আলট্রাস: ফুটবলের ‘গুন্ডা’ সমর্থকদের গল্প
‘অ্যাঞ্জেল ভাস্কোস ডি লা ক্রুজ নামে এক বন্ধু আমাকে লিখেছিল, “আমি সব সময় সেল্তা ভিগোর সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আছি তাদের চিরশত্রু দেপোর্তিভো লা করুনিয়ার সঙ্গে। সবাই জানে তুমি শহর, নারী, কাজ অথবা রাজনৈতিক পছন্দ বদলাতে পারো, এমনকি সম্ভবত উচিতও...কিন্তু তুমি কখনোই দল বদলাতে পারো না। আমি জানি, আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই, বিশ্বাস করো, আমি এটা করেছি আমার সন্তানের জন্য। সে-ই আমাকে বুঝিয়েছে। সম্ভবত আমি একজন বিশ্বাসঘাতক, কিন্তু আমি একজন মহান পিতা।’ —‘ফুটবল, মিথ ও রূপকথা’ গদ্যে ক্লাবের প্রতি সমর্থকের আনুগত্যকে চিত্রিত করেছেন বিশ্বখ্যাত উরুগুইয়ান লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো।
ফুটবলের আবেগ তো এমনই। আবার একই লেখক তাঁর বিশ্বখ্যাত বই ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’তে ফুটবলের উগ্র সমর্থকদের (ফ্যানাটিক) নিয়ে লিখেছেন, ‘খেলা দেখা তাঁর জন্য যেন মৃগীরোগে আক্রান্ত হওয়ার মতো। খেলা তিনি আসলে কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেনই না। গ্যালারিজুড়েই তাঁর সব রাজত্ব। এটাই তাঁর কুরুক্ষেত্র। সেখানে প্রতিপক্ষ দলের ন্যূনতম একজন খেলোয়াড়ের উপস্থিতিও তাঁকে বারুদের মতো উসকে দেয়।’
সমর্থন ও উগ্র সমর্থন—ফুটবল নিয়ে প্রেম ও আবেগ একই মোহনায় কীভাবে ভাগ হয়ে যেতে পারে, তা স্পষ্ট ধরা পড়েছে ওপরের দুটি উদ্ধৃতিতে। এ যেন অনেকটা একই নদীর দুটি আলাদা ঢেউ। কিংবা একই গ্যালারিতে একই পতাকাতলে ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা…।’
একদল আর নিছক সমর্থক থাকেন না, তাঁরা হয়ে ওঠেন উগ্র, কট্টর বা গুন্ডা! ফুটবলে যাঁদের বলে ‘আলট্রাস’। ফুটবল এঁদের কাছে স্রেফ কোনো খেলা নয়। কখনো কখনো সেটা প্রাণঘাতী নেশা কিংবা মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর। এই উগ্র সমর্থকদের যতই নেতিবাচকভাবে দেখা হোক, ফুটবলের অস্তিত্বের সঙ্গে তাঁরা এখন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছেন। এতটাই যে আলট্রা সমর্থকদের ছাড়া ক্লাবগুলোর অস্তিত্বও এখন অকল্পনীয়।
একসময় ফুটবল ছিল শুধুই আনন্দ ও উদ্যাপনের অনুষঙ্গ। কিন্তু সেই ফুটবল জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে চালিত হয়েছে নন্দন থেকে বন্ধনের পথে। একসময় এসে ফুটবল হয়ে উঠল একটি খেলার চেয়েও বেশি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি জড়িয়ে গেল খেলাটির সঙ্গে। এই বদলের সবটাই যে আরোপিতভাবে হয়েছে, তা নয়। এর অনেকটাই হয়েছে একেবারে সহজাতভাবে।
ফুটবলের বিবর্তনের এ ধারায় একপর্যায়ে উত্থান ঘটে দলগুলোর বিশেষ সমর্থকগোষ্ঠীর। অর্থাৎ ক্লাবের সমর্থন এক থেকে তখন বহুতে রূপ নেয়। তবে এটি মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়। সমর্থকদের এই আবেগও একেবারে শিকড়হীন নয়। একটি নির্দিষ্ট ভূমি ও জনগোষ্ঠীর রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রথা এবং যাপনের সঙ্গে এর নিবিড় সংযুক্তি আছে। এ উপাদানগুলো সব সময় তাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে এবং ছায়া হয়ে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে।
বিভিন্ন দেশ ও ক্লাবের সমর্থকগোষ্ঠী নিজেদের আলট্রাসের পথিকৃৎ দাবি করলেও আলট্রাসের অগ্রপথিক বিবেচনা করা হয় ব্রাজিলের ট্রোসিডা অর্গানিজাদাকে। ১৯৩৯ সাল থেকে এই ব্রাজিলিয়ান সমর্থকগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলেও তাদের হাত ধরে সহিংসতার শুরু ১৯৭০-এর দশকে।
বর্তমান সময়ে আলট্রাসের যে ভয়াল রূপকে আমরা দেখি, তার উত্থান ইতালিতে। আলট্রাস শব্দটির উৎসও ফুটবল-সহিংসতার তীর্থভূমি ইতালি। দেশটির সঙ্গে ফুটবলের যোগসূত্র বোঝাতে সাংবাদিক ও সমাজবিদ অলিভেরো বেহা লিখেছিলেন, ‘ইতালি হচ্ছে, এমন প্রজাতন্ত্র, যার ভিত্তি হচ্ছে ফুটবল।’ ইতালির ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এসি মিলানের মালিক সিলভিও বেরলুসকোনি তাঁর রাজনৈতিক দল গঠনের সময়ও নামটি নেন মিলান সমর্থকদের স্লোগান থেকে—‘ফোরজা ইতালি’। যার অর্থ, ‘এগিয়ে যাও ইতালি’।
আলট্রাস ইতালিয়ান শব্দ হলেও এর অর্থ ইংরেজি শব্দ ‘হুলিগান’ শব্দের কাছাকাছি। সোজা বাংলায় যার অর্থ ‘গুন্ডাগিরি’। তবে ইতালিয়ান ও ইংরেজি শব্দের অর্থে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। ইংরেজি শব্দটি নিছক কেবল সহিংসতা ছড়ানোকে বোঝালেও ইতালিয়ান শব্দটির আরও বৃহৎ রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। এর সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র ডানপন্থা এবং বর্ণবাদী আচরণও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এমন উগ্র সমর্থকদের নিয়েই সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার একবার বলেছিলেন, ‘এঁরা সভ্য সমাজের প্রতি অসম্মান।’
আলট্রাস নিয়ে তীব্র সমালোচনা থাকলেও এটি একেবারে ভুঁইফোড় বা বাস্তবতাবিবর্জিত নয়। এর সঙ্গে অর্থনীতির ব্যাপক যোগ রয়েছে। ’৭০-’৮০-এর দশকে করপোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী রূপ দুনিয়াব্যাপী তরুণদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিল। বৈষম্য ও অসমতা সমাজের গভীরে গিয়ে আঘাত করেছিল এবং তরুণেরা দিকনির্দেশনাহীন হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল হতাশার সমুদ্রে। কর্মহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়া যুবকদের জন্য ফুটবল হয়ে ওঠে পরম আশ্রয়স্থল। তখন থেকেই ফুটবলকে আশ্রয় করে সমর্থনের নামে ক্রমেই বিস্তার লাভ করতে থাকে এমন উগ্র কর্মকাণ্ড। তরুণদের বড় একটি অংশ আত্মরক্ষার খাতিরে যোগ দেন ফুটবলীয় উন্মাদনায়।
সমাজবিজ্ঞানী সুসান ফালুদির কাছ থেকে ধার করে ‘হাউ সকার এক্সপ্লেইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে ফ্রাঙ্কলিন ফয়ের সেই উন্মাদ ভক্তদের সম্পর্কে লিখেছেন, এঁরা হলেন সেসব মানুষ, যাঁদের কাজ তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের দিয়ে করানো হচ্ছিল। ফলে নিজস্ব কাজ এবং বাস্তুভিটা হারানো মানুষগুলো নিজেদের পেশিশক্তির প্রদর্শনীর জন্য বেছে নিলেন ফুটবলের গ্যালারিকে। পাশাপাশি সে সময় চলচ্চিত্র, সংগীত এবং ফ্যাশনেও ব্যাপকভাবে দেখা গেল গ্যাংস্টারইজমের প্রভাব। এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে মাদককেও। এসব অনুষঙ্গ তখনকার তরুণ সমাজকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। যে কারণে শুরুতে আলট্রাস সংস্কৃতি সাব-কালচার হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও একসময় তা পুরোপুরিভাবে কেন্দ্রে জায়গা করে নেয়।
আলট্রাস নিয়ে তীব্র সমালোচনা থাকলেও এটি একেবারে ভুঁইফোড় বা বাস্তবতাবিবর্জিত নয়। এর সঙ্গে অর্থনীতির ব্যাপক যোগ রয়েছে।
‘আলট্রা: দ্য আন্ডারওয়ার্ল্ড অব ইতালিয়ান’ ফুটবলের লেখক তোবিয়াস জোনসও আলট্রাস সমর্থকদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি অবশ্য ফুটবলের সঙ্গে উগ্র সমর্থকদের কোনো সম্পর্কই দেখেননি। তাঁর ভাষ্যে, ‘অনেক আলট্রাস সমর্থক ফুটবল নিয়ে থোড়াই ভাবেন। তাঁরা যা করেন, তা হলো জায়গা দখল, রং নিয়ে হোলি খেলা এবং মারামারি। আপনি পাশে বসে থাকা আলট্রা সমর্থককে জিজ্ঞেস করুন গোল কে করেছে? দেখবেন, একটা হাসি দেবেন। তাঁরা এমনকি খেলাটাও ঠিকঠাক দেখেন না। এসব নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।’
বিল বুফোর্ডের ‘অ্যামং দ্য থাগস’ বইয়েও উঠে এসেছে ‘আলট্রাস’দের সর্বগ্রাসী চিত্র। ফুটবলের ছায়ায় হেন কোনো অপকর্ম নেই, তাঁরা করেন না। বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে পুলিশ পর্যন্ত তাঁদের কিছু বলার সাহস পায় না। ফলে ইউরোপে শনিবারগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বিধ্বস্ত ট্রেন, পাবগুলোর ভাঙা জানালা, ভাঙচুরের শিকার হওয়া গাড়িগুলোর কাচ, এমনকি আগ্রাসনের ভয়ে কুঁকড়ে থাকা বাতাস পর্যন্ত এসব তাণ্ডবের সাক্ষী।
ইতালি থেকে যাত্রা শুরু করলেও এটি ধীরে ধীরে দক্ষিণ ইউরোপ থেকে চালিত হয় উত্তর ইউরোপের দিকে। একপর্যায়ে সমর্থনের এই রূপ লাইফস্টাইল এবং পপ-কালচারের অংশ হয়ে ওঠে। উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর এশিয়ার পাশাপাশি উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায়ও এর বিস্তার ঘটে। ব্যানার, বাদ্যযন্ত্র এবং তিফোগুলো হয়ে ওঠে এসব সমর্থকের আত্মপরিচয়ের অংশ। ফুটবল গ্যালারিকে তাঁরা পরিণত করেন বিশালাকার এক ক্যানভাসে। তবে ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক যতই শীতল থাকুক, এটি যে খেলোয়াড়দেরও ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে, সেটা কিন্তু মিথ্যা নয়। সমর্থকদের গলার আওয়াজ স্তিমিত হতে দেখলে ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো কোচের কণ্ঠেও শোনা যায় আক্ষেপের সুর।
আগেই বলা হয়েছে, ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে উগ্র ফুটবল সমর্থকদের বোঝাতে এ টার্মটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালিয়ান সমাজে চলছিল রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং স্পোর্টিং ইভেন্টগুলো ছিল রাজনৈতিক বিভেদের একধরনের সম্প্রসারণ। ফলে ক্লাবের সমর্থকেরা স্থানীয় রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে একধরনের মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেন। যেমন মিলানের ক্লাব এসি মিলান প্রতিনিধিত্ব করত শ্রমিকশ্রেণির। বিশেষ করে রেলশ্রমিকদের। ক্লাবটি ছিল মূলত বাম ধারার।
একই শহরের অন্য ক্লাব ইন্টার মিলান আবার মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ছিল এবং রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত ছিল। ফলে ক্লাবের সমর্থন ও রাজনৈতিক মতাদর্শ মিলে সমর্থনের নতুন এক ধারার সৃষ্টি হয়। আর এই দুটি ভিন্ন ধারার স্রোত গিয়ে মিলিত হতো ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে গিয়ে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহে ফুটবল সমর্থনের এই গুন্ডাতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। যা বেশির ভাগ সময় খেলাধুলার স্পিরিটকেও ছাড়িয়ে যায়। ফুটবলে এর প্রভাব এতটাই মারাত্মক যে দিগ্বিদিক হারানো উগ্র সমর্থকেরা অনেক সময় প্রতিপক্ষ সমর্থক, খেলোয়াড় এমনকি নিজ দলের খেলোয়াড়দের ওপর হামলা চালাতেও দ্বিধা বোধ করেন না। অবশ্য খুব বেশি না হলেও এসব হামলার কারণে শাস্তির উদাহরণ কিছু রয়েছে। আছে মাঠে নিষিদ্ধ হওয়ার দৃষ্টান্তও। এসব নিয়ে অবশ্য ভাবার সময় কই আলট্রাদের!
উগ্রতা আলট্রা সমর্থকগোষ্ঠীর সহজাত বৈশিষ্ট্য হলেও তাঁরা কিন্তু বিচ্ছিন্ন শক্তি নন। তাঁরা যথেষ্ট সংগঠিত ও ক্ষমতাসম্পন্ন। ক্লাবগুলোও অনেক ক্ষেত্রে আলট্রাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ এবং অনেকে ক্লাব থেকে টাকাও পেয়ে থাকে। এমনকি ম্যাচ টিকিট থেকে শুরু করে ক্লাবের কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকে তারা। ক্লাবগুলো নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারেও অনেক সময় তাদের ব্যবহার করে। তবে সহিংসতাই যে আলট্রাস হওয়ার পূর্বশর্ত, তা-ও কিন্তু নয়। ফুটবলের গতিপ্রকৃতি এবং তাৎক্ষণিকতার কারণেই বেশির ভাগ সময় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। আবার অনেক সময় প্রদর্শনবাদিতা থাকে তাঁদের মূল লক্ষ্য। উদাহরণ হিসেবে নাপোলির আলট্রার সমর্থকদের কথা বলা যায়। ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ দলের পতাকা কফিনে জড়িয়ে শেষকৃত্যের মিছিল নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেখা যায় তাঁদের। এটি প্রদর্শনবাদিতা ছাড়া আরকি!
গত ৫০ বছরে স্টেডিয়ামপাড়াগুলো নানাভাবে আলট্রাদের উল্লাসের শব্দে ও নারকীয় চিৎকারে প্রকম্পিত হয়েছে। এসব উগ্র সমর্থকই ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ক্যামেরুন হারার পর গোলকিপার জোসেফ বেলের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ভয়ংকর এই সমর্থকদের কারণেই ১৯৯২ সালে মিসরের কাছে হারের পর ইথিওপিয়ার খেলোয়াড়েরা জাতিসংঘের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। আর গত বছর আল্ট্রাদের অত্যাচারে বিষিয়ে উঠেছিল মার্শেই ক্লাবের কর্তাদের জীবন। কোচকে বিদায় নিতে হয়েছিল এবং সাময়িকভাবে পদ ছাড়তে হয়েছিল ক্লাব প্রধানকে। যেন ক্লাবের শাসক এই সমর্থকেরাই।
এই তো কিছুদিন আগেও পিএসজি আলট্রাদের অত্যাচারে জীবন নরক হয়ে উঠেছিল লিওনেল মেসি ও নেইমারের। মাঠে দুয়ো দেওয়ার পর নেইমারের বাসার সামনে অবস্থান নিয়েও ক্লাব ছাড়ার দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা। এ দুজনের ক্লাব ছাড়ার পেছনে এমন সমর্থকদের দায়ও তাই কম ছিল না। রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বর্ণবাদের নিশানা হওয়ার পেছনেও আছেন এই উগ্র সমর্থকেরা। ভিনিসিয়ুস যেখানে ভ্রমণে গেছেন উগ্র বর্ণবাদী সমর্থকদের হাতে পড়ে নাজেহাল হয়েছেন। মূলত সামাজিক অনাচার, অন্যায় এবং অপরাধকে একটি সর্বজনীন রূপ দেন আলট্রা সমর্থকেরা। যে কারণে দেশ বা ক্লাব কিংবা পক্ষ বদলে গেলেও বদলায় না এই সমর্থকদের চরিত্র। গায়ের জার্সির রং যা-ই হোক, বৈশিষ্ট্যে সবাই এক।
এসব সমর্থকের কারণে দলগুলোকেও পড়তে হয় বিপাকে। রিয়ালের সবচেয়ে উগ্রপন্থী ভক্ত দল ‘আলট্রাস সার’ নামে পরিচিত। তাদের আচরণে ত্যক্ত হয়ে ২০১৩ সালে নিষিদ্ধ করা হয় গোষ্ঠীটিকে। তবে ধারণা করা হয়, ভেতরে-ভেতরে নাকি রিয়ালের সঙ্গে ঠিকই আঁতাত আছে ওঁদের। এমনকি রিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোয় তাদের নাকি ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানান ক্লাব সভাপতি নিজেই। অদ্ভুতুড়ে সম্পর্ক বটে!
খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যের কারণে পরিচিতি খুব বেশি না হলেও বৈশ্বিকভাবে ‘রেড স্টার বেলগ্রেড’কে সবাই চেনে তাদের উগ্র ভক্তদের জন্য। গত কয়েক দশকে অসংখ্যবার সার্বিয়ান ক্লাবটির পক্ষে সমর্থকদের রাস্তায় নেমে এবং গ্যালারিতে এসে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে দেখা গেছে। এই সমর্থকদের অনেককে ডাকা হয় ‘দ্য দেলিজে’ নামে। ফয়ের তাঁর লেখা বই ‘হাউ সকার এক্সপ্লেইন দ্য ওয়ার্ল্ডে’ রেড স্টার বেলগ্রেডের উগ্র সমর্থকদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, ‘রেডস্টার বেলগ্রেডের এই সমর্থকেরা ক্লাব থেকে বিশেষ মর্যাদা পান।
সমর্থক-নেতারা ক্লাবের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন ভাতাও। দলের প্রধান দপ্তরে সেই নেতাদের অবাধ যাতায়াতের অনুমতি রয়েছে। দলের ওপর এসব সমর্থকের প্রভাব অসামান্য। তাঁদের ক্ষমতা এতই প্রবল যে দল হেরে গেলে অনুশীলনে গিয়ে খেলোয়াড়দের পিটিয়েও আসতে পারেন। খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁদের বার্তা থাকে স্পষ্ট, ‘মাঠে কোনো ধরনের হেলাফেলা সহ্য করা হবে না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে উগ্র সমর্থকদের গতিবিধি আর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেই আটকে নেই। ফেসবুক, এক্স কিংবা ইনস্টাগ্রামেও দেখা যায় তাঁদের অবাধ বিচরণ। ফলে ট্রলিংও সহিংসতার নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তুরস্কের ক্লাব গ্যালাতাসারাইয়ের মাঠ টার্ক ট্যালকম অ্যারানায় প্রতিপক্ষকে ‘নরকে স্বাগত’ জানিয়ে বরণ করা হয়। সবচেয়ে জোরে চিৎকার করতে পারা সমর্থক হিসেবে এই ক্লাবের ভক্তরা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও জায়গা করে নিয়েছে। এই উগ্র সমর্থকদের আরেকটি অংশ পরিচিতি ‘দ্য নাইট ওয়াচম্যান’ নামে।
আর্জেন্টাইন ফুটবল লিগে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকেরাও দাঙ্গা-হামলায় পিছিয়ে নেই। বিশ্বজুড়ে কট্টরপন্থী এই সমর্থকেরা পরিচিত ‘এল ১২’ নামে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেটের সঙ্গে সব বিরোধে জড়িয়ে সংবাদের শিরোনামে আসেন তাঁরা। তাঁদের কর্মকাণ্ড অবশ্য কেবল ফুটবল মাঠেই আটকে থাকে না। দাঙ্গা-হাঙ্গামার পাশাপাশি অর্থ পাচার, গোলাগুলি এবং লুটতরাজের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সিদ্ধহস্ত সমর্থকেরা।
উগ্র সমর্থকদের কথা বলা হবে আর সেখানে বার্সেলোনার ‘বক্সিস নোইস’ (দ্য ক্রেজি বয়েজ) আসবে না, তা হয় নাকি। ১৯৮০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে আলট্রাদের উত্থানের সমান্তরালে আবির্ভাব ঘটে বক্সিস নোইসের। এরপর থেকে বার্সাকে সমর্থনের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামাতেও নিজেদের পরিচিত করে তুলেছেন তাঁরা। ২০০৩ সালে ক্যাম্প ন্যুতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁদের। কিন্তু সমর্থন কি আর নিষেধ মানেন! এখনো বিভিন্নরূপে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
মোহাম্মদ সালাহর কারণে ফুটবল-দুনিয়ায় মিসর আরও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেকে তাঁদের ‘আল মাসরি’র সমর্থকদের কারণেও চেনেন। অনেকের কাছে ‘আল মাসরি’ই ফুটবল-দুনিয়ার এক নম্বর দাঙ্গাবাজ সমর্থক। এই সমর্থকগোষ্ঠী কতটা ভয়ংকর, একটি তথ্য দিয়ে সেটা বোঝা যেতে পারে। ২০১২ সালে আরেক মিসরীয় ক্লাব আল-আহলিকে ৩-১ গোলে হারানোর পর দাঙ্গা বাধায় মাসরি। সেই দাঙ্গার ঘটনায় নিহত হন ৭ জন সমর্থক, আহত হন হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিদ্বন্দ্বী সমর্থকদের ওপর এমন নৃশংস হামলার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসেই বিরল ঘটনা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে উগ্র সমর্থকদের গতিবিধি আর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেই আটকে নেই। ফেসবুক, এক্স কিংবা ইনস্টাগ্রামেও দেখা যায় তাঁদের অবাধ বিচরণ। ফলে ট্রলিংও সহিংসতার নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যেখানে মেসি-ভক্তদের হাতে রোনালদোকে তুলাধোনা হতে দেখা কিংবা রোনালদো-ভক্তদের ‘সিউ’তে মেসিকে নাকানি খেতে দেখা তো এখন নিয়মিত ব্যাপার। এই তো কদিন আগে এমবাপ্পেকে পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে বানানো একটি ব্যানারের ছবি ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেখানে লেখা ছিল, ‘কেএম (কিলিয়ান এমবাপ্পে): ৩০ জুনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি।’
৩০ জুন পিএসজির সঙ্গে এমবাপ্পের চুক্তি শেষ হবে এবং এরপর তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যাবেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এখন বাকি সময়ে এই আলট্রাদের হাতে বিষিয়ে যেতে পারে এমবাপ্পের জীবন। এই আশঙ্কা থেকেই কিনা, এমবাপ্পের প্রতিনিধিরা আলট্রাদের অনুরোধ করেছে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগপর্যন্ত তারা যেন শান্ত থাকে। এমন আবেদনে শেষ পর্যন্ত সমর্থকেরা সাড়া দেবেন বলে অবশ্য মনে হচ্ছে না। চুক্তির খবর ফাঁস হওয়ার পর থেকে এমবাপ্পে নিজেও এমন কিছুর আশঙ্কা করছেন।
সন্দেহ নেই, দু-একটি ছাড়া আলট্রাদের বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডই নেতিবাচক। সহিংসতা এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামাই তাঁদের মূল বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি এটি যে আধুনিক সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা, তা-ও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সমাজের অন্য ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গেও রয়েছে এর সংযুক্তি। নানামুখী বৈষম্যে নিষ্পেষিত মানুষগুলো ফুটবলের গ্যালারিকেই বেছে নেন নিজেদের অবদমিত রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও অপ্রাপ্তিকে উগরে দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে। গগনবিদারী চিৎকারগুলো অনেক সময় ম্লান করে দেয় ফুটবলের চোখধাঁধানো সৌন্দর্য। তবু অস্বীকার করা যায় না।