আজ শুধু মেসিকে দেখার দিন
সেদিন লুসাইল স্টেডিয়ামে সোফিয়া মার্তিনেজের ওপর কী ভর করেছিল, কে জানে! প্রচণ্ড আবেগে সংবাদকর্মী-স্বত্ত্বাটা নড়ে গিয়েছিল হয়তো। কেউ এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেনি। সবাই জানতেন, লিওনেল মেসির ক্ষেত্রে এমন হয়। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে হচ্ছে।
প্রতিদিনই তো কেউ না কেউ জীবনের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন। আবার প্রেরণাও পাচ্ছেন রাতে তাঁর খেলা দেখে। কারও কারও জীবনে এভাবে পরের দিনটা আসে; আর্জেন্টিনায়, স্পেনে, বাংলাদেশে…পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। কয়েক প্রজন্মের কাছেই মেসি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তার ওপর সোফিয়া আর্জেন্টাইন, জন্মের পর ’৮৬ বিশ্বকাপ এবং তারপর ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারানোর গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। ২০১৪ সালে সেই গল্পের শেষ টানার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু মেসি প্রমাণ করেছিলেন, তিনিও রক্ত–মাংসের মানুষ। সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ও মানুষ ব্যর্থ হন। প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন না। গল্পটা তাই শেষ হয়নি। বরং এই বিরহদহন দীর্ঘ হতে হতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’র ৩৩ বছর পার হয়ে বিশ্বাস হারানোর গল্পের বয়স ৩৬–এ এসে ঠেকেছে।
সেমিফাইনালে সোফিয়া চোখের সামনেই দেখেছেন, মেসির বাঁ পায়ের ঝলকানিতে কীভাবে বিশ্বাসটা ধীরে ধীরে আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। এবার আবার ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ হয়ে ঝুলে থাকুক কিংবা ‘গ্রেটেস্ট স্টোরি এভার টোল্ড’ হয়ে বাঁচুক, সোফিয়া সেসবের পরোয়া করেননি।
প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বইয়ে ন্যায়ের সংজ্ঞায় পলিমার্কাস বলেছিলেন, যার যা প্রাপ্য, তাকে তা দেওয়াই ন্যায়। সোফিয়া রিপাবলিক পড়েছেন কি না, জানা নেই, তবে মেসির ওপর ন্যায়বিচারই করেছেন। শুধু সুবিচারেই তো চোখ টলমল করে ওঠে। কথাগুলো শুনে মেসিরও চোখ ভিজেছে।
‘(ফাইনালে) ফলে কী এসে যায়, হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে তুমি যে আর্জেন্টাইন, এ মহিমা তো তোমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না’—সোফিয়ার কথায় মেসির ভেতরের ‘শেকড় পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। প্রতি–উত্তরে কিংবদন্তি যা বলেছিলেন, সেটাই মূল কথা, একজন ফুটবলারের সারসত্ত্বা, ‘আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি আর্জেন্টাইন মনে করে ফলই সবকিছু নয়। বরং ফলের দেখা পেতে, যে পথটা পার হলাম, সেটাই সবকিছু।’
পথ! ডিয়েগো ম্যারাডোনো ’৮৬ এনে দেওয়ার পরের বছর মেসির জন্ম। রোজারিওর ধুলোমাখা পথে তাঁর শৈশবের গল্প লেখা হয়েছে। বড় হয়ে পৃথিবীর প্রায় সবাই শৈশব নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগেন। ইশ! যদি ফিরিয়ে আনা যেত! কিংবদন্তিরা পারেন। সেটা অন্যভাবে অন্য প্রকাশে হলেও পারেন। মেসির ছোটবেলার কোচ আদ্রিয়ান কোরিয়ার কথা শুনুন, ‘(মাঠে) এখন সে যা যা করে, সেগুলো ১২ বছর বয়সের মধ্যেই করেছে।’
১৩ বছর বয়সে গেলেন স্পেনে। শুধুই ক্যারিয়ার গড়তে? নাহ, ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনও ছিল। গ্রোথ হরমোনজনিত সমস্যা। টাকার দরকার ছিল। তার পর থেকে ইউরোপে সেই যে নিজের শৈশবের খেলাগুলো খেলতে শুরু করলেন, রাতের শিশিরের মতো টুপটাপ করে ঝরে পড়ল এক–একটি শিরোপা! এক–একটি রেকর্ডে এক–একটি আর্জেন্টাইনের শৈশব গাঁথা! চুলের শত শত সিঁথির মতো শত শত সব রেকর্ডের পাতা। ২১–২২ বছর বয়স হতেই পৃথিবী কুর্ণিশ করেছে। তাতে আর্জেন্টাইনদের কি কিছু যায়–আসে!
একদমই না। আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপই শেষ কথা। মেসি ইউরোপে যখন একের পর এক শিরোপা জিতেছেন, তখন আর্জেন্টাইনদের বুকে বিশ্বকাপ–খরার চর আরও দীর্ঘ হয়েছে। ক্যাম্প ন্যুতে এক–একটি শিরোপা–উৎসবে ফেটে চৌচির হয় অভিমানী আর্জেন্টাইনদের বুকের মাটি। মেসি কি এই মাটিরই সন্তান!
নেতিবাচক এই বিস্ময়টুকু ২০১১ সালেই আর্জেন্টাইনদের চোখেমুখে দেখেছেন মেসি। খোদ তাঁর জন্মভূমি রোজারিওতেই। কলম্বিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে আর্জেন্টিনা। স্টেডিয়ামের বাইরে সমর্থকেরা বলাবলি করেছেন, ‘সে ব্যর্থ...আসার পর থেকে আর্জেন্টিনা কিছুই জেতেনি...কখনোই ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়...সে ইউরোপেই থাকুক।’
পৃথিবীতে আর্জেন্টিনার মতো ফুটবলপাগল দেশ খুব কমই আছে। মেসি সেই আর্জেন্টিনারই সন্তান, তাঁর মতো প্রতিভাবান ফুটবলারও খুব কম। অথচ আর্জেন্টাইনদের কী ভালোবাসামাখা অভিমান!
ভালোবাসতে বাসতে ফতুর হয়ে গেলেই বুঝি মানুষ এমন করে!
মানুষ আবারও ভালোবাসে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে মেসি সেটা আদায় করেছেন। ব্যর্থ হওয়ার পর আবারও যা তাই! তারপর কোপা আমেরিকায় ব্যর্থ হয়ে শেষও টেনেছিলেন। জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার সবই করেছি।’ আর্জেন্টাইনরা মানেননি। এই টানের রূপ বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথায়, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে গো!’
মেসি সেই সোহাগের টানেই তারপর ফিরলেন। ধীরে ধীরে আর্জেন্টাইনদের আস্থাও ফিরল, গত বছর জুলাইয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের পর। কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগেই রব উঠেছে আর্জেন্টিনায়, মেসির জন্য হলেও বিশ্বকাপটা জিততে হবে! গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ তাঁর জন্য জীবন দিয়ে দিতে চেয়েছেন—শুধু আজকের দিনটির দেখা পেতে, শুধু আজকের দিনটির জন্য!
আজ সেই দিন, যেদিন মেসির সঙ্গে আর্জেন্টাইনদের সম্পর্কের শেষ পাতাটা লেখা হবে। আজ সেই দিন, যেদিন গোটা পৃথিবী দেখবে সেই ‘খুদে জাদুকর’ তাঁর খেলার সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চে নামছেন শেষবারের মতো। এই শেষ লড়াই তাঁর দেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখার শেষ সুযোগও। এই ম্যাচটা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য, বারবার আশাহত হওয়ার পর মানুষ কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে পথের একদম শেষ মাথায় এসে গোটা জাতির, গোটা পৃথিবীর সব অনুসারীর মনের আশা পূরণের আকুলতাও নিজের পথের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন—সেই বিস্ময়কর মুহূর্তটি দেখারও লগ্ন।
যত কাজই থাকুক, আজ এই মুহূর্তটি উপভোগ করুন। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় টিভির সামনে বসে দেখুন, মেসির এই দিনটি—যে দিন আবারও ফিরিয়ে আনতে মেসি বিশ্বকাপে পথ হেঁটেছেন অন্য যে কারও চেয়ে বেশি—২৬ ম্যাচ! আর এই পথ হাঁটার মধ্যেই আয়তাকার সবুজ গালিচায় খুঁজে চলেছেন সেই ‘পবিত্র লুকানো সূত্র’—(গোল) সংখ্যার খেলায় যার শেষটা হয় নাচে!
একটু বুঝিয়ে বলতে হবে।
ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান স্টিংয়ের একটি গান আছে ‘শেপ অব মাই হার্ট।’ ১৯৯৩ সালে গানটা যখন মুক্তি পায়, লোকে সেভাবে শোনেননি। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, গানটি লোকের কানে কানে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। গানের মর্মবাণী ঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে আন্দাজ করে নেওয়া যায়।
তাস খেলাটা গানের সেই চরিত্রের কাছে ধ্যানের মতো। কেউ তা বোঝে না। কিন্তু লোকটি টাকাপয়সা, খ্যাতি বা যশের জন্য খেলেন না। তিনি জানেন, তাস খেলায় একজন সৈনিকের তরবারি হলো ইশকাপন, চিড়িতন যুদ্ধাস্ত্র আর রুহিতন এই শিল্পে টাকা আসার মাধ্যম। ঠিক যেভাবে ফুটবল খেলায়ও মেসির ড্রিবলিং তাসের ইশকাপন, বডি–ফেইন্ট হয়তো চিড়িতনের দান আর রুহিতন তখন বেকার বসে!
অন্তত মেসির হৃদয়ে বিশ্বকাপে রুহিতনের কোনো কাজ নেই। সেই গানের চরিত্রের মতো মেসির মুখেও যে মুখোশ নেই! যেটা পরে জন্মেছেন, সেটাই। সে মুখোশের সুতায় দেশের মানুষের আশা পূরণে লবণাক্ত–ঘামের গন্ধ। গানের সেই চরিত্রের মতোই মেসিও সবুজ গালিচায় খুঁজে চলেছেন লুকানো সূত্র—দেড় দশক ধরে আর্জেন্টাইনরা এই দায়িত্ব মেসির কাঁধে দিয়ে রেখেছেন। একসময় যা ছিল ম্যারাডোনার ওপর, ব্রাজিলে পেলের ওপর। দুই দিকপালই ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থাকতে সূত্রটা মিলিয়ে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপ। আর মেসি? তিনি এখনো তাসের টেবিলে বসে। আজই শেষ দান। যা করার, করতে হবে আজই! নইলে পেলে–ম্যারাডোনার টেবিলটা অন্তত চোখের দেখায় এক ধাপ উঁচুতেই থাকবে।
আর তাই আজই সেই দিন। লুসাইলে মেসি যখন তাঁর ইশকাপন, রুহিতন, হরতন বের করে সবুজ গালিচায় বিছিয়ে রাখবেন, তখন দুচোখ ভরে তাঁকে দেখে নিন। পরেও হয়তো দেখবেন। কিন্তু এই মঞ্চ, এই জয়ের আকুতি, এই আবেগ—আর কখনো দেখা যাবে না।
আর্জেন্টাইনদের মতে, মেসির জন্মই যে কাজটি করতে, সেই বিশ্বকাপ জয়ের শেষ সুযোগ তাঁরই শেষ মঞ্চে। এতটা পথ আসার পর যদি আজও না পারেন, যদি আজও শেষ বাঁশি বাজার পর বুয়েনস এইরসে শ্মশানের নীরবতা ভর করে, মেসির হৃদয় তবুও গানের সেই চরিত্রের মতোই থাকবে।
যে কখনো অর্থ, খ্যাতি কিংবা যশের জন্য খেলেনি—“‘দ্যাটস নট দ্য শেপ অব হিজ হার্ট’ বাট ওয়ার্ল্ড কাপ!”’
হ্যাঁ, বিশ্বকাপই মেসির হৃদয়। যাই ঘটুক, আজ সেই হৃদয়ের কপাট বন্ধ হওয়ার দিন। খোলা থাকতে থাকতে সুবাসটা নিয়ে নিন। মিস করবেন না!