সবকিছুতেই সর্বকনিষ্ঠ ইয়ামালের সামনে আরেক মাইলফলক
প্রতিভাবান ও প্রবল সম্ভাবনাময় বিবেচিত হলেও লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনার মূল দলে প্রথম খেলানো হয় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর। বার্সার হয়ে আনসু ফাতির অভিষেক ১৬ বছর বয়সে।
কিন্তু লামিনে ইয়ামালের জন্য এত দিন অপেক্ষা করেননি কোচ জাভি হার্নান্দেজ। মেসি-ফাতির মতোই বার্সার একাডেমি ‘লা মাসিয়া’ থেকে উঠে আসা ইয়ামালকে জাভির এতটাই প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছে যে, বয়স ১৬ ছোঁয়ার আগেই মাঠে নামিয়ে দেন।
ড্রিবলিং, পাসিং আর গোল করার দক্ষতার কারণে অল্প বয়সেই সবার নজর কাড়েন ইয়ামাল। ১৪ বছর বয়সে ডাক পেয়ে যান স্পেন অনূর্ধ্ব-১৬ দলেও। ২০২২ সালের মধ্যে স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ আর অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলানো হয়েছে।
বেশির ভাগ সময় তাঁকে রাইট উইঙ্গারের ভূমিকায় দেখা যায়। দলের প্রয়োজনে সেন্টার ফরোয়ার্ড, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এমনকি ফলস নাইন হিসেবেও অবদান রাখতে পারদর্শী। বাস্তবে ইয়ামালের মতো বহুগুণে গুণান্বিত এত অল্প বয়সী ফরোয়ার্ড খুঁজে পাওয়াই দায়!
গত ২৯ এপ্রিল বার্সেলোনার জার্সিতে রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে ইয়ামাল যখন খেলতে নামেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর ২৯০ দিন। বার্সার সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকের যে রেকর্ড সেদিন নিজের করে নিয়েছিলেন, এরপর মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে গড়েছেন আরও চার সর্বকনিষ্ঠের কীর্তি। এই শতাব্দীতে লা লিগায় কোনো দলের শুরুর একাদশে থাকা, লা লিগায় প্রথম গোল করা, জাতীয় দল স্পেনের হয়ে অভিষেক ও গোল—সবকিছুতেই সর্বকনিষ্ঠ এই দীপ্তিমান কিশোর।
ঘটনাচক্রে সর্বকনিষ্ঠর রেকর্ড ভাঙার ক্ষেত্রে বারবার ইয়ামালের বার্সা সতীর্থরাই তাঁর পেছনে পড়ে গেছেন। বার্সার হয়ে যেদিন প্রথমবার খেলতে নামেন, সেদিন পেছনে পড়ে যান সতীর্থ আনসু ফাতি (বর্তমানে ধারে ব্রাইটনে খেলছেন ফাতি)। কাতালান ক্লাবটির শুরুর একাদশে প্রথমবার নাম লেখানো ও গোল করাতেও ভেঙে দেন ফাতির রেকর্ড। স্পেনের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ও গোলদাতার রেকর্ডটাও নিজের দখলে নিয়েছেন আরেক সতীর্থ গাভিকে পেছনে ফেলে।
স্পেনের হয়ে জোড়া রেকর্ড গড়ার ক্ষেত্রে অবশ্য সবকিছু ইয়ামালের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছিল। বাবা মরোক্কান ও মা গিনিয়ান হওয়ায় ওই দুই দেশকেও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ছিল। ২০২২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে সবাইকে চমকে দেওয়া মরক্কো তো তাঁকে নেওয়ার জোর চেষ্টাও চালিয়েছিল। ইয়ামাল শেষ পর্যন্ত জন্মভূমি স্পেনকে বেছে নেওয়ায় মরক্কোর আশা পূরণ হয়নি।
এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মহাদেশীয় রেকর্ড গড়ার হাতছানি ইয়ামালের সামনে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে আজ রয়্যাল অ্যান্টওয়ার্পের বিপক্ষে গোল পেলেই তিনি আসরের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে যাবেন। আজ গোল না পেলেও চিন্তার কিছু নেই। এ মৌসুমে যেকোনো ম্যাচে প্রতিপক্ষের জাল খুঁজে নিতে পারলেই রেকর্ডটা নিজের হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রেও তিনি ভেঙে দেবেন বার্সা সতীর্থ ফাতির রেকর্ড। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের ম্যাচের শেষ ভাগে ফাতির গোলেই ইন্টার মিলানকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছিল বার্সা। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ৪০ দিন।
ফাতির ওই গোলে ২২ বছর ধরে টিকে থাকা রেকর্ড ভেঙে যায়। ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর রোসেনবর্গের বিপক্ষে অলিম্পিয়াকোসের হয়ে গোল করেছিলেন সাবেক ঘানাইয়ান স্ট্রাইকার পিটার ওফোরি কুয়ায়ে। তখন কুয়ায়ের বয়স ছিল ১৭ বছর ১৯৪ দিন। চার বছর আগে ফাতি কুয়ায়েকে ডিঙানোর পর অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন, রেকর্ডটা আরও ২২ বছর টিকে থাকবে। কিন্তু ইয়ামালের কাছে এই রেকর্ডও নিজের করে নেওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র।
চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সার হয়ে এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচ খেলেছেন ইয়ামাল। এর তিনটিতে জাভি তাঁকে বদলি নামিয়েছেন। ওই ম্যাচগুলোতে বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগও তৈরি করেছিলেন। একটু এদিক-সেদিক হলে কিংবা ভাগ্য সহায় হলে রেকর্ডটা আরও আগেই হয়ে যেতে পারত। সেটা না হওয়ায় ‘সবুরে মেওয়া ফলানোর’ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ইয়ামালকে।
যদিও নতুন রেকর্ড গড়তে ইয়ামালের সামনে ‘হুমকি’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন। গত ২৯ নভেম্বর লাঁসের বিপক্ষে ম্যাচে প্রথমবার আর্সেনালের চ্যাম্পিয়নস লিগ স্কোয়াডে রাখা হয় মিডফিল্ডার ইথান এনওয়ানেরিকে। গত রাতে পিএসভি আইন্দহফেনের বিপক্ষে ম্যাচের স্কোয়াডেও ছিলে। তবে এনওয়ানেরির এখনো চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক হয়নি। আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতা যদি তাঁকে খেলতে নামাতেন এবং গোল করতেন, তাহলে তিনিই হয়ে যেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা। কারণ, সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর ২৫৩ দিন; গত রাত পর্যন্ত ১৬ বছর ২৬৬ দিন। যেহেতু এনওয়ানেরির এখনো চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক হয়নি এবং তাই আপাতত তিনি ইয়ামালের মাথাব্যথার কারণ নন।
তা ছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগে এনওয়ানেরি শিগগিরই গোল পেয়ে গেলেও ইয়ামালের খুব একটা ক্ষতি হবে না। ইয়ামাল বয়সে এনওয়ানেরির চেয়ে প্রায় চার মাসের ছোট। এনওয়ানেরি চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের কনিষ্ঠতম গোলদাতা হয়ে গেলেও সেটা হবে ক্ষণস্থায়ী। আজ এনওয়ানেরির বয়স ১৬ বছর ২৬৭ দিন, ইয়ামালের ১৬ বছর ১৫১ দিন।
এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে কোনো দলের স্কোয়াডে ছিলেন, এমন খেলোয়াড় ইয়ামাল ও এনওয়ানেরি ছাড়া আরও দুজন আছেন—নিউক্যাসল ইউনাইটেডের এইডান হ্যারিস ও ইয়ামালের আরেক বার্সা সতীর্থ পাউ কুবারসি। নিউক্যাসলের মূল দলে এখনো অভিষেক হয়নি হ্যারিসের। তা ছাড়া তিনি গোলরক্ষক হওয়ায় অনায়াসে ইয়ামালের ‘হুমকিদাতার তালিকা’ থেকে বাদ দেওয়া যায়।
কুবারসিরও এখনো বার্সার জার্সি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি। সেন্টারব্যাক হওয়ায় তাঁর গোল করার সম্ভাবনাও কম। বার্সা যুব দলের হয়ে ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নস লিগে যে দুটি ম্যাচ খেলেছেন, সেখানেও গোল বা অ্যাসিস্ট নেই। বেশির ভাগ সেন্টারব্যাকের মতো ওপরে উঠে আসার প্রবণতা কম।
তবে কুবারসির সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বার্সা এরই মধ্যে ‘এইচ’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্ব নিশ্চিত করে ফেলায় আজ অ্যান্টওয়ার্পের বিপক্ষে দ্বিতীয় সারির একাদশ নামাতে পারে।
ইএসপিএন জানিয়েছে, আজ শুরুর একাদশে আট পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামবে বার্সা। সেটা হলে কুবারসির অভিষেক হতেও পারে। আর অভিষেকে গ্রুপের তলানিতে থাকা অ্যান্টওয়ার্পের (পাঁচ ম্যাচের সব কটি হেরেছে এবং ১৫ গোল খেয়েছে) বিপক্ষে তিনি গোল পেতেও পারেন। তবে কুবারসির রেকর্ডটাও হয়তো ক্ষণিকের জন্য টিকে থাকবে। তিনি যে ইয়ামালের চেয়ে বয়সে প্রায় সাত মাসের বড়!
তাই চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার যুগান্তকারী রেকর্ডটা যে শিগগিরই ইয়ামালের হতে যাচ্ছে, তা অনুমান করাই যায়।