ব্রাজিলিয়ানরা কেন বিদেশি কোচ চায়, কেন চায় না
র্যামন প্লাতেরো খুব পরিচিত কেউ নন। ১৮৯৪ সালে উরুগুয়ের মন্টেভিডিওতে তাঁর জন্ম। আর ১৯৫০ সালে মারা যান ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। ৫৫ বছরের জীবনে কয়েকটি দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন, বলার মতো সাফল্য উরুগুয়ের হয়ে ১৯১৭ সালের দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা। আপাতদৃষ্টে তাঁর ক্যারিয়ারটাকে সাদামাটাই বলা যায়। তবে হঠাৎ করে মৃত্যুর ৭৩ বছর পর ইতিহাসের গলিঘুপচি থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছেন প্লাতেরো।
ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলে যখন বিদেশি কোচ নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বিভক্তি, তখন ফিরে তাকাতে হচ্ছে উরুগুয়ের কোচের দিকে। প্লাতেরোই যে ব্রাজিলের প্রথম বিদেশি কোচ। ১৯২৫ সালে দায়িত্ব নিয়ে ব্রাজিলের হয়ে ৪ ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন প্লাতেরো। এরপর আরও দুজন বিদেশি কোচ ব্রাজিলকে কোচিং করিয়েছেন। যার মাঝে একজন আর্জেন্টাইনও আছেন।
তবে পর্তুগালের জোরেকা ব্রাজিলের কোচ ছিলেন দুই ম্যাচে এবং একটি প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন আর্জেন্টিনার ফিলপো নুনেস। শুক্রবার রাতে গুঞ্জন উঠেছিল ইতালিয়ান কোচ কার্লো আনচেলত্তি ব্রাজিলের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। যদিও পরের ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) এই খবর অস্বীকার করেছে। তবে ব্রাজিলের কোচ নিয়োগে স্বদেশি–বিদেশি বিতর্ক এখন বাস্তবতা।
ব্রাজিল জাতীয় দলে বিদেশি কোচের অংশগ্রহণ থাকলেও তা বলার মতো কিছু নয়। আগের তিন বিদেশি কোচ মিলে ব্রাজিলকে কোচিং করিয়েছেন মাত্র সাত ম্যাচ। এই নামগুলো ব্রাজিলের ফুটবলকে সে অর্থে প্রতিনিধিত্বও করে না। তাঁরা কোচ হয়েছিলেন মূলত ঘটনাচক্রে। ১৯৬৫ সালের পর আর কখনো ব্রাজিলের ডাগআউটে বিদেশি কোচের কর্তৃত্ব দেখা যায়নি। আর এই লম্বা সময়ে ব্রাজিলের ফুটবলও অন্য এক উচ্চতা স্পর্শ করেছে। সাফল্য এসে পায়ে লুটিয়েছে। তৈরি হয়েছে ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ ধারা। যেখানে তাদের সবকিছুই হয়েছে ব্রাজিলীয় সূত্র মেনে। ফুটবলকেই নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে তারা।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের টানা ব্যর্থতা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। দেশীয় কোচকে আঁকড়ে ধরে রাখার জায়গা থেকে সরে এসে অনেকে বিদেশি কোচকেই সাফল্যের ক্রীড়নক ভাবতে শুরু করেছেন। তবে সবাই যে এমনটা ভাবছেন, তা নয়। একটা অংশ মনে করছেন, বিদেশি কোচ ব্রাজিলের ফুটবল–সংস্কৃতির ওপর আঘাত। এটাকে দেশের ফুটবলের জন্য অপমান বলেও মনে করছেন তাঁরা। এমনকি দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলাররাও এ ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত।
বিভিন্ন সময় ব্রাজিলের ফুটবলে বিদেশি কোচের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা হলেও এটি বিতর্ক আকারে সামনে আসে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ব্রাজিলের বিদায়ের পর। ব্যর্থতার দায়ে তিতে সরে দাঁড়ানোর পর ব্রাজিলের নতুন কোচ হিসেবে শোনা যায় জোসে মরিনহো, কার্লো আনচেলত্তি, লুইস এনরিকেসহ বেশ কয়েকটি নাম। এরপরই শুরু হয় বিতর্ক। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিও বিদেশি কোচ নিয়োগকে স্বাগত জানান।
ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বলেছেন, ‘আমি ব্রাজিলের কোচ হিসেবে গার্দিওলা, আনচেলত্তি এবং মরিনহোর মতো কোচ দেখতে পছন্দ করব।’ আরেক কিংবদন্তি রিভালদো এই প্রস্তাবকে রীতিমতো ধুয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমাদের দলের জন্য বিদেশি কোচ নিয়ে আসা ব্রাজিলিয়ান কোচদের জন্য অসম্মানজনক। আমি মনে করি, আমাদের এমন কোচ আছে, যারা ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নিতে এবং ভালোভাবে কাজ করতে সক্ষম।’
ব্রাজিলের বিদেশি কোচ নিয়ে শুধু ফুটবলাররাই নন, সমর্থকেরাও দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ মনে করছেন, ব্রাজিলে ফুটবলকে বড় সাফল্য হতে হলে এখনো কোচ নিয়োগের জাতীয়তাবাদী ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্রাজিল দলে তারকার অভাব নেই। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ পাঁচ লিগে দাপুটে পারফরম্যান্সে মাঠ মাতাচ্ছেন ব্রাজিলীয়রা। কিন্তু জাতীয় দলে নিজেদের সেই সামর্থ্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না তারা। কিন্তু কেন?
ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলা ফুটবলাররা মূলত ইউরোপে খেলে থাকেন। যেখানে তাঁরা বিদেশি কোচদের চিন্তা–চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে নিজেদের একীভূত করে নিয়েছেন। পাশাপাশি ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলের মান এখন আর আগের মতো নেই। একসময় পেলে–সক্রেটিসদের মতো কিংবদন্তিরা ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলে নিজেদের ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়েছেন। সেই একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বিশ্বমানের কোচও বেরিয়ে এসেছে।
মারিও জাগালো, কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা নিজেদের ফুটবল–দর্শনকে মাঠে দারুণভাবে রূপান্তর করে দেখিয়েছেন। যার সর্বশেষ প্রতিনিধি ছিলেন লুইস ফেলিপে স্কলারি। যাঁর হাত ধরে ২০০২ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল সেলেসাওরা। তবে স্কলারির ফুটবল–দর্শনও একসময় অচল হয়ে পড়ে।
২০১৪ সালে নিজ দেশের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে ৭–১ গোলে হেরে ব্রাজিল যখন বিদায় নিচ্ছিল তখন ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা কোচটিও ছিলেন স্কলারি। জার্মানি তথা ইউরোপিয়ান পাওয়ার ফুটবলের সামনে সেদিন অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রাজিল। কেউ চাইলে স্কলারিকে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কোচদের উত্থান ও পতনের প্রতীক হিসেবে ধরে নিতে পারে।
এরপর যাঁরাই এসেছেন, বিদায় নিয়েছেন শূন্য হাতে। যার সর্বশেষ সংযোজন তিতে। কাতার বিশ্বকাপে ফেবারিট তকমা নিয়েও শেষ আটের বাধা পেরোতে না পারার কারণ হিসেবে তিতে কৌশলগত ভুলকে দেখেন অনেক ব্রাজিলিয়ান সমর্থক। যাঁদের অনেকে মনে করেন, ব্রাজিলীয় ফুটবলকে সাফল্যের ধারায় ফেরাতে পারে ইউরোপীয় তথা বিদেশি কোচরা। এমনকি ২০১০ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর ব্রাজিলের শীর্ষ ক্রীড়া সাংবাদিক জুকা কেফুউরি বলেছিলেন, ‘আমি বিদেশি কোচে কোনো সমস্যা দেখি না।’ যদিও পরবর্তী সময়ে দেশের কোচদের ওপরই ভরসা রেখেছিল ব্রাজিল।
গত কয়েক দশকে ইউরোপে কোচিংয়ের ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। ফুটবলীয় কৌশলেও এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। সাম্প্রতিক সময়ে জার্মান কোচদের আধিপত্য দেখা গেছে। যার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না ব্রাজিলিয়ান কোচরা। ২০০২ সালের পর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে ইউরোপীয় দলগুলোর কাছেই হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে অনেকেই ভরসা রাখতে চাচ্ছেন ইউরোপীয় কোচে।
বিপরীত যুক্তিও অবশ্য কম নেই। যেখানে রিভালদোর মতো অনেকে মনে করেন, বাইরে থেকে কোচ আনা ব্রাজিলের ফুটবলের জন্য অপমানজনক। তাঁরা মনে করেন, বিদেশি কোচ এলে ব্রাজিলের ফুটবলের যে সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়, সেখান থেকে অনেক দূরে ছিটকে যাবে। ব্রাজিলের ফুটবল মানেই সাম্বার নৃত্য ও জোগো বনিতো। এমনকি কাতার বিশ্বকাপেও একাধিকবার সেই ‘জোগো বনিতো’ মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে ব্রাজিল। নিজেদের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই বৈশিষ্ট্যকে হারাতে রাজি নন অনেক ব্রাজিল সমর্থক।
তবে বিশেষ কয়েকটি মুহূর্তকে বাদ দিলে ব্রাজিল গত দুই দশকে কি আসলেই সেই সুন্দর ফুটবল খেলতে পেরেছে? দুঙ্গা যখন কোচ ছিলেন, তখনই ব্রাজিলের ফুটবলের ধরন দিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আর ফল না এলে সুন্দর ফুটবলও শেষ পর্যন্ত মানুষ আর মনে রাখে না। সেটিই হয়তো এখন ব্রাজিলকে বিদেশি নিয়োগের দিকে চালিত করছে।