ইলকায় গুন্দোয়ান এখন বার্সেলোনার। গতকাল তাঁর সঙ্গে চুক্তির খবর জানিয়েছে কাতালান ক্লাবটি। এর মধ্য দিয়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে জার্মান মিডফিল্ডারের ৭ বছরের অধ্যায়ের অবসান ঘটল। ২০১৬ সালে পেপ গার্দিওলা কোচ হয়ে এসে প্রথম সই করিয়েছিলেন গুন্দোয়ানকে। এরপর ৭ মৌসুমের ক্যারিয়ারে জিতেছেন ১৪ ট্রফি। সর্বশেষ মৌসুমে জিতেছেন ট্রেবল। দিনে দিনে সিটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা গুন্দোয়ান নিজেও এই বিচ্ছেদ নিয়ে আবেগতাড়িত হয়েছেন। ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’ এ লেখা খোলা চিঠিতে ম্যানচেস্টার সিটিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গুন্দোয়ান। সেই চিঠি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
প্রিয় সিটি
তরুণ বয়সে চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলাম। তখন আমার কোনো বাচ্চাকাচ্চাও ছিল না। তাই আমার জন্য এটা বিশ্বাস করাও কঠিন যে সাত বছর পর যখন এই ক্লাব ছেড়ে যাচ্ছি, তখন আমি একজন বাবা আর যেসব স্বপ্ন দেখেছি, তার সবই পূরণ হয়েছে।
আজকের সময়টা তাই অম্লমধুর। বিদায় বলাটা সহজ নয়, এই দলটাকে বলা তো আরও কঠিন। আমার চলে যাওয়ার খবরটা গ্রুপ চ্যাটে সতীর্থদের জানানোর সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে আমি সবাইকে মিস করব। তবে ভালো লাগছে যে চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই বিদায় নিচ্ছি আর এই ক্লাবকে শুধু হৃদয়–নিংড়ানো ভালোবাসাই দিতে পারি। ট্রেবলজয়ী দলের অধিনায়ক হিসেবে কয়জন বিদায় বলতে পারে?
আমাদের অর্জন অসাধারণ। আমার ৭ বছরে ৫টি প্রিমিয়ার লিগ, দুটো এফএ কাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছি। ট্রেবল। কিন্তু এগুলো শুধুই ট্রফি। যে বিষয়টি আমি মনে রাখব, তা হলো এই দলে সবার সঙ্গে সবার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাতে যে মনের টানটা তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে এই মৌসুমে। ফুটবলে আমি কখনোই এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাইনি।
আমি এমনিতে একটু স্বল্পভাষী মানুষ। নিজেকে মেলে ধরতে একটু সময় লাগে। এই দলটার দুর্দান্ত ব্যাপার হলো, যত চাপই হোক না কেন আমরা সতীর্থরা নিজেদের মধ্যে মজা করি। অনুশীলনে আমরা বক্সে পাঁচজন বনাম দুজনের খেলা খেলি তখন রুবেন দিয়াসকে নিয়ে মজা করতে খুব ভালো লাগে। আমি এমনিতে সাদামাটা তবে মাঝেমধ্যে টেকনিক দেখালে ওরা আমাকে মজা করে ‘জিদান’ বলে ডাকে। অনুশীলনে একটু ভালো খেললেই রুবেন আমাকে ‘জিদান’ বলে ডাকে এবং তখন আমি উত্তর দেই, ‘না, না, আজ আমি পিরলো ছিলাম। আগামীকাল জিজু হব।’
আমরা প্রতিদিনই হাসিঠাট্টার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, ফুটবলে যা বিরল। এ জন্য নিজেদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদেরও ধন্যবাদ। তারা নানা সময় বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছে বলেই আমরা সতীর্থরা একে–অপরের আরও কাছে আসতে পেরেছি। আমি যত দলে খেলেছি তার মধ্যে এই দলেই মানসিকভাবে আমরা একে–অপরের খুব কাছাকাছি ছিলাম এবং সেটাই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের কারণ।
চ্যাম্পিয়নস লিগ আমার কাছে ১০ বছর ধরে দেখা স্বপ্ন। অবসেশনও বলতে পারেন। ২০১৩ সালে ডর্টমুন্ডের হয়ে ফাইনালে হারের পর হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। তারপর ১০ বছর ধরে এটা আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। শুধু এই ট্রফিটা জিততেই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সে জন্যই সিটিতে এসেছিলাম। দুই বছর আগে চেলসির কাছে ফাইনালে হারের পরও হৃদয় ভেঙেছে। আর এবার রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সেমিফাইনালে বেঞ্চে বসে থাকার সময়ও খুব খারাপ লেগেছিল। আমি যেকোনো মূল্যে ট্রফিটা জিততে চেয়েছি।
এই মৌসুমে সব ঠিকঠাক হয়েছে। শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ নয়, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ থেকে প্রতি সপ্তাহেই আমরা সব ঠিকঠাক করতে পেরেছি। এমনকি আর্সেনালের সঙ্গে ১০ পয়েন্ট ব্যবধানে পিছিয়ে থাকতেও বিশ্বাস ছিল লিগ জিতব।
ড্রেসিংরুমে যেসব খেলোয়াড় ছিল, তাতে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, যতবার মাঠে নামব, ততবারই জিতব। যখন আপনি সতীর্থদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, তখন সবকিছুই সহজ হয়ে আসে। কোনো ভয়ডর থাকে না আর তখনই জাদুটা কাজ করে। সম্ভবত এ কারণেই আমি গত মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোল করতে পেরেছি। আর এই মৌসুমটা আমার কাছে মনে হয়েছে সিনেমার মতো। ইস্তাম্বুলের ফাইনাল দিয়ে শেষ করার চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না বলেই মনে করি। বিমান সেখানে ল্যান্ড করার আগে জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, আমি আমার দাদার জন্মভূমিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে সিটির অধিনায়কত্ব করব। বাসে চড়ে হোটেলে যাওয়ার পথে স্কট কারসন (২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তিনি লিভারপুলে ছিলেন) বলেছিল, ‘ভেবো না, ইস্তাম্বুলে এলে আমি সব সময় চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি হাতেই নিয়েই ফিরি।’
একটাই সমস্যা ছিল। ফাইনালটা স্থানীয় সময় রাত ১০টার আগে শুরু হয়নি। হোটেলে অলসভাবে বসে ছিলাম। ফোন বন্ধ রেখেছিলাম। আমি কারও খুদেবার্তা পড়তে চাইনি। ঘুমোনো কিংবা টিভিও দেখতে পারিনি। নার্ভাস ছিলাম। মাথার মধ্যে ফাইনালটা আগেই অন্তত ৫০০ বার খেলে ফেলেছিলাম।
ম্যাচটা নিয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। এখনো ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। স্বীকার করতে হবে আমরা নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে পারিনি। একটু বিক্ষিপ্ত ছিলাম, তবে শেষ পর্যন্ত জিততে পেরেছি। যেটা মনে আছে, সেটা হলো রেফারির শেষ বাঁশি। হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিলাম। ওঠার সময় দেখি চারপাশে ইন্টার মিলানের খেলোয়াড়েরা, সব কটি চোখই অশ্রুসজল। ওই মুহূর্ত, ওই অনুভূতি আমার জানা। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, এই মৌসুমের পারফরম্যান্সের জন্য তোমাদের গর্ব অনুভব করা উচিত।
আমি জানি বার্সেলোনায় অনেক চাপ থাকবে। কিন্তু আমি চাপ নিতে ভালোবাসি। নিজের স্বস্তির জায়গা থেকে বের হয়ে কিছু করতে ভালো লাগে। কখনো সহজভাবে কিছু করতে চাইনি, নতুন চ্যালেঞ্জের পিছু ছুটেছি। সেই ধারাতেই এই নতুন অধ্যায়। বার্সেলোনার জার্সিতে খেলতে আর তর সইছে না। কিন্তু তার আগে ম্যানচেস্টার সিটিকে কিছু শেষ কথা বলতে চাই—সেটা আমার সতীর্থ, স্টাফ ও ভক্তদের প্রতি।
জেনে রেখো, আমি সব সময়ই সিটির। এই বন্ধন কোনোকিছুই ছিন্ন করতে পারবে না। এই ভালোবাসা সর্বোচ্চ স্তরের। আর তাই শুধু ধন্যবাদই বলতে পারি।
আমি বাকি জীবনভর তোমাদের মনে রাখব। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।
শুভেছান্তে
ইলকায়।