ভাগ্যিস, ‘অ্যাওয়ে গোল’ নিয়ম নেই! উয়েফা ২০২১ সালেই নিয়মটি তুলে নিয়েছে। নইলে লিভারপুলের খেলোয়াড়দের দুশ্চিন্তার শেষ থাকত না। অ্যানফিল্ডে ৫ গোল করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। ফিরতি লেগে গোলগুলোর ওজন আরও বাড়ত। লিভারপুলের জন্য সুখবর, সেই দুশ্চিন্তা নেই। তবে অন্য দুশ্চিন্তা আছে, আর সেটি রক্ষণ নিয়ে।
শেষ ষোলো প্রথম লেগে লিভারপুলের ঘরে ঢুকে ৫ গোল করেছে রিয়াল। দারউইন নুনেজ ও মোহাম্মদ সালাহ ১৪ মিনিটের মধ্যে দুটো গোল করেছিলেন। খোঁচা দুটো লেগেছিল রিয়ালের খেলোয়াড়দের। ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় অ্যানফিল্ডে প্রথম দল হিসেবে লিভারপুলের জালে ৫ গোল করে ঐতিহাসিক জবাব দিয়েছে মাদ্রিদের ক্লাবটি। ৫-২ গোলের এ জয়ে ঘরের মাঠে ফিরতি লেগের আগেই মানসিকভাবে বেশ এগিয়ে রইল আনচেলত্তির দল।
কিন্তু থিবো কোর্তোয়া কি অতটা আত্মবিশ্বাসী থাকবেন ? অবশ্য মদরিচ-ভিনিসিয়ুস-বেনজেমাদের খেলায় তৃপ্ত কোচ কার্লো আনচেলত্তি বেলজিয়ান গোলকিপারের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতে পারেন, ভুলে যাও, ভুল তো মানুষই করে।
নামটা কোর্তোয়া বলেই অবিশ্বাস্য মনে হবে। অবিশ্বাস্য-কাণ্ড অবশ্য কোর্তোয়া-কাণ্ডের আগেই ঘটেছে। নুনেজের ব্যাক হিলে রিয়াল গোল খেয়েছে ৩ মিনিট ১১ সেকেন্ডে! চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউটে লিভারপুলের সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে (১৮ বছর ১২২ দিন) স্তেফান বাফেতিচের দারুণ পাসকে গোলের উৎস বানান মোহাম্মদ সালাহ। মিসরীয় ফরোয়ার্ডের পাস এদের মিলিতাওয়ের পেছন থেকে নিখুঁত টাইমিংয়ে ধরে গোল করেন নুনেজ। পরিসংখ্যান বলছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগে এত দ্রুত গোল খাওয়ার পর রিয়াল কখনো জিততে পারেনি।
পরিসংখ্যানটা এই ম্যাচের পর থেকে ভুল। ১৪ মিনিটে কোর্তোয়ার সেই অবিশ্বাস্য ভুলের সময় অবশ্য তা মনে হয়নি। দানি কারবাহলের ব্যাক পাস পেয়েছিলেন কোর্তোয়া। বল ঠিকঠাক মারতে গিয়ে হাঁটু দিয়ে গুঁতো মেরে বসেন। সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা সালাহ বলের নাগাল পেতেই বাঁ পায়ের শটে গোল করে ইউরোপে লিভারপুলের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড গড়েন। পেছনে পড়লেন ক্লাব কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ড।
দুটো গোল হজমের পরও রিয়ালের আক্রমণভাগ পুরোপুরি আড়মোড়া ভাঙেনি। পরিবর্তনটা বোঝা গেল, চার-পাঁচ মিনিট পর। তার আগে অবশ্য দুই দলই গতি, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে বিনোদন দিয়েছে। ম্যাচ গড়িয়ে চলার সঙ্গে সেই ধার যেন আরও বেড়েছে। ২১ মিনিটেই ধারটা দেখিয়ে দেয় গতবারের চ্যাম্পিয়নরা।
বাঁ প্রান্ত দিয়ে লিভারপুলের বক্সে ঢুকে করিম বেনজেমাকে বলটা একটু ধার দিয়ে ফিরতি পাসেই লিভারপুলের তিন ডিফেন্ডারের মাঝ থেকে বাঁকানো শট নেন ভিনিসিয়ুস। চোখ ধাঁধানো এক গোল। এরপরই চোখ ধাঁধানো এক ভুল!
চোখ ধাঁধানো বলতে গোলটি এতটাই অবিশ্বাস্য যে দেখে লিভারপুল সমর্থকদের চোখ জ্বালা করতে পারে। ৩৬ মিনিটে গোলকিপার আলিসনকে ব্যাক পাস দেন ডিফেন্ডার জো গোমেজ। ভিনিসিয়ুস চাপ সৃষ্টি করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আলিসন গোমেজকে ফিরতি পাস দিতে গিয়ে বল মেরে বসেন ভিনিসিয়ুসের গায়ে। বলটা আলিসনের পাশ দিয়ে শূন্যে উড়াল দিয়ে একটা বাউন্স খেয়ে জালে জড়াল! রসিকতা করে কেউ কেউ বলতে পারেন, গোলকিপারদের ভ্রাতৃত্ববোধ প্রবল। এক বিশ্বমানের গোলকিপারের অবিশ্বাস্য ভুল দেখে আরেক বিশ্বমানের গোলকিপার তেমনই এক অবিশ্বাস্য ভুলে পুষিয়ে দিল!
তাই বলে গোমেজ, ভার্জিল ফন ডাইক ও রবার্টসনকে নিয়ে গড়া ক্লপের রক্ষণভাগের ভুল ঢাকা পড়ে না। রদ্রিগো, বেনেজমা ও ভিনিসিয়ুস ইচ্ছেমতো বক্সে ঢুকেছেন। বিরতির পর তো আরও বেশি!
এক লুকা মদরিচের সামনে মার খেয়ে গেছে ফাবিনিও, বাফেতিচ ও হেন্ডারসনদের মাঝমাঠ। প্রথমার্ধে ২-২ গোলে সমতার পরও মনে হয়নি বিরতির পর ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে রিয়াল। অবশ্য ভিনিসিয়ুস ইতিহাস গড়েছেন প্রথমার্ধেই। ইউরোপিয়ান কাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে লিভারপুলের জালে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করতে পারেননি। ৫ গোল।
রিয়ালের স্কোরলাইনেও এই সংখ্যাটা যোগ হয় করিম বেনজেমা ও এদের মিলিতাওয়ের কল্যাণে। বিরতির পর লিভারপুল ঠিকমতো গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ফ্রি কিক পায় রিয়াল। ৪৭ মিনিটে পাওয়া সেই ফ্রি কিক থেকে মিলিতাও হেডে কীভাবে গোল করলেন সেই প্রশ্ন নিশ্চয়ই ফন ডাইকদের করবেন লিভারপুল কোচ ক্লপ। আশপাশে তিনজন ডিফেন্ডারকে রেখে মিলিতাও হেড করেছেন, কেউ বাধা দেননি!
৫৫ মিনিটে বেনজেমার করা গোলেও গোমেজের পজিশন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। রদ্রিগোর পাস থেকে শট নিয়েছিলেন বেনজেমা। বলের যে গতিপথ ছিল, সামনে দুজন ডিফেন্ডার থাকায় তা জালে না থাকার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। কিন্তু গোমেজ পা বাড়িয়ে দেওয়ায় বল তাঁর উরুতে লেগে দিক পাল্টে জালে জড়ায়। এ যাত্রায় আলিসনের অবশ্য কিছুই করার ছিল না। ৬৭ মিনিটে বেনজেমার দ্বিতীয় গোলটি প্রতিআক্রমণের ফসল।
মদরিচ থেকে ভিনিসিয়ুস, এরপর ফন ডাইকের পায়ের ভেতর দিয়ে ব্রাজিলিয়ানের পাস, আলিসনকে একা পেয়ে সেই পাস থেকে বেনজেমার গোল। যেন ‘সার্জিক্যাল নাইফ’ দিয়ে রক্ষণ চিরে ফেলেছিলেন বেনজেমা-ভিনিসিয়ুসরা। ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় রিয়াল এই প্রথম প্রতিপক্ষের মাঠে দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে জিতল, সেটাও অ্যানফিল্ডে ৫ গোল করে! গতবারের এই দুই ফাইনালিস্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ১৬ মার্চ ফিরতি লেগে মুখোমুখি হবে।
দুর্দান্ত এই জয় রিয়ালের প্রয়াত অনারারি সভাপতি আমানসিও আমারোকে উৎসর্গ করে বেনজেমা বলেছেন, ‘এই জয়টা তার জন্য। আমরা নিজেদের মানসিকতা দেখিয়েছি। গোল করেছি। আমরা এই চ্যাম্পিয়নস লিগটা চাই। এই জয়টা আমরা আমাদের অনারারি সভাপতি আমানসিও আমারোকে উৎসর্গ করছি।’