এশিয়ান কাপের ডাগআউটে তারার মেলা
গত আগস্টের শুরুর দিকের ঘটনা। ইতালিকে ইউরো জেতানো কোচ রবার্তো মানচিনিকে দুটি বাড়তি দায়িত্ব দেয় দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। জাতীয় দলের পাশাপাশি অনূর্ধ্ব–২০ ও অনূর্ধ্ব–২১ দলের সমন্বয়ক বানিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পুরো ইতালিয়ান ফুটবলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে।
কিন্তু সপ্তাহখানেক পর চাকরিটাই ছেড়ে দেন মানচিনি। গুঞ্জন ওঠে, সৌদি আরবে যাবেন বলেই ইতালি ফুটবলের ‘সর্বময় ক্ষমতা’ ছেড়েছেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে সেটি অস্বীকার করলেও দুই সপ্তাহ পর গুঞ্জনই সত্য হয়ে সামনে আসে। সর্বশেষ ইউরোর ট্রফি হাতে তোলা কোচ আড়াই বছরের ব্যবধানে এখন এশিয়ান কাপের ডাগআউটে!
শুক্রবার কাতারে শুরু হতে যাওয়া এশিয়ান কাপে শুধু মানচিনিই নন, বিশ্ব ফুটবলের ‘নামীদামি’ কোচ থাকছেন বেশ কয়েকজনই।
এঁদের মধ্যে দলকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তোলা কোচ যেমন আছেন, আছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তোলা, ইউরোপের শীর্ষ লিগে ট্রফি জেতানো এবং বর্ষসেরা কোচরাও। যাঁদের উপস্থিতি এশিয়ান কাপের মাঠের তারকাদের চেয়ে কোনো অংশ কম তো নয়ই, ক্ষেত্রবিশেষ তাঁরাই ম্যাচের বড় তারকা। মানচিনি, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান, পাওলো বেন্তো, হুয়ান পিজ্জি, হেক্টর কুপার আর ফিলিপে ত্রোসিয়ারদের সমাগম ইঙ্গিত দিচ্ছে এমনই আলোকিত ডাগআউটের।
৫৯ বছর বয়সী মানচিনির কথাই ধরা যাক। শুধু ইতালিকে ২০২০ ইউরো জিতিয়েছেন তা–ই নয়, ক্লাব ফুটবলেও সাবেক এই ফুটবলার বেশ সফল। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত টানা তিন মৌসুমে সিরি আ জিতেছে মানচিনির অধীনে খেলা ইন্টার মিলান। আবার ম্যানচেস্টার সিটি ইতিহাসের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাও (২০১১–১২) এসেছিল তাঁর হাত ধরেই।
নাটকীয়ভাবে সৌদি আরবের কোচ হওয়া মানচিনি স্বর্ণালি এক ক্যারিয়ার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সৌদি আরবে। ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেওয়া সৌদি আরব এশিয়ান কাপের অন্যতম ফেবারিট। মানচিনির সৌদি অধ্যায়ের শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি। আগস্টের শেষ দিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম চার ম্যাচে ছিলেন জয়হীন। যদিও এশিয়ান কাপের আগের শেষ তিন ম্যাচে দলটি কোনো গোল হজম না করে ভালো কিছুর ইঙ্গিতও দিচ্ছে।
এশিয়ান ফুটবলে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য মানচিনির চেয়ে কিছুটা বেশি সময় পেয়েছেন ক্লিন্সমান। খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৯০ বিশ্বকাপ জেতা এই স্ট্রাইকার ২০০৬ আসরে জার্মানিকে তুলে নিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। নিজ দেশের জাতীয় দলের বাইরে ক্লিন্সমান কোচিং করিয়েছেন বায়ার্ন মিউনিখ এবং যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলকে। ৫৯ বছর বয়সী এই জার্মান কিংবদন্তি দক্ষিণ কোরিয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। হিউন মিন–সন, কিম মিন–জেদের দল ক্লিন্সমানের অধীনে এখন পর্যন্ত ১১ ম্যাচ খেলে জিতেছে ৬টিতে, ড্র করেছে ৩টিতে।
ক্লিন্সমান যে জায়গায় আছেন, গত ডিসেম্বরে সেটিই ছেড়ে গিয়েছিলেন পাওলো বেন্তো। ২০১৪ বিশ্বকাপে পর্তুগালের দায়িত্ব সামলানো এই কোচ ২০২২ আসরে ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ডাগআউটে। গ্রুপের শেষ খেলায় পর্তুগালকে হারিয়েই শেষ ষোলোয় জায়গা করে দক্ষিণ কোরিয়া। ব্রাজিলের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার পর নিজ থেকেই চাকরি ছেড়ে যান বেন্তো। এবার এশিয়ান কাপে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দায়িত্বে। দেখার বিষয়, একবারই মাত্র এশিয়ান কাপের ফাইনালে (১৯৯৬, রানার্সআপ) খেলা দলটি বেন্তোর অধীনে কত দূর যায়? ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের ৬৪ নম্বরে থাকা আমিরাত সর্বশেষ আসরে সেমিফাইনাল খেলেছিল।
কখনো এশিয়ান কাপে দ্বিতীয় রাউন্ডের গণ্ডি পেরোতে না পারা বাহরাইনও এবার খেলবে ‘হাই–প্রোফাইল’ কোচ নিয়ে। গত জুলাইয়ে দলটির দায়িত্ব নিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ হুয়ান পিজ্জি, যিনি স্পেনের হয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন, বার্সেলোনার হয়ে জিতেছিলেন লা লিগাও। কোচিং ক্যারিয়ারে এশিয়ান ফুটবলকে তাঁর ভালোই চেনা। ২০১৭–১৯ মেয়াদে ছিলেন সৌদি আরবের কোচ। পিজ্জির কোচিং–বৃত্তান্তে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়—চিলিকে ২০১৬ কোপা আমেরিকায় জেতানো।
আর্জেন্টিনারই আরেক কোচ হেক্টর কুপার আছেন সিরিয়ার দায়িত্বে। ৬৮ বছর বয়সী এই কোচের মধ্যে আছে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া—তিন মহাদেশের জাতীয় দল ও ক্লাব সামলানোর অভিজ্ঞতা। গত ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়া কোচের চাকরি নেওয়া কুপার ২০১৭ আফ্রিকা কাপ অব নেশনসে মিসরকে রানার্সআপ বানিয়েছিলেন। ছিলেন ২০১৮ বিশ্বকাপের ডাগআউটেও। তারও আগে কুপারের অধীন খেলা ভ্যালেন্সিয়া ২০০০ ও ২০০১ সালে টানা দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলেছিল (দুবারই রানার্সআপ)। এবার লা লিগার বর্ষসেরা কোচ হওয়ার পাশাপাশি উয়েফা বর্ষসেরা কোচও হয়েছিলেন তিনি।
ভিয়েতনাম ডাগআউটের কোচ ফিলিপে ত্রোসিয়ারও বেশ অভিজ্ঞ। ১৯৮৩ সাল থেকে কোচিং করিয়ে আসা এই ফরাসি বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আফ্রিকা ও এশিয়ায়। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইভরি কোস্ট, মরক্কোর পাশাপাশি এশিয়ার জাপান, কাতার এবং বেশ কিছু চীনা ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন। চার দশকের কোচিংয়ে ত্রোসিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্য জাপানকে ২০০০ সালে এশিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন করা। একই দলকে পরের বছর ফিফা কনফেডারেশনস কাপে রানার্সআপ বানিয়েছিলেন।
সব মিলিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, অর্ধডজনের মতো ক্লাবই সাফল্য পেতে ‘নামি কোচ’ নিয়ে এশিয়ান কাপে নামছে। এখন মাঠে কে কতটা অনূদিত করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।