মেসির গল্পে ড্রুরিও আছেন
জন আরলটকে তো চেনেন?
যাঁরা চেনেন না, এই লেখার শুরুটা তাঁদের জন্য। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোক একসময় পুলিশ ছিলেন। চার-ছয় মাস বা দুই-তিন বছর নয়, টানা ১২ বছর। পুলিশি পেশার পাশাপাশি আরও দুটি বলার মতো পরিচয় ছিল তাঁর। আরলট সাংবাদিক ছিলেন, কাজ করেছেন গার্ডিয়ানে, দ্য অবজারভারে। ছিলেন কবিও। আবার যুক্তরাজ্যের দুটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছু সময় রাজনীতিতেও ছিলেন। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে ক্রিকেট দুনিয়া তাঁকে চেনে ধারাভাষ্যকার হিসেবে।
রেডিও থেকে শুরু করে রঙিন টিভির যুগ পর্যন্ত ৩৪ বছর খেলার ধারাভাষ্য দিয়েছেন। শত শত ম্যাচ আর হাজার হাজার ঘণ্টার খেলার বর্ণনা তুলে এনেছেন কণ্ঠে। ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথামের মতে, ক্রিকেটে আরলটের মতো ধারাভাষ্যকার অতীতে কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আর যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের মতে, ক্রিকেটকে ব্যক্তিত্বে রূপ দেওয়া মানুষটির নাম আরলট।
আরলট পৃথিবী ছেড়েছেন ১৯৯১ সালে। এরপর তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আরলট আজও ঘুরে ফিরে উঠে আসেন ক্রিকেটের আড্ডায়, আলোচনায়। ধারাভাষ্যে লাখো-কোটি মুহূর্ত পার করেছেন বলে নয়, আরলট সবচেয়ে বেশি ফিরে ফিরে আসেন মাত্র ১৬ শব্দের কারণে।
বলা হয়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে বিক্ষিপ্ত আর সবচেয়ে আলোচিত ধারাভাষ্য হচ্ছে আরলটের মুখে বলা সেই ১৬টি শব্দ—যেখানে বর্ণনা করা হয়েছিল স্যার ডন ব্র্যাডমানের ক্যারিয়ারের শেষ মুহূর্ত, আরও স্পষ্ট করে বললে ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট কেনিংটন ওভালে উইলিয়ামস হলিসের বলে শূন্য রানে ব্র্যাডমানের আউটের ঘটনাটি। বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে যাওয়া আরলট থেমে থেমে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা এ রকম—‘হলিস পিচেস দ্য বল আপ স্লো-লি অ্যান্ড…হি ইজ বোল্ড…ব্র্যাডমান বোল্ড হলিস, নট…বোল্ড হলিস নট…!’
যতবার ব্র্যাডমানের রূপকথাময় ক্যারিয়ারের সেই বিয়োগান্তক পরিণতির গল্প হয়, আরলট যেন ততবারই ফিরে ফিরে আসেন, ফিরে আসে ওই শব্দ কটি।
২.
আরলটের মতো পিটার ড্রুরির ক্যারিয়ার এত বড় নয়। নানা পেশার পথে ঘাটে হাঁটেনওনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মাসখানেক হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে এ সব অমিলের উল্টো পিঠে আছে দুটো বড় মিল। দুজনই ইংলিশ, পেশায় ধারাভাষ্যকার। ভিন্ন দুই সময়ে ক্রিকেট ও ফুটবলে ধারাভাষ্য দিয়ে দুজনই বিখ্যাত হয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বড় মিলটা অন্য কোথাও। ব্র্যাডমানের সঙ্গে আরলট যেমন, তেমনই লিওনেল মেসির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ড্রুরির নাম।
৭ বারের ব্যালন ডি’অর, ৪ বারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী মেসির ক্যারিয়ারে তর্কাতীতভাবে সর্বোচ্চ অর্জন আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয়। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারের মাটিতে মেসির বিশ্বজয়ের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তটি শব্দের জাদুকরি ব্যবহারে চিত্রিত করেছিলেন যিনি, দর্শকের মানসপটে চিরকালীন দৃশ্যকল্প তৈরি করেছিলেন যে শিল্পী, তিনিই পিটার ড্রুরি।
ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের যাঁরা নিয়মিত দর্শক, তাঁরা ড্রুরিকে চেনেন অনেক আগে থেকেই। ১৯৯০ সালে বিবিসি রেডিও দিয়ে শুরু ড্রুরি পেশাদার ধারাভাষ্য ক্যারিয়ারের। টেলিভিশনে আসেন বছর আটেক পর। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ইউরো হয়ে বিশ্বকাপ—একের পর এক বড় মঞ্চের মাইক্রোফোন মুখের সামনে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
২০১০ ফিফা বিশ্বকাপের কথা মনে করে দেখুন। সেই আসরের আইকনিক মুহূর্ত হয়তো স্পেনের বিশ্বকাপ জয়। তবে শুরুটা ছিল বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বড় কিছু, অন্তত আফ্রিকানদের কাছে। ১১ জুন উদ্বোধনী ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গোলে ধারাভাষ্যে ছিলেন ড্রুরি। আফ্রিকা মহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপ, আর প্রথম গোলটিই দক্ষিণ আফ্রিকার, যেন নাচন উঠেছিল পুরো আফ্রিকাজুড়ে। সেই মুহূর্তটিতে গোলদাতা সাবালালার নাম ধরে ড্রুরি বলে উঠেছিলেন, ‘সাবালালা...। গোল বাফানা বাফানা ... গোল ফর সাউথ আফ্রিকা ... গোল ফর অল আফ্রিকা..।’
সেই ম্যাচের এক দশক পর দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড্রুরি নিজেই বলেছেন, তাঁর নিজের দেওয়া সব ধারাভাষ্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল এটি। তবে ড্রুরির মুখনিঃসৃত আরও অনেক ধারাভাষ্য এখনো দর্শক–শ্রোতার কানে বাজে। ২০১১–১২ প্রিমিয়ার লিগের শেষ দিনের শেষ মুহূর্তটা মনে করুন। শেষ বাঁশির মিনিট দেড়েক আগে সের্হিও আগুয়েরোর গোলে ৪৪ বছর পর লিগ জেতে ম্যানচেস্টার সিটি। সেই মুহূর্তে ড্রুরির ‘স্ট্যাগারিং, জাস্ট স্ট্যাগারিং’ শব্দ দুটি তো প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসেরই সেরা মুহূর্তগুলোর একটি।
আবার চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনাকে ছিটকে দেওয়ার পথে রোমার গোলের পর সেই কাব্যিক ধারাভাষ্য, ‘নিজেদের ধ্বংসাবশেষ থেকে জেগে উঠেছে রোমা, মানোলাস, রোমের গ্রিক গড। এটা হওয়ার ছিল না, এটা হতে পারত না, এটা ঘটেছে...!’
এমন দারুণ সব স্মরণীয় ধারাভাষ্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে চ্যাম্পিয়নস লিগে ভলফবুর্গের বিপক্ষে রোনালদোর হ্যাটট্রিক, ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোটশের জয়সূচক গোল, ক্রোয়েশিয়ার প্রথমবার ফাইনালে ওঠা, এল ক্লাসিকোতে মেসির জাদুকরি ড্রিবলিং, মরক্কোর প্রথমবার সেমি ফাইনালে ওঠার মতো নানা মুহূর্তে।
তবে সব ছাপিয়ে ফুটবল ইতিহাস ড্রুরিকে বেশি মনে রাখবে মেসিকে নিয়ে তাঁর কাব্যিক ধারাভাষ্যের জন্য, যা অনেক বেশি মহিমান্বিত ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের কারণেও। মারিও গোটশের গোলে ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল জার্মানি। ম্যাচের ১২৩তম মিনিটে জার্মানির বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পায় আর্জেন্টিনা। সমতা আনা কিংবা মেসির বিশ্বকাপ স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার ওটাই শেষ সুযোগ।
ফ্রি কিক নিতে প্রস্তুত মেসি। টানটান উত্তেজনার সেই মুহূর্তে ড্রুরি বললেন, ‘রোজারিওর ছোট্ট ছেলেটি, তার জার্সি পরা প্রতিটি ছেলের প্রতিনিধি হিসেবে, পিঠে মেসি লেখা মানুষগুলোর হয়ে...আলোর ঝরনাধারার অপেক্ষায়।’ কিন্তু মেসি পারেননি। বল মারেন গোলবারের ওপর দিয়ে। ড্রুরির কণ্ঠে তখন হাহাকার, ‘নো, নো, নো, নো, ইটস্ গন অ্যাওয়ে!’
মারাকানায় সেদিন বিশ্বকাপ জিততে পারেননি মেসি। পেরেছেন আট বছর পর কাতারে। মেসির না–পারার মতো পারার মুহূর্তও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ড্রুরি কণ্ঠে। ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে মন্তিয়েলের শট জালে জড়াতেই যা বলেছিলেন, অনুবাদে তা অনেকটাই মাধুর্য হারাবে। তারপরও চেষ্টা তো করাই যায়— ‘আর্জেন্টিনা, চ্যাম্পিয়নস অব দ্য ওয়ার্ল্ড! আবারও! অবশেষে!’ তারপর স্মরণীয় সেই লাইনগুলো, ‘সান্তা ফে, রোজারিওর সেই ছোট্ট ছেলেটি এইমাত্র স্বর্গে পা রাখল! সে এমন এক ছায়াপথে পৌছে গেছে, যেটা শুধুই তাঁর। এটাই তার মুকুট পরার মুহূর্ত...।’
হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দেওয়ার পর আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতানোর গল্প যদি হয় মেসি-রূপকথা, তবে সেই রূপকথার গল্পকথক তো পিটার ড্রুরি!