্পের সামনে এখন চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে পিএসজিকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার। পিএসজি ছাড়ার আগে এটিই তাঁর জন্য শেষ সুযোগ। এবার নয়তো আর কখনোই নয়। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিতে পিএসজি–অধ্যায় শেষ করার অর্থ তো ব্যর্থতাই। যতই তিনি পিএসজির ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন কিংবা ছয়টি লিগ শিরোপা জিতুন, ক্লাবটিতে তাঁর সাফল্য–ব্যর্থতাকে মাপা হবে ইউরোপিয়ান সাফল্যের মানদণ্ডে।
নেইমার–এমবাপ্পেদের পুরো প্রজেক্টটিই মূলত তৈরি করা হয়েছিল ইউরোপিয়ান সাফল্যকে সামনে রেখে। যেকোনো মূল্যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাই ছিল মূল লক্ষ্য। এ জন্য প্রায় এক দশকে ১ বিলিয়নের বেশি অর্থ খরচ করেছে ক্লাবটি। নেইমার–মেসির মতো সেরা তারকাদের এনে জড়ো করেছিল। বিপরীতে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। এরই মধ্যে ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে চেপে ক্লাব ছেড়ে গেছেন মেসি–নেইমার। বাকি আছেন কেবল এমবাপ্পে। এবার যদি সাফল্য না আসে, তবে এমবাপ্পের পিএসজি অধ্যায় তো ব্যর্থ হবেই, পাশাপাশি গোটা প্রজেক্টির ঠাঁই হবে অন্ধকার এক কুঠুরিতে।
আর শেষ পর্যন্ত এমবাপ্পে যদি ট্রফি উঁচিয়ে বিদায় নিতে পারেন, তবে প্যারিসের ক্লাবটিতে অমরত্ব নিশ্চিত হবে তাঁর। মর্যাদায় এমবাপ্পে তখন ছাড়িয়ে যাবেন আইফেল টাওয়ারের উচ্চতাকেও। পাশাপাশি প্রজেক্টটিও তখন সফল সমাপ্তির মুখ দেখবে।
দলীয় এ সাফল্য ব্যক্তি এমবাপ্পের অন্য এক অপূর্ণতাও পূরণ করতে পারে। হ্যাঁ, ব্যালন ডি’অরের কথাই বলা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে লিগ শিরোপা নিশ্চিত করেছে পিএসজি। সুযোগ আছে চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ট্রেবল জেতার। এরই মধ্যে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৪ ম্যাচে ৪৩ গোল করেছেন এ পিএসজি ফরোয়ার্ড।
মনে রাখা ভালো, লিগে শেষ দিকে এসে ৯০ মিনিট নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি বিশ্বকাপজয়ী এই ফরোয়ার্ড। সব মিলিয়ে বিদায়বেলায় এমবাপ্পের সামনে দারুণ সুযোগ আছে অর্জনের ঝুলিটা পূর্ণ করে নেওয়ার, যা মাদ্রিদের বিমানবন্দরে নামার আগেই এমবাপ্পের ক্যারিয়ারের বৃত্তটাকেও সাফল্যের রেখায় মিলিয়ে দেবে। যেখান থেকে হিসাবের নতুন এক টালিখাতাও খুলতে পারবেন বিশ্বজয়ী এ ফুটবলার।