২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হলান্ডের যে গোল বিমূঢ় করে দিচ্ছে অনেককে

দারুণ এক গোলে রাত রাঙিয়েছেন হলান্ডটুইটার

আধুনিক ফুটবলে নাকি গোল হয় না, এমন আক্ষেপ নিয়েই বিখ্যাত ‘সকার ইন সান এন্ড শ্যাডো’র ‘গোল’ অধ্যায়টি লিখেছিলেন কিংবদন্তি ক্রীড়া সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালেয়ানো। লিখেছিলেন, ‘১১ জন খেলোয়াড় ক্রসবার ধরে ঝুলে থাকে, গোল বাঁচানোর চেষ্টায় গোল করার সময়ই আর তাদের থাকে না।’

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। তখনো রোনালদো ‘দ্য ফেনোমেনন’-এর যুগ পুরোপুরি শুরুই হয়নি। লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আবির্ভাব তো আরও পরের ঘটনা। পরে অবশ্য ২০১০ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত সময়কালকে পরবর্তী সংস্করণে নিয়ে এসেছিলেন গালেয়ানো। তবে ‘গোল’ অধ্যায়টিতে কোনো পরিবর্তন আনেননি।

কে জানে, মেসি-রোনালদোকে দেখার পর অধ্যায়টি সংশোধন করার কথা গালেয়ানো আর ভেবেছিলেন কি না। ২০১৫ সালে গালেয়ানো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করায় সেটি আর জানারও সুযোগ নেই।

মেসি-রোনালদোর গোলবন্যা একটু কমে এলেও পরে এসে গেছেন লেভানডফস্কি-হলান্ড-এমবাপ্পেরা। তাঁদের দেখলেও কি শেষ অধ্যায়টা নতুন করে লেখার কথা ভাবতেন গালেয়ানো? বা গতকাল রাতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে হলান্ডের গোলটি দেখার পর কি দু-চার লাইন বাড়তি যোগ করে দেওয়ার কথা! কে জানে!

বাবাকে গ্যালারিতে সাক্ষী রেখে গোলটি করেন হলান্ড
ছবি: উয়েফা

হলান্ডের এই গোল নানা কারণেই বিশেষ। প্রতিপক্ষ, ম্যাচের পরিস্থিতি ও প্রত্যাশার চাপ—সব মিলিয়েই গোলটির গুরুত্ব অনেক। তবে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে গোলের ধরন, যা অনেক দিন পর্যন্ত দর্শকের চোখে লেগে থাকবে।

নিজের সাবেক ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে গতকাল রাতটা রাঙিয়েছেন হলান্ড। গত মৌসুমেও এই দলের হয়ে গোলের পর গোল করেছেন। হলান্ডকে তাই বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের ভালোই চেনা। তাঁকে নিয়ে হোমওয়ার্কটা ভালোভাবেই করে এসেছিল সিগনাল ইদুনা পার্কের ক্লাবটি।

ম্যাচে হলান্ড কতটা চাপে ছিলেন, একটি মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েই তা বোঝা যাবে। ৭২ মিনিটে ফিল ফোডেনের নিচু ক্রসটা স্লাইড করে ক্লিয়ার করেন ম্যাট হুমালস। এ সময় তাঁর সঙ্গেই স্লাইড করেছিলেন হলান্ডও। তবে বল তাঁর পা পর্যন্ত আসেইনি। শেষ পর্যন্ত হলান্ডের দুর্দান্ত গোলটি না হলে ম্যাচের অন্যতম নায়ক হতেন হুমালসই। ম্যাচের ৮০ মিনিট পর্যন্ত হলান্ডকে বেশ চাপেও রাখতে পেরেছিলেন হুমালাসরা।

আরও পড়ুন

সাবেক সতীর্থদের তৈরি করা জাল থেকে বেরোতে বিস্ময়কর কিছুই করতে হতো হলান্ডকে। করেছেনও তা–ই। ডি বক্সের মধ্যে হলান্ড জন্ম দিলেন স্মরণীয় এক মুহূর্তের। অ্যাক্রোবেটিক ভঙ্গিতে শূন্যে ভেসে বাঁ পা দিয়ে (তাঁর দুর্বলতর পা) যেভাবে বল জালে জড়ালেন, তাতে হলান্ডের মধ্যে ক্রুইফ ও ইব্রাহিমোভিচের ছায়া দেখার কথাও বলেছেন সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা।

স্কাই স্পোর্টসে সাবেক ফুটবলার ও ফুটবল বিশ্লেষক ক্লিনটন মরিসন বলেছেন, ‘গোলটিকে ব্যাখা করার মতো ভাষা আমার নেই। হলান্ডের এই গোল আমাকে বিমূঢ় করে দিয়েছে।’

অ্যাস্টন ভিলার সাবেক স্ট্রাইকার ডিওন ডাবলিন বিবিসি লাইভে বলেছেন, ‘অন্য যেকোনো খেলোয়াড় ডান পায়ের ভলিতে গোল করার চেষ্টা করত। তবে হলান্ড সেটি করেছে বাঁ পায়ে। এটা বর্ণনা করা কঠিন। বলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে তাঁকে অন্তত আট ফুট বাতাসে ভাসতে হতো। এটা অসাধারণ একটি ফিনিশ।’

কাল রাতে অবিশ্বাস্য এক গোল করেছেন হলান্ড
ছবি: এএফপি

আরও একটি কারণে এই গোল অনন্য। ম্যান সিটিতে গার্দিওলার কৌশল মূলত ধীরগতি ও দলীয় সমন্বয়ের প্রদর্শনীর, যা দারুণভাবে ফলপ্রসূও বটে। এর মধ্য থেকে বেরিয়ে হলান্ড ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের যে ঝলক দেখিয়েছেন, সেটিকে অনন্যই বলতে হয়।

এমনকি হলান্ড যে ধরনের খেলোয়াড়, সে বিবেচনায়ও গোলটি অসাধারণ। সাধারণত মাঠে হলান্ড খুব বেশি কিছু করেন না। বলের দিকে ছোটেন, বলের জন্য অপেক্ষা করেন এবং সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে গোল আদায় করে নেন।

ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ম্যাচে বড় একট সময় ছিলেন নিষ্প্রভ। প্রথমার্ধে বলই স্পর্শ করতে পেরেছিলেন ১১ বার। সব মিলিয়েই ম্যাচে বল স্পর্শ করেছেন ২৬ বার। তাঁর মানদণ্ড বিবেচনায় এটা একেবারে কম নয়। যদিও দুই গোলকিপারই তাঁর চেয়ে বেশি বল স্পর্শ করেছেন।

তাই পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে হলান্ডের প্রভাব বোঝাটা কঠিনই হবে। সব হিসাব-নিকাশ ও সমীকরণকে এক মুহূর্তের জাদুতে অসার প্রমাণ করেছেন এই নরওয়েজিয়ান। আর এমন একটি মুহূর্তের বিনিময়ে বাকি ৮৯ মিনিট বলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলেও খুব একটা প্রশ্ন তোলার সুযোগ বোধ হয় নেই।

অবশ্য এই একটি গোলের কীর্তিতে মৌসুমের শুরু থেকে হলান্ড যা করে চলেছেন, তা খানিকটা আড়ালই হয়ে যাচ্ছে। ‘গোলমেশিন’ স্বীকৃতিটা তো আগেই পাওয়া হয়ে গেছে তাঁর। এ মৌসুমে এটি ছিল হলান্ডের নবম ম্যাচ, এই ৯ ম্যাচে গোল করে ফেলেছেন ১৩টি। এর মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে দুই ম্যাচে ৩ গোল।

মৌসুমে গোলের লড়াইয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পে, রবার্ট লেভানডফস্কি ও নেইমারদের সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে লড়াইটা জমিয়ে তোলার বার্তাও দিয়ে রেখেছেন। প্রথমবারের মতো সিটিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতানোর স্বপ্নটাও নতুন করে দেখাতে শুরু করেছেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জোড়া গোল করেছিলেন হলান্ড ও এমবাপ্পে। এরপর তাঁদের নিয়ে শুরু হয় তুলনা। থিয়েরি অঁরি বলেছিলেন, এমবাপ্পেকে তিনি এগিয়ে রাখবেন; কারণ, এমবাপ্পে গোল করার সঙ্গে গোল বানিয়েও দিতে পারেন।

অন্যদিকে হলান্ডের সতীর্থ কেভিন ডি ব্রুইনা বলেছিলেন, হলান্ড যেভাবে গোলের পর গোল করছেন, তাতে বাকি সব কিছু ভুলে গেলেও চলবে। গতকাল রাতেও গোল করেছেন হলান্ড-এমবাপ্পে। হলান্ডের দুর্দান্ত গোল বাকি সব আলাপকে আড়ালে ঠেলে দিলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে এই দুজনের দ্বৈরথও এখন বাস্তবতা। যা ফুটবলপ্রেমীদের সামনের দিনগুলোকেও আনন্দে ভরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

আরও পড়ুন