রয়েস-হুমেলস: চক্রপূরণ শেষে এবার কি স্বপ্নপূরণ
পার্ক দে প্রিন্সেসে শেষ বাঁশি বাজার পর গ্যালারির হলুদ অংশের দিকে ছুটলেন মার্কো রয়েস। উন্মাতাল হলুদ শিবিরও রয়েসকে পারলে নিজেদের কাছে রেখে দেয়! কিন্তু সেটি তো সম্ভব না। মাত্র চার দিন আগেই রয়েস জানিয়ে দিয়েছেন, মৌসুম শেষেই বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ছাড়বেন। আনন্দে উদ্বেলিত রয়েসকে দেখলে তখন মনে হবে, চলে যাওয়ার আগে ডর্টমুন্ড সমর্থকদের মনে মায়া বাড়াচ্ছেন!
কিংবা আরেকটি দৃশ্য। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন ম্যাটস হুমেলস। যাঁর একমাত্র গোলেই পিএসজির মাঠে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগটা জিতেছে ডর্টমুন্ড, উঠে গেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। কোত্থেকে রয়েস এসে তাঁর বুকে দুটো চাপড় মারলেন। খুব ব্যথা লেগেছে—এমন ভঙ্গি করে সঞ্চালককে হুমেলস বললেন, ‘যতটা ভাবছেন সে তার চেয়েও শক্তিশালী।’ রয়েস নিজেও সম্ভবত হুমেলসের এ কথার বিরোধিতা করবেন না। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে বড় বড় ক্লাবের হাতছানি উপেক্ষা করে ভালোবাসার ক্লাবে থেকে যেতে যে বহুত দম লাগে! আর তাতেই জন্ম হতে পারে অবিশ্বাস্য এক গল্পের। অবশ্য সেটি রয়েস ও ডর্টমুন্ডের ভালোবাসার গল্পের শেষ অঙ্কে গিয়ে মিলতেও পারে, না-ও পারে! কিন্তু গল্পটা এরই মধ্যে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাই বা কম কী!
ডর্টমুন্ড একাডেমির ছাত্র রয়েস সিগন্যাল ইদুনা পার্কে ফিরে এসেছিলেন ২০১২ সালে। ক্লাবটির মূল দলে ২০১২-১৩ ছিল তাঁর প্রথম মৌসুম। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওয়েম্বলিতে হারতে হয় বায়ার্ন মিউনিখের কাছে। ১১ বছর পর ১ জুন সেই ওয়েম্বলিতেই ডর্টমুন্ডের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলবেন রয়েস, আর সেটি হবে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল! আনন্দের আতিশয্যে রয়েস সম্ভবত এ কারণেই টোকা মেরেছেন সতীর্থের বুকে, যেন অনুচ্চারে বলতে চেয়েছিলেন, ‘দেখো, আমরা পেরেছি!’
হুমেলসের গল্প একটু আলাদা। তবে মিলেছে রয়েসের বিন্দুতেই। হুমেলস বায়ার্ন একাডেমির ছাত্র। অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারিনা ও সিগন্যাল ইদুনা পার্কের ক্লাব দুটির বাইরে অন্য কোথাও খেলেননি। ডর্টমুন্ডের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় (২০১২-১৩) সেই মৌসুমে হুমেলস ‘প্রুশিয়ানস’দের শিবিরেই ছিলেন। ১১ বছর আগে ওয়েম্বলির ফাইনালে সেই হারে রয়েসের সঙ্গে কেঁদেছিলেন হুমেলসও। ভাগ্যের কী মধুর রসিকতা, ডর্টমুন্ডের সেই দলটি থেকে মাত্র দুজন অবশিষ্ট আছেন এই দলে। সেটাও এই রয়েস ও হুমেলস-ই। সেই ওয়েম্বলিতেই ইউরোপসেরার শিরোপার জন্য আরও একবার ঝাঁপাবেন দুজন। একে ঠিক কী বলবেন? চক্রপূরণ? যা খুশি বলতে পারেন, তবে এই চক্রপূরণের মধ্যেও আছে আরেক চক্রপূরণের গল্প। সেটি হুমেলসের গল্প।
চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে ২০১৬ সালে ডর্টমুন্ড ছেড়ে বায়ার্নে যোগ দিয়েছিলেন হুমেলস। স্বপ্নপূরণ হয়নি। ২০১৯ সালে ফিরতে হয় ডর্টমুন্ডে। এখন সেই হুমেলস স্বপ্নপূরণ থেকে মাত্র ৯০ মিনিট সময়ের দূরত্বে। সেটাও কী দারুণভাবে! পার্ক দে প্রিন্সেসে গতকাল রাতে সেমিফাইনাল ফিরতি লেগে সতীর্থদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পিএসজির একের পর এক আক্রমণ নস্যাৎ করেছেন এই সেন্টারব্যাক। এমবাপ্পেকে করা সেই ট্যাকলটি—ডর্টমুন্ডের জন্য নিবেদিত প্রাণ না হলে এমন হয় না।
ভাগ্যও যে সহায় হয়নি সেটাও নয়। দ্বিতীয়ার্ধে উসমান দেম্বেলেকে যে ফাউলটা করলেন, সেটা পেনাল্টি বক্স থেকে মাত্র কয়েক মিলিমিটার বাইরে ছিল। কিন্তু কথায়ই তো আছে, ভাগ্য কাপুরুষ নয়, সাহসীদের সহায় হয়। রয়েস যেমন নিজের সেরা সময়ে বড় ক্লাবগুলোকে সাহসের সঙ্গে না করেছেন, হুমেলসও তেমনি ডর্টমুন্ডের জন্য প্রতিপক্ষকে ফেলে দিতে কার্পণ্য করেননি। আর তাতেই দুজনের নামের পাশে লেখা হলো ‘রিটার্ন টু ওয়েম্বলি’!
ডর্টমুন্ড কোচ এদিন তেরজিচ ম্যাচ শেষে প্রাপ্য সম্মানটাই দিলেন দুই তারকাকে, ‘গত কয়েক বছরে আমাদের পাওয়া সাফল্যে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ম্যাটস (হুমেলস) চ্যাম্পিয়নস লিগে সব ম্যাচেই শুরু থেকে খেলেছে। সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা এতেই বোঝা যায়।’ আর রয়েসের ব্যাপারটি তেরজিচের কাছে ‘চক্রপূরণ।’ তবে তেরজিচের পরের কথায় বোঝা যায় শুধু রয়েস নয়, চক্রপূরণ হুমেলসের জন্যও, ‘তারা দুজন যেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের দুঃখমোচনের সুযোগ পায় সে জন্য সবাই নিজেদের সবকিছু বাজি ধরেছে। আমরা তাদের নিয়ে অবিশ্বাস্যরকম খুশি।’
পিএসজি, এসি মিলান ও নিউক্যাসলের সঙ্গে একই গ্রুপে পড়েছিল ডর্টমুন্ড। জার্মান ক্লাবটি গ্রুপপর্ব পেরোতে পারবে কি না, তা নিয়েই অনেকে সন্দিহান ছিলেন। এর মধ্যে আবার এই পার্ক দে প্রিন্সেসেই নিজেদের প্রথম ম্যাচে পিএসজির কাছে হেরেছিল ডর্টমুন্ড। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, ডর্টমুন্ড চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে খেলার স্বপ্ন দেখেছে গ্রুপপর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে! হুমেলস নিজেই সে কথা বলেছেন আমাজন প্রাইমকে, ‘দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই আমরা বিশ্বাস করেছি চ্যাম্পিয়নস লিগে এটা (ফাইনাল) করতে পারব..এটা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই।’
ওদিকে রয়েসের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! টলমল চোখে বলেছেন আমাজন প্রাইমকে, ‘আমরা ওয়েম্বলিতে যাচ্ছি! পাগলাটে...পাগলাটে। ১০ বছরেরও বেশি সময় পর ফিরছি (ফাইনাল)। এবার পারতেই হবে। এখন, এই সময়টা আমাদের।’
মজার ব্যাপার, ওয়েম্বলির ফাইনালে ডর্টমুন্ডের প্রতিপক্ষও হবে স্মৃতিজাগানিয়া। হয় রিয়াল মাদ্রিদ নয় বায়ার্ন মিউনিখ। ১১ বছর আগের সে মৌসুমে সেমিফাইনাল প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদকে তছনছ করেছিল ডর্টমুন্ড—রবার্ট লেভানডফস্কি ৪ গোল করলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার ‘নিউক্লিয়াস’ ছিলেন রয়েস। আর বায়ার্নের কথা তো বলাই হলো। ঘরোয়া ফুটবলে চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে সেই ফাইনালে ২-১ গোলে হেরেছিল ডর্টমুন্ড। এবার ফাইনালে প্রতিপক্ষ তাদের যে-ই হোক, আসল কথাটা তো রয়েস বলেই রেখেছেন, ‘এবার পারতেই হবে।’
হ্যাঁ, পারতেই হবে। স্বপ্নপূরণে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।