পেলে: ঐশ্বরিক নাকি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা
মার্কিন লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেলের সারা জীবনের সাধনা ছিল মিথ আর কিংবদন্তি নিয়ে। ক্যাম্পবেল আমাদের জানান মিথের শক্তি আর মানুষের সমাজে কিংবদন্তির ভূমিকা। কিংবদন্তি তথা নায়কদের অভিযান সমন্ধে ক্যাম্পবেল বলেছেন, ‘কিংবদন্তির যাত্রা হচ্ছে গভীর গহিনের খোঁজে সাহসের ভ্রমণ, সৃষ্টিশীল পুনর্জন্মের প্রতিচ্ছবি, আমাদের অভ্যন্তরের পরিবর্তনের চিরন্তন চক্র। চোখ খুলে দেওয়া এক আবিষ্কার, যেখানে সন্ধানকারী এক ঐন্দ্রজালিক মায়ার রহস্য তিনি ভেদ করতে চান।’
ব্রাজিলের এক গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো নামের বালকের গল্পটার চেয়ে মোহনীয়, বৈশ্বিক কিংবদন্তির যাত্রার আর কোনো উদাহরণ নেই। তিনি এমনই এক মোহমায়া, যারা আবেশে বুঁদ হয়ে ছিল গোটা দুনিয়া। এর আগে হয়তো এই বসুন্ধরা স্নাত হয়েছে বহু বীরের সিক্ত গাথায়, কিন্তু গোটা পৃথিবী নতজানু হয়ে সম্মান জানিয়েছে, ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে মেনে নিয়েছে—তা হয়নি।
তাই শোনা যায়, একবার যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি, নাকি যিশুখ্রিষ্ট—কে বেশি জনপ্রিয়,’ তিনি নাকি স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘এই দুনিয়ার অনেক কোণে যিশুর নাম লোকে জানে না।’ নাইজেরিয়া আর বায়াফ্রার যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার গল্পের মতো এই কাহিনি নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। তবে কিংবদন্তিদের গল্পগুলো এমনই হয়। আর পেলে নামে বিশ্বকাঁপানো ফুটবলের রাজা তো ছিলেন বিশ্বায়নের সর্বপ্রথম, পথপ্রদর্শক সুপারহিরো।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি বিশ্বজয়ের মুকুট পান। লোকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ‘ও রেই’ (পর্তুগিজ ভাষায় রাজা) নাম পাওয়া মানুষটির প্রথম বিশ্বজয়ের গল্পেই বোঝা যায়, তিনি সব রাজাকে ছাপিয়ে যেতেই এসেছেন। তাই তো সুইডেনের সেই ফাইনালের পর যখন তাঁর অবিস্মরণীয় খেলার আবেশে, ব্রাজিলের স্বপ্নের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পর গোটা মাঠ উল্লাস করছিল, লোকে অবাক হয়ে দেখে, সেই জনতার ভিড়ে আছেন রাজা গুস্তাভ।
ফুটবলের জাদু, নিজের দেশের ফাইনালে হারের জ্বালা আর রাজাসুলভ অহমিকাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে গুস্তাভকে নামিয়ে এনেছিল জনতার কাতারে। ক্যাম্পবেল যে কিংবদন্তির কথা বলেন, তাঁর প্রমাণ লোকে দেখতে পায়।
অবশ্য এই স্থলে এসে কিংবদন্তি কিংবা নায়ক হয়ে ওঠার ঘটনাটা বোঝার ব্যাপারে আমরা কার্ল মার্ক্সের সহায়তা নিতে পারি। মার্ক্স মনে করতেন, মানুষ আসলে তাঁর নিজের সময়কাল আর সামাজিক সম্পর্কের একটি উপাদান। ব্যক্তি হয়তো নিজ উৎকর্ষে অনেক দূর ছাড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু সময় আর সমাজের ফ্রেমকে ছাপিয়ে যাওয়া নিতান্তই অসম্ভব।
আপাতভাবে ক্যাম্পবেলের রোমান্টিক আখ্যানের সঙ্গে মার্ক্সের এই কাঠখোট্টা আলাপকে বিপরীত মনে হলেও, গভীরে গেলে এর সাযুজ্যই পাওয়া যায়। কিংবদন্তিরা কালের যে ফ্রেম বা কাঠামো, তাঁর ভেতর থেকে সবচেয়ে গভীরের মানেটা খুঁজে আনেন। তা সে গিলগামেশের যাত্রাই হোক কিংবা পেলের। এই মানে খুঁজে আনাটা সময়টাকে পরিপূর্ণ করে, কীর্তিগুলোকে অক্ষয় করে তোলে। আর সংজ্ঞানুসারে এ–ই তো কিংবদন্তি।
পেলের উত্থানটা এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ব দেখছে সবচেয়ে উত্তাল শতকের সবচেয়ে টালমাটাল সময়টা। বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবে ক্ষত–বিক্ষত দুনিয়া আর মানবতা খুঁজতে চাইছে এমন কিছু, যাতে তার বিভেদ আর ধংস ভুলে নতুন যুগের দুনিয়ায় সাম্য আর সম্প্রীতির সুর পাওয়া যায়। জাতি ও ধর্মের বিভেদের যে ভয়ংকর রূপে বিশ্ব, ঘৃণার চাষের যে তাণ্ডবলীলায় দুনিয়া ছাড়খাড় হলো, তখন সে মরিয়া এক কিংবদন্তির খোঁজে।
আবার প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিশ্বায়ন তখন অবধারিত। ফলে, সেই কিংবদন্তিকে হতে হবে এমন, যিনি একাধারে মানুষকে বিভেদ ভুলিয়ে দেবেন আবার মানুষের ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দেখিয়ে নতুন দুনিয়ায় উজ্জীবিত করবেন এগিয়ে যাওয়ার যাত্রায়।
তত দিনে টেলিভিশন চলে এসেছে। ফলে কিংবদন্তির জাদু কেবল লোকগাথা দিয়ে যথেষ্ট হবে না। তাঁকে হয়ে উঠতে হবে দর্শনীয় জাদুকর। আর, এ তো এক গ্রাম কিংবা শহরের কেন্দ্রে কয়েক হাজার লোকের সামনে দেখানো তুকতাক নয়, বরং কোটি দর্শকের সামনে দেওয়া পরীক্ষা।
মানুষের ইতিহাসে বারবার যেমনটা দেখা যায়, সময়ের পরীক্ষা যত কঠিনই হোক, সে ঠিকই উতরে যায়। নায়কের যাত্রা সময়কে সামনে নিয়ে যায়।
পেলেও ঠিক তা–ই করলেন। এক শতক আগেও যে খেলা লোকে তেমন একটা চিনত না, সেই ফুটবল তত দিনে জনতার খেলা হয়ে উঠেছে। সেই ফুটবলে ভর করে তিনি হয়ে উঠলেন সময়ের নায়ক। ঠিক যেমনটা সে সময় দরকার ছিল। ফুটবলে হয়তো জনতা দুই ভাগ হয়ে খেলা দেখে, কিন্তু পেলের মতো মহানায়কেরা শুধু মাঠ নয়, মাঠের বাইরের ভেদাভেদও ভুলিয়ে দেন। ফুটবলের মাঠে থাকা মানুষেরা অস্থির সময় ভুলে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য শক্তি ও মনোবল বাড়িয়ে নেন।
পেলে এর বাইরে আরেকটা কাজ করলেন, সময়ের অন্য সব মহানায়কের মতোই। তিনি দেখালেন, মানুষের ক্ষমতা তাঁর কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। তাঁর টিমমেট গারিঞ্চা ড্রিবলে হয়তো তাঁর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন, ফুটবলটাও তিনি খেলতেন শিশুদের মতো উচ্ছ্বাসে আর লোককে ভাসাতেন অপার আনন্দে, কিন্তু পেলে ছিলেন ধ্যানী যোগীর মতো। দরিদ্র ঘরের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পেলের ধ্যান–জ্ঞান ছিল কেবল সাফল্যে। আর তার সন্ধানে তিনি অবিস্মরণীয় সব দক্ষতার সাহায্য নিলেন।
বিশ্বকাপ ৭০–এর ফাইনালে কার্লোস আলবার্তোর দারুণ গোলটার আগে ডামি করা, নাটমেগ, জিগজ্যাগ শট, অডাসিয়াস ড্রিবল পাস্ট, বাইসাইকেল কিক, লং রেঞ্জ শটের নানা রকম ধরন আর লাতিনদের সহজাত যে বৈশিষ্ট্য, বলটাকে আদুরে বেড়ালের মতো পায়ের অংশ বানিয়ে চিতার গতিতে ছুটে চলা।
এই কারণে, পেলের পর আরেক কিংবদন্তি ম্যারাডোনা বলতেন, ‘পেলেকে নিয়ে বলার কিছু নেই, সে শরীরের সব অংশ দিয়ে গোল করতে পারে।’ আধুনিক যুগের তরুণ সেনসেশন আর্লিং হালান্ড বলেন, ‘আমরা এখন যা যা করি বা করার চেষ্টা করি, সব আসলে পেলেই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।’ অর্থাৎ, পেলে হচ্ছেন সময়ের সেই মহানায়ক, যিনি মায়াজগতের গভীর গহিনে আবিষ্কার করেছেন পরবর্তী সময়ের পাথেয় হয়ে। কিন্তু, আবার মার্ক্সের আলাপে ফিরে গিয়ে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সমাজবিজ্ঞানটা বোঝাও জরুরি।
পেলে গরীবের ছেলে, পেলে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা, ইউসেবীয়র ভাষায়, ‘পেলের খেলা দেখলে মনে হয়, ঈশ্বর খেলছেন’—এসব আলাপ ছাপিয়েও বাস্তব জীবনের বিজ্ঞানটা বুঝতে হবে। আর সে কারণেই ব্রাজিলের সাবেক এক প্রেসিডেন্ট যখন বলেন, ‘পেলে হচ্ছেন আসলে আধুনিক ব্রাজিলের প্রতীক’, তখন কথাটা কেবল কথার কথা মনে হয় না।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্কোয়াডে যেসব খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয়, তাঁদের যখন ইনটেনসিভ মেডিকেল চেকআপের জন্য নেওয়া হয়, তখন তাঁদের মুখ থেকে তিন শতাধিক দাঁত তুলে ফেলতে হয়। এর আগে জীবনে কখনো দাঁতের ডাক্তারের কাছে না যাওয়া এসব খেলোয়াড়ের আরও জটিল কিছু রোগ ধরা পড়ে। শনাক্ত হয় দীর্ঘদিন না খেতে পেয়ে বা আধপেটা খেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পুষ্টিহীনতার।
এই দলের প্রায় সবার অন্ত্রে পোকা বাসা বেঁধেছিল, কারও ছিল সিফিলিস, কারও আবার তীব্র রক্তশূন্যতা। এককথায়, বেশির ভাগের জীবনে যে বিরাট দানব ঘাড়ের ওপর চেপে বসে, তা হচ্ছে দারিদ্র্য। এদের বেশির ভাগই ছিলেন কালো বা মুলাটো। ব্রাজিলের সেই দল ছিল নানা বর্ণের, নানা জাতের, দেশের সবার সম্মিলিত একটা দল।
গল্পটার শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহ দেয়, যার প্রভাবে কর্মসংস্থান ও বেতনের প্রবৃদ্ধি হয়। এর ফলে শ্রমিকশ্রেণির জীবনমানের কিছুটা উন্নতি হয় এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে ব্যবসা–বাণিজ্যও ফুলে–ফেঁপে ওঠে, তৈরি হয় এক নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
তবে এটাও সত্য যে এসব দেশে সরাসরি উপনিবেশিক শাসন না থাকলেও নানাভাবে এর উপস্থিতি ছিলই। আর ছিল, এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মদদে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী, যাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট আর সম্পদের পাচার। এর ফলে, সেসব দেশের ছবিটা উপনিবেশিক সময়ের তুলনায় কিছুটা পরিষ্কার হলেও, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং সম্পদের অসম বণ্টন ছিল। তবে, এরপরও কিছু সম্পদের উৎপাদন হয়, যা সরকারগুলো গোছানো, আধুনিক এবং পেশাদার ফুটবলের কাঠামো নির্মাণে ব্যয় করতে পারে। এখানে ব্যষ্টিক অর্থনীতির একটা সমীকরণ দাঁড়ায়, যা ফুটবলের জন্য উপযোগী। একেবারেই পুঁজি না থাকলে কাঠামো টেকে না। প্রচণ্ড অভাবী মানুষ যেকোনোভাবে, এমনকি লুটপাট করেও বাঁচতে চায়। আবার শ্রমিকশ্রেণির জন্য অফুরন্ত চাকরি থাকলে তা ফুটবলের মতো ব্যাপারে ভালো করার আগ্রহ কিংবা পুরস্কারকে লঘু করে দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ভার্গাস ১৯৫৪ সালে আত্মহত্যা করেন। বছরখানেক রাজনৈতিক অস্থিরতার পর নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসেন জুসকেলিনো কুবিটশেক। তিনি ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দেন, ‘পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন।’ সে সময় কোরিয়ার যুদ্ধের পর দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক চাঙাভাব দেখা যাচ্ছিল। সেনাবাহিনীকে প্রচুর বেতন আর অস্ত্রপাতি দিয়ে ঠান্ডা রাখা হয়। প্রচুর বিনিয়োগ করে নির্মাণ করা হচ্ছিল বড় বড় সব কাঠামো। এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধির হার বছর পাঁচেক ছয় শতাংশের বেশি করে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে।
এসবের প্রভাব পড়ে ফুটবলেও। হাতে টাকাপয়সা আসা দরিদ্র আর মধ্যবিত্তেরা মাঠে জড়ো হন বিনোদনের আশায়। সেই সুযোগকে ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগানোর জন্য বিনিয়োগ হয় ফুটবল ব্যবসায়। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়, ১৯৬৩ সালে রিও স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। ফ্লা আর ফ্লু অর্থাৎ ফ্ল্যামেঙ্গো আর ফ্লুমিনেসের খেলা গোলশূন্যভাবে শেষ হলেও সেদিন মাঠে দর্শক ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার, আজ পর্যন্ত তা বিশ্ব রেকর্ড। আর ভার্গাসের সময় কালো আর মুলাটোদের ধীরে ধীরে ফুটবল সংস্কৃতিতে আত্তীকরণের রূপটাও আরও নিবিড় হয়।
প্রায় এক শতক আগে ইংল্যান্ডে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তেমনি ব্রাজিলেও সে সময় গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকের ঢল নামে। এরা কেবল যে ক্লাবের মাধ্যমে নিজেদের নতুন আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টা করে তা–ই নয়, অংশ হতে চায় ক্লাবকেন্দ্রিক যে সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তারও। ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের সংস্কৃতি, যার প্রাণ ছিল সংগীত আর সাম্বা, তাঁর সঙ্গে মিলেমিশে যায় ফুটবল।
অর্থাৎ, হরেদরে চারটা বড় বিষয় ব্রাজিলের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এক, দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হওয়ায় ফুটবলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতে আর তাতে আকৃষ্ট হন গরিব অংশ থেকে আসা মেধাবীরা। দুই, বর্ণবাদের অনেকাংশে বিলোপ এবং ব্রাজিলীয় জাতিসত্তার বিকাশ, যার ফলে আফ্রো-ব্রাজিলীয়, মেসটিজো এবং ইন্ডিয়ানদের থেকে আসা বিপুল পরিমাণ দরিদ্র মেধাবী ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ পায়। তিন, শহুরে সুশীল সমাজের উত্থান, যারা ফুটবলের সংস্কৃতির সুরক্ষা ও বিকাশে সাহায্য করতেন। অনেকটা রেড ভিয়েনার ‘কাফে’ কালচারের মতো। আর চতুর্থত, সেই সময় রেডিওসহ গণযোগাযোগমাধ্যমের দারুণ বিকাশ, যা ফুটবলকে এক গণ–আকাঙ্ক্ষার সামষ্টিক কল্পনার কেন্দ্র করে তোলে।
আর ৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের যে দল পাঠানো হয়, তাদের পেছনে ছিল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। দলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বহু আগেই সুইডেনে গিয়ে সব দেখে আসেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা করেন যাতে দলের খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপের সময় সবচেয়ে কম ভ্রমণ করতে হয়, আরামদায়ক আবাসন ও যথেষ্ট প্রস্তুতির সুযোগ মেলে। শুধু তা–ই নয়, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের খাবারের তালিকা, পারিবারিক, যৌন জীবনসহ, স্বাস্থ্যবিধি, অনুশীলনের যাবতীয় বিষয়ে কড়া নজর রাখা হয়।
অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই কঠোর নিয়ম, সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা আর পরিশ্রমের গল্প। লটারি জেতার মতো রোমান্টিক নয়। পেলের কিংবদন্তিটা রোমান্টিক হলেও, তাঁর উত্থানটা আসলে সমাজবিজ্ঞানের এই কঠোর বাস্তব বিশ্লেষণ দিয়েই বুঝতে হবে। কিংবদন্তিও তৈরি হন সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে থাকার কারণে।
নিঃসন্দেহে পেলের যাত্রা মানুষের সময়কে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু, এর পেছনে ছিল বাস্তব পরিকাঠামোর সহায়তা। পেলের চলে যাওয়ার দিন আমাদের মাথায় রাখতে হবে, পরিকাঠামো না থাকলে কিংবদন্তির জন্ম হয় না। আরেকটি পেলে আকাশ ফুঁড়ে আসবেন না, তাঁকে উৎকর্ষের সুযোগ দিতে হবে এই সমাজকেই।