নেইমারের ক্যারিয়ারের ১৫ বছর—কোন ছবিটা ভাসবে সবার মনে
বড় বেরঙিন আজকাল
কাছাকাছি কোনো রং পাই না
তাই দিতে পারি না কিছু
কিছুই রাঙানো হলো না নয়তো
আগামীর রঙে ছোপাতাম হয়তো
এই মলিন আর এ ধূসর পথ চাওয়া।
কবির সুমনের একটি গানের কয়েকটি লাইন এ রকম। ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারের কবির সুমনের গান শোনার কথা নয়। কিন্তু চোটের কারণে মাঠের বাইরে থাকা নেইমারের মনের ভাবনাটা কি অনেকটা এ রকমই! চোট, বিতর্ক, ছন্দহীনতা, ইউরোপকে বিদায় বলে দিয়ে সৌদি আরবের ফুটবলে নাম লেখানো—সব মিলিয়ে ফুটবলের রঙে রঙিন নেইমারের দিনগুলো এখন অনেকটাই বেরঙিন হয়ে পড়েছে!
মার্চ মাস এলে এমন একটা ভাবনা নেইমারের মনের আঙিনায় আরও বেশি করে হানা দেওয়ারই কথা। আজ থেকে ১৫ বছর আগের এক মার্চে ব্রাজিলের সাও পাওলোর ক্লাব সান্তোসের হয়ে পেশাদার ফুটবলে আগমন অমিত প্রতিভাবান এক কিশোরের। নেইমার নামের সেই কিশোর নিজের ক্যারিয়ার আর সান্তোসের ঐতিহ্য ছুপিয়েছেন নানান রঙে। ১৯৬৩ সালে পেলের পর নেইমারই প্রথম লিবার্তাদোরেস কাপ জিতিয়েছেন সান্তোসকে। পেলের সাবেক ক্লাবে খেলেছেন, পেলের অর্জনও ছুঁয়েছেন। ফুটবলে তাঁর উঠে আসার দিনগুলোয় খেলার ধরন-টরন মিলিয়ে তাঁকে অনেকেই তুলনা করতেন পেলের সঙ্গে। দেড় দশক পর সেই নেইমারের ক্যারিয়ার এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
কবির সুমনেরই একটা গানে আছে—কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়...প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা। নেইমারের বেলায় যদি এটাকে এভাবে বলা হয়—কত বছর খেললে তবে সফল ফুটবলার হওয়া যায়...। প্রশ্নটা এখানে সহজই, কিন্তু নেইমারের ক্ষেত্রে উত্তর আসলে জানা নেই বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমী এবং তাঁর ভক্তদের! ২০০৯ সালের সেই মার্চেই পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথম গোল পেয়েছেন নেইমার। দেড় দশক পর রোনালদো, রোমারিও, জিকো, পেলেদের ছাড়িয়ে তিনি ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে জাতীয় দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
শুধু গোল করাই নয়, গোল করানো এবং দুর্দান্ত ড্রিবলে মাঠের সবুজে ফুটবল-আলপনা আঁকাতেও নেইমার অনন্য। সান্তোসের সেই দিনগুলোয় ফিরে তাকিয়ে কেউ যদি নেইমারকে দেখার চেষ্টা করেন, তাহলে কী দেখবেন? প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ওপর দিয়ে বল নিয়ে যাচ্ছেন লিকলিকে এক কিশোর, কখনো নিজের পিঠে বল নিয়েও অনেকটা দূর এগিয়ে গেছেন তিনি। এর সঙ্গে ফুটবলের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ আর সৌন্দর্য চোখধাঁধানো ড্রিবলিং তো আছেই, আছে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে নাটমেগ করা এবং অবিশ্বাস্য লাগা সব কারিকুরি। সেসব দেখতে দেখতে যে কেউই হয়তো বলে উঠবেন—এ ছেলে তো মনের আনন্দে ফুটবল খেলে, এ তার পেশা নয়, এ তার খেলা নয়; এ তো তার পুতুল খেলা!
সান্তোস-পর্ব শেষ করে নেইমার ব্রাজিলের পাট চুকিয়ে পাড়ি জমান ইউরোপে, নাম লেখান বার্সেলোনায়। সেখানেও ভয়ালসুন্দর এক নেইমারকে দেখেছে ফুটবল-বিশ্ব। কিন্তু সেই বার্সেলোনাতেই আবার কখনো কখনো নেইমারের ছায়াকেও দেখা গেছে। এরপর পিএসজি-পর্ব আর এখন ইউরোপ থেকেই অন্তর্ধান। সব মিলিয়ে অনেকের কাছেই নেইমার এক হতাশার নাম। যা কিছু তাঁর কাছে চাওয়া ছিল, সেটা যে তিনি মেটাতে পারেননি। এটাই-বা কতটা ঠিক?
ফুটবল যদি নিছক সংখ্যার খেলা হতো, তাহলে আগে থেকেই সব বলে দেওয়া যেত। খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার পথ হয়তো এগিয়ে যেত বীজগণিতের মতো সূত্র মেনে। অঙ্কের সব অলিগলি পেরিয়ে উত্তরটা মিলে যেত কাঁটায় কাঁটায়। হয়ে যেত লেটার মার্কস, কখনো কখনো ১০০-তে ১০০! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পরিসংখ্যান মায়াবি বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। সংখ্যা কখনোই কোনো খেলোয়াড় বা কোনো ঘটনার পরিপূর্ণ গল্পটা বলতে পারে না। এই যেমন পেলে আর তাঁর অর্জনকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলে ক্যারিয়ারে ফুটবলসম্রাটের ১০০০-এর বেশি গোলের পরিসংখ্যানের বিতর্কে। পেলে বা তাঁর মতো গ্রেট খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারের সারমর্ম তো আসলে লুকিয়ে থাকে বড় আর দলের ভাগ্যনির্ধারণী ম্যাচে এবং শিরোপা জয়ে। একজন খেলোয়াড়ের নামডাক তৈরি হয় তো এসবেই।
প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে নেইমারের রেকর্ড তো খারাপ নয়! এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে থাকবে বিশ্বকাপে ১৩ ম্যাচ খেলে করা ৮ গোল। এ ছাড়া কোপা আমেরিকায় ১২ ম্যাচ খেলে ৫টি, ২০১৩ কনফেডারেশন কাপে ৪ আর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ২৮ ম্যাচে ১৬ গোল।
১৫ বছরের ক্যারিয়ারে নেইমার-ঝলক অনেক দেখা গেছে। চোখজুড়ানো শিল্পিত ফুটবল তিনি আরও অনেক মহান খেলোয়াড়ের মতোই উপহার দিয়েছেন। কখনো কখনো বড় ম্যাচে আপন আলোয় জ্বলে উঠেছেন। সেই আভায় পুরে খাক হয়েছে প্রতিপক্ষ। এই যেমন ২০১৬-১৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোতে পিএসজির বিপক্ষে বার্সেলোনার দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। ৪-০ গোলে পিছিয়ে থেকে ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগ খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। সেই ম্যাচে দুটি গোল করে এবং ৩টি গোল করিয়ে নেইমার একাই বার্সাকে তুলেছেন কোয়ার্টার ফাইনালে। সেই ম্যাচে লিওনেল মেসিও যেন নেইমারের অদম্য সেই পারফরম্যান্সের মুগ্ধ দর্শক হয়েই ছিলেন! এরপরও বলতে হবে নেইমারের অর্জনের খেরো খাতাটা মোটেই সমৃদ্ধ নয়। সেখানে বার্সেলোনার হয়ে একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় ছাড়া সেভাবে বলার কিছু কই! ব্যক্তিগত পুরস্কারের ডালাটা তো একেবারেই শূন্যই বলতে পারেন।
তবে নেইমারের এখনো তাঁর খেরো খাতায় অর্জনের পাণ্ডুলিপি সমৃদ্ধ করে নেওয়ার সময় আছে। এটা ঠিক যে সেই খেরো খাতায় অর্জনের ওজনটা কখনোই পেলের মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পেলে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন। তিনটির সঙ্গেই গল্প জড়িয়ে। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল এবং নিজের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের আগে চোটে পড়েছিলেন পেলে। সতীর্থদের একচেটিয়া ভোট পেয়ে হাঁটুর চোট নিয়ে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে সুইডেনে যেতে পারেন তিনি। ১৭ বছর বয়সে জেতেন সেই বিশ্বকাপ। চিলিতে ১৯৬২ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার সময় পেলে ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু বিশ্বকাপের মাঝে চোটে পড়েন। তবে বিশ্বকাপ শেষ করেছেন শিরোপা জয়ের হাসিতে।
মেক্সিকোতে ১৯৭০ বিশ্বকাপে তো পেলের যাওয়ারই কথা ছিল না। তখন তাঁর মনের অবস্থা অবসর নিই-নিই! ১৯৬৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার পর জাতীয় দলের হয়ে আর কোনো ম্যাচ খেলবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে তাঁকে আবার দলে নেওয়া হয়। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলার পর মেক্সিকোতেও যান। আর ৩০ বছর বয়সী পেলে ফেরেন ইতিহাস হয়ে, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়ে।
নেইমারের বয়স এখন ৩২ বছর, পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার ১৫ বছরের। ব্রাজিলের হয়ে খেলছেন ১৪ বছর। দীর্ঘ এই যাত্রায় কী পেয়েছেন নেইমার? ২০১৬ সালের অলিম্পিকে সোনার পদক জিতেছেন। যে পদক পেলে বা ম্যারাডোনার মতো কিংবদন্তিরা কখনো জেতেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অলিম্পিক পদক সিনিয়র কোনো ট্রফি বা শিরোপা হিসেবে বিবেচিত হয় না। নেইমার ২০১৩ সালের কনফেডারেশন কাপ জিতেছেন, যেটা এখনো দ্বিতীয় সারির টুর্নামেন্ট হিসেবেই বিবেচিত। এ ছাড়া নেইমার যে ৭৯ গোল নিয়ে ব্রাজিলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা, তার ৪৬টিই এসেছে প্রীতি ম্যাচে।
নেইমারের ভক্তরা অবশ্য তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়ের পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন—এতে নেইমারের কী দোষ! তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা এমন সময়ে শুরু হয়েছে, প্রায় চার বছর তিনি শুধু প্রীতি ম্যাচই খেলেছেন। নেইমারের ব্রাজিল দলে অভিষেক ২০১০ সালের বিশ্বকাপের পর। ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ব্রাজিল। স্বাগতিক হিসেবে মূল পর্বে অটো সুযোগ পাওয়া ব্রাজিলকে তাই বাছাইপর্ব খেলতে হয়নি। ওই সময়টাতে তারা শুধু প্রীতি ম্যাচই খেলেছে। তাঁরা বলতে পারেন, প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে নেইমারের রেকর্ড তো খারাপ নয়! এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে থাকবে বিশ্বকাপে ১৩ ম্যাচ খেলে করা ৮ গোল। এ ছাড়া কোপা আমেরিকায় ১২ ম্যাচ খেলে ৫টি, ২০১৩ কনফেডারেশন কাপে ৪ আর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ২৮ ম্যাচে ১৬ গোল।
বাস্তবতা হচ্ছে, ‘আপনি কী ছাপ রেখে গেলেন’—এই প্রশ্নে ‘কী হতে পারত’-এর কোনো জায়গা নেই! নেইমারের যত চোট, তার কিছুর দায় তাঁর কাঁধেও বর্তায়। বিষয়টা আলোচনার জন্য খুব একটা সুখকর নয়। তবে এটা আলোচনায় না নিলে নেইমারের গল্পের অন্দরমহলে পৌঁছানোও হয়তো সম্ভব হবে না।
নেইমারের ভক্তরা বিশ্বকাপে তাঁর চোটের ইতিহাসও টেনে আনতে পারেন। ২০১৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার হুয়ান জুনিগার ভয়ানক এক ট্যাকলের শিকার হয়ে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হয় নেইমারকে। পরে আর খেলতে তো পারেনইনি, করাতে হয় অস্ত্রোচার। ফলে লম্বা সময় থাকতে হয় মাঠের বাইরে। ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলেছেন চোটের থেকে উঠে এসে। তারপরও ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার আগপর্যন্ত ভালোই খেলেছেন নেইমার। ভালো খেলেছেন ২০২২ বিশ্বকাপেও। এবারও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। ক্রোয়েশিয়ার কাছে বিদায় নেওয়ার আগে শেষ মুহূর্তের দুর্দান্ত এক একক নৈপুণ্যের গোলে ব্রাজিলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন নেইমারই। যদিও সেই লিড শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি তারা। বিদায় নিতে হয় টাইব্রেকারে হেরে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ‘আপনি কী ছাপ রেখে গেলেন’—এই প্রশ্নে ‘কী হতে পারত’-এর কোনো জায়গা নেই! নেইমারের যত চোট, তার কিছুর দায় তাঁর কাঁধেও বর্তায়। বিষয়টা আলোচনার জন্য খুব একটা সুখকর নয়। তবে এটা আলোচনায় না নিলে নেইমারের গল্পের অন্দরমহলে পৌঁছানোও হয়তো সম্ভব হবে না।
কোনো খেলোয়াড় যখন ফাউলের শিকার হন এবং চোটে পড়েন, তাঁকেই দোষ দেওয়াটা একটু হাস্যকরই শোনাবে। এর দায় অবশ্যই যিনি ফাউল করেন, তাঁর ওপরই বর্তাবে। কিন্তু শরীরনির্ভর একটি খেলায় প্রতিভাবান ও সেরা খেলোয়াড়দের ফাউলের শিকার হতেই হবে। ফুটবলের এই আধুনিক যুগে তো তাও পেলে-ম্যারাডোনাদের চেয়ে মেসি-নেইমাররা মাঠে বেশি নিরাপত্তা পান। এ ক্ষেত্রে ম্যারাডোনার কথাই বলা যেতে পারে। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি এত ফাউলের শিকার হয়েছেন যে বাংলাদেশে একবার তাঁর একটি পোস্টার বেরিয়েছিল এ রকম—ম্যারাডোনাকে ফাউল করে মাঠে ফেলে দেওয়ার পাশে লেখা; ওরা আমাকে এত মারে কেন!
নেইমারের মাথায় হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছিল—মেসির ছায়ায় থেকে কীভাবে তিনি ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার জিতবেন। তাই তিনি মেসির ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজেকে ‘সূর্য’ বানিয়ে আলাদা একটি সৌরজগৎ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের গন্তব্য হিসেবে এমন একটি লিগকে বেছে নিয়েছিলেন, যেখানকার অতিমাত্রার শরীরনির্ভর খেলা তাঁর ধরনের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। তাই পিএসজিতে গিয়ে তিনি যে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি, সেটা মোটেই বিস্ময়কর বলা যাবে না।
ফুটবলে যাঁদের প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসেবে ধরা হয়, যাঁরা সময়ের সেরাদের মধ্যে পড়েন, তাঁদের স্কিলের একটা অংশ হওয়া উচিত নিজেকে ফাউলের হাত থেকে বাঁচানো। এটা অনেকটা আগেকার যুগের স্ট্রিট-ফুটবলারদের মতো। তারা জানে কখন ড্রিবল করতে হবে, কখন বল থামাতে হবে বা কখন এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রাজিলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার রোনালদো নাজারিওর কথাই ধরা যেতে পারে। বক্সের আশপাশে ফাউলের শিকার তাঁকে খুব কমই হতে দেখা গেছে। গতি আর দুর্দান্ত স্কিলের কারণে তাঁকে ডিফেন্ডাররা নিজেদের আওতায় পেলেই না ফাউল করবেন!
নেইমার সে অর্থে স্ট্রিট-ফুটবলার নন। তাঁর বেড়ে ওঠা ফুটসাল খেলে এবং রেফারির মাধ্যমে সুরক্ষা পাওয়া খেলোয়াড়দের সংস্কৃতিতে খেলে অভ্যস্ত। নেইমারের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখলে একটি বিষয় স্পষ্ট হবে—তিনি প্রায়ই রেফারিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তাঁকে অকারণেই ফাউল করা হচ্ছে। কখনো কখনো তিনি বল নিয়ে এগিয়ে না গিয়ে ইচ্ছে করে ফাউলের শিকার হন। ফুটবল মাঠে এটা কখনোই নিজেকে রক্ষা করার ঢাল হতে পারে না। এটাকে চূড়ান্ত ফুটবল-দক্ষতার অংশও বলা যায় না। নেইমারের খেলার আরেকটি বাজে ধারা এ রকম—অর্থহীন ফ্রি-কিক আদায় করে নিতে তিনি কখনো কখনো অকারণেই নিচে নেমে খেলেন।
এটা ঠিক যে দুই যুগের তুলনা হয় না। কিন্তু সব মিলিয়ে এটা বলাই যায় পেলেদের যুগে নেইমার আসলে ফুটবলটা খেলতেই পারতেন না। আধুনিক এই ফুটবলের সঙ্গে পেলেদেরও হয়তো কোথাও কোথাও মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়তো হতো। কিন্তু নেইমার এ যুগের মানুষ, যেখানে ফুটবলকে বিনোদনের বড় একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলা হয়েছে। আর সেই জগতে নেইমারের বাবা তাঁকে নিজের প্রকল্পের অংশ হিসেবে তাঁর যেমন ইচ্ছে তেমন করে গড়ে তুলেছেন!
এখন কেউ বলতে পারেন, এই প্রক্রিয়াটা নেইমারকে শেষ করে দিয়েছে, নষ্ট করেছে এবং তাঁকে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে সমস্যায় ফেলেছে। নেইমারের ক্লাব ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল ২০২০ সালে পিএসজির হয়ে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। সেখানে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন এবং সেই ম্যাচের চাপটা তাঁর জন্য একটু বেশিই মনে হয়েছে। যার মানে, ফুটবল-দক্ষতা, কারিকুরি আর গোল করার প্রতিভায় খামতি না থাকলেও চাপ সামলে মাথা ঠান্ডা রেখে ভালো খেলা উপহার দেওয়ার দীক্ষাটা তিনি পাননি। শুধু ফুটবল নয়, যেকোনো খেলায় বা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই এটা বেশ জরুরি একটা বিষয়।
কালের বিবর্তন এবং ভুলের আবর্তনে ঘুরতে ঘুরতে নেইমার এখন ইউরোপের ফুটবলেরই বাইরে। নাম লিখিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলালে। যেখানে তাঁর ব্যক্তিগত স্বপ্ন—ব্যালন ডি’অর জয় আর কখনোই সম্ভব নয়। নেইমার তাই এখন সামষ্টিক সাফল্যের দিকে নজর দিতে পারেন, যে স্বপ্নের হিমালয় বিশ্বকাপ জয়।
নেইমারের ভক্তরা বলতেই পারেন, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নেইমারের ক্ষেত্রে দুটি মানদণ্ড নির্বাচন করে দেওয়া হয়েছে—একটি বিশ্বকাপ, আরেকটি ব্যালন ডি’অর। যার মানে শুরু থেকেই বিপুল চাপ তাঁর কাঁধে। অথচ ব্রাজিলের কেউ সর্বশেষ ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ২০০৭ সালে, সেটা কাকা। ফুটবলের মতো একটা সমষ্টিগত খেলায় ব্যক্তিগত পুরস্কার জিততে একা কিছু করে দেখানোর তাগিদ তাই থাকেই। সেই তাগিদ থেকেই নেইমার ‘অকালে’ই বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে নাম লিখিয়েছিলেন ২০১৭ সালে।
নেইমারের মাথায় হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছিল—মেসির ছায়ায় থেকে কীভাবে তিনি ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার জিতবেন। তাই তিনি মেসির ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজেকে ‘সূর্য’ বানিয়ে আলাদা একটি সৌরজগৎ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের গন্তব্য হিসেবে এমন একটি লিগকে বেছে নিয়েছিলেন, যেখানকার অতিমাত্রার শরীরনির্ভর খেলা তাঁর ধরনের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। তাই পিএসজিতে গিয়ে তিনি যে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি, সেটা মোটেই বিস্ময়কর বলা যাবে না।
কালের বিবর্তন এবং ভুলের আবর্তনে ঘুরতে ঘুরতে নেইমার এখন ইউরোপের ফুটবলেরই বাইরে। নাম লিখিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলালে। যেখানে তাঁর ব্যক্তিগত স্বপ্ন—ব্যালন ডি’অর জয় আর কখনোই সম্ভব নয়। নেইমার তাই এখন সামষ্টিক সাফল্যের দিকে নজর দিতে পারেন, যে স্বপ্নের হিমালয় বিশ্বকাপ জয়। এটা তো বলাই যায়, গল্পের এখনো সমাপ্তি হয়নি। পাণ্ডুলিপি সম্পন্ন করা এখনো বাকি আছে। এই যেমন লিওনেল মেসির কথাই ধরুন। বিশ্বকাপ না জিতলে ক্যারিয়ারের বাকি সব—বার্সেলোনার হয়ে ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার ৮টি ব্যালন ডি’অর জয়, সবই ম্লান হয়ে যেত! সেই মেসিই ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে জিতলেন বিশ্বকাপ। শেষ পর্যন্ত মানুষ মেসির যে ছবিটা কল্পনার রংতুলি দিয়ে মনের ইজেলে এঁকে রাখবেন, সেটি কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর তাঁর ট্রফি উঁচিয়ে ধরা বা বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফেরার পথে হোটেলে বিশ্বকাপের সোনালি ছবি নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা!
তিনি নিজে যদি চান এবং ভাগ্য সহায় থাকলে ফিট থাকেন, তাহলে আরেকটা বিশ্বকাপ নেইমার খেলতেই পারেন, হয়তো দুটিও সম্ভব। কে জানে, সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরা মায়াবি ছবিতে লেখা হবে কি না নেইমারের গল্পের শেষ অধ্যায়!
পেলে বা ম্যারাডোনার কোনো ছবির কথা যদি বলা হয়, তাহলে ফুটবলপ্রেমীদের মানসপটে কী ভেসে উঠবে? পেলের বেলায় ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনাল জয়ের পর সতীর্থেরর আলিঙ্গনে হাত উঁচিয়ে তিনি আর ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে ছিয়াশির বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরে সতীর্থদের কাঁধে ‘ফুটবল-ঈশ্বর’। এবার যদি নেইমারের কথা বলি? কেউ বলবেন, তাঁদের চোখে ভেসে ওঠে রাশিয়া বিশ্বকাপে মাঠে অহেতুক ডাইভ দিয়ে গড়াগড়ি খাওয়া এক ফুটবলারকে। কারও চোখে হয়তো ভেসে উঠবে সান্তোসের নেইমারের ছবি—কখনো তিনি নাটমেগ করছেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে, কখনো আবার বিদ্যুতের গতিতে ড্রিবলিং করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি!
মেসির গল্পে যেমন শেষবেলায় এসে লেখা হয়েছে নতুন অধ্যায়, নেইমারের গল্পেও আরও অধ্যায় লেখা হয়তো বাকি। এখনই নেইমারের মতো একজন তুমুল প্রতিভাবানকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া ভুল হবে! ক্যারিয়ারের বয়স ১৫ বছর হয়ে গেছে। এটা ঠিক যে এখন আর শুরুর অর্ধে নেই তাঁর ক্যারিয়ার, ঢুকে গেছে শেষের অর্ধে। কিন্তু তিনি নিজে যদি চান এবং ভাগ্য সহায় থাকলে ফিট থাকেন, তাহলে আরেকটা বিশ্বকাপ নেইমার খেলতেই পারেন, হয়তো দুটিও সম্ভব। কে জানে, সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরা মায়াবি ছবিতে লেখা হবে কি না নেইমারের গল্পের শেষ অধ্যায়!
নেইমারের ভক্তরাও তো চাইবেন—রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে/ তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে।