মেসির আগমন যেভাবে বদলে দেবে ইন্টার মায়ামি ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে
২০১৮ সালের কথা। মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) ২৫তম ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে ইন্টার মায়ামি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ক্লাবমালিকদের একজন ডেভিড বেকহাম লিওনেল মেসির পাঠানো একটি ভিডিও বার্তা নিজের ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করেন। বেকহামকে নিজের নতুন প্রজেক্টের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে মেসি তাঁর বার্তার সমাপ্তি টানেন এভাবে, ‘কে জানে, কয়েক বছরের মধ্যে তুমি হয়তো আমাকে ফোন করবে।’
সেদিনই মূলত যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বীজটা পুঁতেছিলেন মেসি, পেয়েছেন সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন কলটি। এরপর আরও একাধিকবার ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে মেসির এমএলএসে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে গত বুধবার রাতে। ফ্রি এজেন্ট মেসি নিজেই ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি।’
মেসি এই ঘোষণা দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই মজা করে লেখেন, ফুটবলকে বিদায় বলেছেন মেসি। তিনি এখন থেকে সকার খেলবেন। নিতান্তই মজা করে বললেও এ কথাটা কিন্তু একেবারেই ভুল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের লিগটির নামের মধ্যেই আছে সকার শব্দটি। যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলকে সকার বলা হয়। তা ছাড়া মায়ামি, এমএলএস ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের সামগ্রিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিলেও মেসির এ ঘোষণাটা বৈপ্লবিক।
এমএলএসের ইতিহাসে আর কোনো ফুটবলারকে দলে ভেড়াতে গিয়ে এত নাটক মঞ্চস্থ হয়নি। অবশ্য অনেকের বিবেচনায় সর্বকালের সেরা এই তারকাকেই নিয়ে যদি নাটক না হয়, তাহলে কাকে নিয়ে আর হবে! তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ছয় বছর ধরে মেসিকে নিজেদের দলে পাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন মায়ামির মালিকেরা। ২০২১ সালে মায়ামির মালিকদের একজন হোর্হে মাস বলেছিলেন, ‘ডেভিড (বেকহাম) ও আমি তেমন কিছু করার জন্য (মেসিকে আনা) কাজ করে যাচ্ছি, যা আমি মনে করি, শুধু মায়ামিকেই আমূল বদলে দেবে না, লিগেও দারুণ প্রভাব রাখবে।’
মাসের এই কথার প্রভাব গোটা এমএলএসের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে শোনা গিয়েছিল লিগের সব কটি দল মিলে নাকি মেসির বেতন দিতে চায়। মেসির আগমন নিয়ে লিগ কমিশনার ডন গারবার গত মার্চে বলেছিলেন, মেসির প্রতিভায় মন্ত্রমুগ্ধ হতে লিগ প্রস্তুত। মেসির মতো প্রতিভার দেখা সারা জীবনে একবারই মেলে বলে জানান গারবার।
তবে কাজটা যে সহজ হবে না, তা নিশ্চয় তাঁদের অজানা ছিল না। মেসিকে ধরে রাখতে চেয়েছিল পিএসজি, বার্সেলোনা চেয়েছিল তাঁকে ফিরিয়ে নিতে আর সৌদি আরব অর্থের ঝনঝনানিতে মেসিকে মোহাচ্ছন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই তিন ক্লাবের কেউই তাদের লক্ষ্যে সফল হতে পারেনি। মেসি শেষ পর্যন্ত মায়ামিকেই নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
শুধু মেসিই এমএলএসে ফুটবলের সেরা তারকাদের সংযুক্তির একমাত্র উদাহরণ নয়। এর আগে ফুটবলের রাজা পেলে এবং ইংলিশ ফুটবল আইকন ডেভিড বেকহামসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় তারকা যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া লিগে খেলে গেছেন। তবে মেসির আগে সেই ১৯৭০–এর দশকে পেলের আগমনে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল। ১৯৭৫ সালে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে নিউইয়র্ক কসমসে যোগ দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। কসমসের পেছনে সে সময় ছিল ওয়ার্নার করপোরেশনের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের এমন যুগান্তকারী ঘটনা আর কেউ ঘটাতে পারেনি। পেলের আগমন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল বাস্তবতাকে রীতিমতো বদলে দিয়েছিল।
পেলের আগমনে তখন বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ক্লাবের ঘরের মাঠে খেলায় দর্শক উপস্থিতি ১৯৭৫ সালে ছিল ৩ হাজার ৫০ জন। আর ১৯৭৭ সালে পেলে যখন ক্লাব ছাড়ছিলেন, সে সংখ্যাটা প্রায় ৪৫ হাজারে গিয়ে ঠেকেছিল। এর মধ্যে তিনবার পেলেকে দেখার জন্য জায়ান্ট স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিতি গিয়ে ঠেকেছিল ৭০ হাজারে, যা সে সময়ের বিস্ময়কর ঘটনা ছিল।
ব্যাপারটা এমন ছিল যে অনেক ক্লাবের পুরো মৌসুমের দর্শক উপস্থিতি পেলে খেলার সময় কসমসের এক ম্যাচের চেয়ে কম ছিল। মেসিকে নিয়েও যে তেমন কিছু হতে যাচ্ছে, সে ইঙ্গিত তাঁর মায়ামিতে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেছে। যেখানে ১২ ঘণ্টায় ইনস্টাগ্রামে মায়ামির অনুসারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ লাখ। আর মায়ামিতে তাঁর অভিষেক ম্যাচের টিকিটের দাম বেড়েছে ১০৩৪ শতাংশ পর্যন্ত। তবে এটা কেবলই শুরু। এই প্রভাব নিশ্চিতভাবে আরও সুদূরপ্রসারী হতে যাচ্ছে।
পেলে যে তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে খেলেছিলেন, সে সময় দেশটিতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। তখনকার শিশু-কিশোরই পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রজন্মের ফুটবলার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পেলের মতো আইকনিক চরিত্রকে সামনে পেয়ে অনেকের মধ্যে ফুটবলার হওয়ার বীজ রোপিত হয়েছিল, যা পরে ১৯৯০ সালে দেশটির বিশ্বকাপে খেলার পথেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এরপর নিজ দেশে আয়োজিত বিশ্বকাপে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলে যুক্তরাষ্ট্র। এবার মেসিকে ঘিরেও সেই একই দৃশ্য দেখা যেতে পারে দেশটিতে। অনেকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল উন্মাদনার নতুন যুগ শুরু হতে যাচ্ছে মেসি-মায়ামি চুক্তির মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে, ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত বিশ্বকাপকে নতুন মাত্রা দেবে মেসির উপস্থিতি।
শুধু পেলেই নয়, বেকহামের উপস্থিতিও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সে সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবল আইকন হিসেবে এমএলএসে এসেছিলেন বেকহাম। যিনি শুধু ফুটবলার হিসেবেই নন, ক্লাবমালিক হিসেবেও খেলাটির প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বেকহাম যখন আসেন, তখন দল ছিল ১৩টি। ২০২৩ সালে এসে বর্তমানে ক্লাব সংখ্যা ২৯। তবে এমএলএসে ইতিহাসে বেকহামের সবচেয়ে বড় অবদান হয়ে থাকবে মেসিকে আনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারা, যার ইতিবাচক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে লম্বা সময় পর্যন্ত দেখা যাবে।
২০০৭ সালে বেকহামের আগমন নিয়ে এমএলএসের কমিশনার ডন গারবার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘কোনো সন্দেহ ছাড়াই এমএলএস নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈশ্বিক আকর্ষণ পাচ্ছে। ডেভিডের (বেকহাম) কারণেই এমএলএস আরও বেশি স্বীকৃতি পাচ্ছে। তার কারণে আমাদের ব্যবসা সব দিক থেকেই বাড়ছে।’ মেসিকে নিয়ে চাইলে এ কথা এখনই বলে দেওয়া যায়। গত দুই দিনেই এমএলএস ফুটবল দুনিয়ায় যতটা চর্চিত হয়েছে, গত কয়েক বছরেও সব মিলিয়ে এতটা মনোযোগ পায়নি ক্লাবটি।
আগামী দিনগুলোয় ম্যাচে দর্শক উপস্থিতি, আন্তর্জাতিক আগ্রহ, পণ্য বিক্রয় ও অন্য ফুটবলারদের আগ্রহ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে মেসির উপস্থিতি। মেসির ম্যাচের দিন এমএলএসের স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ারই কথা। এমএলএসের বেশির ভাগ স্টেডিয়ামই অবশ্য ১৮ থেকে ৩০ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন, যা কিনা মেসিকে ব্যবহার করে টিকিট থেকে আয়ের জন্য যথেষ্ট হবে না।
মনে রাখা ভালো ২০১৭ সালে মেসি যখন বার্সেলোনার হয়ে প্রাক্–মৌসুম ট্যুরে এসেছিলেন, তখন ৬০ থেকে ৮০ হাজার দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন খেলা দেখতে। এ ধরনের দৃশ্য এখন নিয়মিতই দেখা যেতে পারে। যে কারণে এমনও হতে পারে যে ইন্টার মায়ামির কিছু ম্যাচ আরও বড় স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হতে পারে। তা ছাড়া চাহিদা বাড়ার কারণে এমএলএসের ক্লাবগুলো এখন হয়তো টিকিটের দাম বাড়ানোর পথেও হাঁটতে পারে।
তবে ইন্টার মায়ামিতে মেসির অর্থনৈতিক প্রভাব ভিন্ন এক গল্প হতে যাচ্ছে। মেসি যাওয়ার পর পিএসজির অবস্থা এবং গত দুই দিনের হিসাব–নিকাশ বলছে, ইন্টার মায়ামি মার্কিন খেলাধুলার জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হতে যাচ্ছে। মার্কার দেওয়া তথ্য বলছে, মেসির আগমনের প্রথম বছরে পিএসজির আয় ৭০ কোটি ইউরো ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একই ধরনের চিত্র দেখা যেতে পারে মায়ামিতেও। স্পনসরশিপ চুক্তি, ইমেজ স্বত্ব, ম্যাচের দিনের টিকিট বিক্রি ও জার্সি বিক্রি থেকে বিপুল পরিমাণে আর্থিক লাভ অপেক্ষা করছে মায়ামির সামনে। শুধু মায়ামিই নয়, মেসির আগমনে এমএলএসের অন্য ক্লাবগুলোও আয়ে ঊর্ধ্বগতি দেখতে যাচ্ছে।
মেসিকে নিয়ে আমেরিকান স্পোর্টস কনসালট্যান্সি টোয়েন্টি ফার্স্ট গ্রুপের পরিচালক ম্যাট স্লাটার বলেছিলেন, ‘সে এই গ্রহের সবচেয়ে প্রভাবশালী খেলোয়াড়। তার এমএলএসের ক্লাবে আসা লিগের দৃশ্যপটকে পুরোপুরি বদলে দেবে।
সামনের দিনগুলোয় আমরাও নিশ্চিতভাবে সেই ঐতিহাসিক বদলের সাক্ষী হতে যাচ্ছি।’