অধিনায়ককে শেষবিদায় জানাল মোহামেডান
মোহামেডান ক্লাব টেন্টের সামনেই ছায়াঘেরা এক চিলতে উঠান। সেখানেই চেয়ার পেতে বসে সাবেক খেলোয়াড়, কর্মকর্তারা আড্ডায় মাতেন। জাকারিয়া পিন্টুও বহুবার সেখানে বসে গল্পে মেতেছেন তাঁর সতীর্থদের সঙ্গে; এখানেই তাঁর কত বছরের স্মৃতি! আজ সকালেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক মোহামেডান ক্লাবে এলেন। কিন্তু নীরব-নিথর দেহে।
যে ক্লাবে ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খেলেছেন, যে ক্লাবের অধিনায়কত্ব করেছেন ১৯৬৯ সাল থেকে টানা ১৯৭৫ পর্যন্ত, সেই ক্লাবই আজ তাঁকে চিরবিদায় জানাল। তাঁর দ্বিতীয় জানাজায় উপস্থিত ছিলেন সাদাকালো শিবিরের সাবেক, বর্তমান খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অনন্য অবদান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। মোহামেডান ক্লাবেই জানাজার আগে দেওয়া হয়েছে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান।
মৃত্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষকে এক জায়গায় করার উপলক্ষও হয়ে ওঠে। আজ সকালে মোহামেডান ক্লাবেও ব্যতিক্রম ছিল না। জাকারিয়া পিন্টুর সঙ্গে মাঠে যাঁরা খেলেছেন, তাঁদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। জাকারিয়া পিন্টুর স্মৃতিচারণা করলেন তাঁরা।
গোলাম সারোয়ার টিপু যেমন বললেন, ‘পিন্টু ভাই খুব শৃঙ্খলাপরায়ন ফুটবলার ছিলেন। নিজেকে সব সময় ফিট রাখতেন। খেলোয়াড়ি জীবনে বলতে গেলে চোটে পড়েনইনি। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের সত্যিকারের কিংবদন্তি। তিনি সৌভাগ্যবান, এ দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে জাকারিয়া পিন্টুর অধিনায়কত্বে খেলেছে আশরাফ আলী, খেলেছেন মোহামেডানেও। স্বাধীনতার পর অবশ্য আবাহনীর জার্সিতে জাকারিয়া পিন্টুর প্রতিপক্ষ হয়েছেন। তাঁর কথা, ‘আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক পিন্টু ভাই। মাঠে কোনো দিন তাঁর মুখ থেকে কোনো কটূ কথা শুনিনি। কাউকে বকা দিয়েছেন, সেটাও দেখিনি। সিনিয়র হিসেবে ছিলেন খুবই স্নেহশীল।’
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানের কাছে পিন্টু যেন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের সমার্থক, ‘জাকারিয়া পিন্টু বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের অনেক বড় নাম। স্বাধীনতার আগে জাকারিয়া পিন্টু মানেই আমাদের ক্রীড়াজগৎ। তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবেই অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন, এ দেশের ইতিহাসে।’
মোহামেডান ক্লাবে তাঁর জানাজায় উপস্থিত ছিলেন মোহামেডানের সাবেক অধিনায়ক মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন। পাকিস্তান জাতীয় দলে এক সঙ্গে খেলেছেন, মোহামেডান ক্লাবেও ছিলেন সতীর্থ। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘জাকারিয়া পিন্টু এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়। তাঁর সঙ্গে অনেক স্মৃতি। পাকিস্তান জাতীয় দলের সতীর্থ ছিলাম আমরা, মোহামেডানে তো ছিলামই। তাঁর সঙ্গে ইরান ও তুরস্কে খেলতে যাওয়ার স্মৃতি কখনো ভুলব না। তাঁকে আজ বিদায় জানাতে এসেছি, আমরা সবাই আজ বিষাদগ্রস্ত।’
ক্লাব প্রাঙ্গণে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টুর দীর্ঘদিনের বন্ধু, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ–অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা। ইমতিয়াজ সুলতান জনি তাঁর হাত ধরে নিয়ে আসেন বন্ধুর মরদেহের সামনে। প্রতাপ শংকর হাজরার হাতে তুলে দেন একটি ফুলের তোড়া।
বন্ধুর মরদেহে সেটি রাখার সময় স্বাভাবিকভাবেই আবেগাপ্লুত ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। বন্ধু সম্পর্কে বললেন, ‘আমার অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে গেছে। কাকে হারালাম আমিই বুঝি। আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সতীর্থ। কত শত স্মৃতি। খুব শিগগির পিন্টুর সঙ্গে দেখা হবে ওপারে।’
আবেগাপ্লুত হাসানুজ্জামান বাবলুও, ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গে ঘুরেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময়। পিন্টু ভাই আমার বড় ভাই, খুব আদর করতেন। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কত বড় ছিলেন, সেটা শুধু তাঁর খেলা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন।’
মোহামেডান ক্লাবে নামাজে জানাজার আগে ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁর মরদেহে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল মুবীন, মোহামেডানের ফুটবল কমিটির প্রধান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর ও ক্লাবের আজীবন সদস্য মোসাদ্দেক আলী।
তাঁকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান মোহামেডানের সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়েরা, মোহামেডান সমর্থক দল। জানাজার ঠিক আগে দিয়ে তাঁর মরদেহের ওপর রাখা হলো মোহামেডানের সাদা-কালো পতাকা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা তো ছিলই। জাতীয় পতাকার সঙ্গে মোহামেডানের পতাকাটা যেন ছিল দীর্ঘদিনের সারথির প্রতি ক্লাবের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।