রিয়াল–সিটি ম্যাচ যেন হ্যারি পটার–লর্ড ভল্ডেমর্ট লড়াই
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দুনিয়ায় জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা দেখেছে নানা ধরনের সিরিজ। প্রায় প্রতিবছরই আসছে জনপ্রিয় সিরিজগুলোর নতুন নতুন ‘সিজন’। একটি সিজন শেষ হওয়ার পর অপেক্ষা শুরু হয় পরেরটির। উত্তেজনা, রোমাঞ্চ আর শ্বাসরুদ্ধকর সেই স্বাদ পেতে মরিয়া হয়ে থাকে দর্শক।
ফুটবল–দুনিয়ায়ও এখন দেখা মিলছে তেমন এক রুদ্ধশ্বাস সিরিজের। মৌসুম ঘুরতেই এসে যাচ্ছে একই সিরিজের নতুন সিজনও! তবে ফুটবল মঞ্চের নতুন সিজন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মতো পূর্বপরিকল্পিত নয়। এখানে যা ঘটছে, তা হঠাৎ করেই। বলা হচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ ও ম্যানচেস্টার সিটির দ্বৈরথের কথা। এ নিয়ে টানা তৃতীয় মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে দেখা হচ্ছে বর্তমান সময়ের অন্যতম দুই পরাশক্তির। শক্তি, সামর্থ্য ও সাফল্যের ক্ষুধায় কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। ফলে রিয়াল-সিটি ‘সিরিজের’ তৃতীয় ‘সিজনে’ রোমাঞ্চকর কিছু দেখারই অপেক্ষা ফুটবলপ্রেমীদের।
হ্যারি পটার বনাম লর্ড ভল্ডেমর্ট
সংবাদমাধ্যম এসবিনেশন রিয়াল-সিটির এ ম্যাচকে দেখছে জে কে রাওলিংয়ের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘হ্যারি পটার’–এর হ্যারির সঙ্গে লর্ড ভল্ডেমর্টের লড়াই হিসেবে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন যে তাদের একজন বেঁচে থাকলে আরেকজনের বিনাশ নিশ্চিত। আর দুই দলের মধ্যে যে টিকে থাকবে, ট্রফি উঁচিয়ে শেষ হাসি হাসবে তারাই!
গত দুই মৌসুমে চিত্রটা এমনই ছিল। ২০২১-২২ মৌসুমে সিটিকে সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল রিয়াল। আর লিভারপুলকে হারিয়ে জিতেছিল শিরোপা। এরপর গত মৌসুমে প্রতিশোধ নিয়ে রিয়ালকে সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে সিটি। ফাইনালে সিটির কাছে হার মানতে হয় ইন্টার মিলানকে। এবার অবশ্য রিয়াল-সিটির দেখা হচ্ছে কোয়ার্টার ফাইনালেই। তবে লড়াই যে পর্যায়েই হোক, ১-১ সমতায় থাকা এ ‘সিরিজে’ এগিয়ে যেতে মরিয়া থাকবে দুই দলই।
একের ভেতর অনেক লড়াই
রিয়াল-সিটির দ্বৈরথে সাফল্যের রূপরেখা নির্ধারিত হতে পারে অনেকভাবেই। লড়াই হবে মাঠ ও মাঠের বাইরে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন—দুটোই হতে হবে সমান ক্ষুরধার। মূলত ট্যাকটিকালি শক্তিশালী দুটি দলের মধ্যে শেষ পর্যন্ত পার্থক্য গড়ে দেবে সূক্ষ্ম কিছু বিষয়। দাবার ছকের মতো তাই প্রতিটি চাল হতে হবে মাপা৷ পান থেকে চুন খসলেই হয়ে যেতে পারে লঙ্কাকাণ্ড, ভেস্তে যেতে পারে সব স্বপ্নও।
ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠা এ দ্বৈরথে ডাগআউট থেকে শুরু করে প্রতিটি পজিশনে লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ান৷ তবে শুধু পজিশনভিত্তিক নিখুঁত লড়াই নয়, ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যও। দুই দলই তারকায় ঠাসা। মূল একাদশ থেকে শুরু করে বেঞ্চ—কোথাও শক্তির কোনো ঘাটতি নেই। রিয়ালে জুড বেলিংহাম, ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো আর সিটিতে ডি ব্রুইনা, হলান্ড কিংবা ফোডেনরা ব্যক্তিগত ঝলকানিতেই ভস্ম করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষকে। আজ রাতে ভাগ্যদেবী কার দিকে দৃষ্টি তুলে তাকায়, সেটিই দেখার অপেক্ষা।
ব্যাটল অব মিডফিল্ড
রিয়াল-সিটির দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে ব্যাটল অব মিডফিল্ড। গত মৌসুমে মাঝমাঠে নিয়ন্ত্রণ হারানোতেই সিটির কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল রিয়াল। এবার বদলে গেছে দৃশ্যপট। চলতি মৌসুমে অনেক ম্যাচে রিয়ালকে মাঝমাঠে আধিপত্য বিস্তার করে এবং বলের দখল ধরে রেখে খেলতে দেখা গেছে। বিশেষ করে মাঝমাঠে বেলিংহামের উপস্থিতি রিয়ালকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলেছে। মিডফিল্ডার হিসেবে গোল, সহায়তা ও প্রাণশক্তি—সবই নিয়ে এসেছেন এই ইংলিশ তারকা। আক্রমণে ওঠার সময় ভিনিসিয়ুস আর বেলিংহামের বোঝাপড়াও দারুণ।
রিয়ালের মাঝমাঠে টনি ক্রুসের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে দারুণ ছন্দে থাকা ক্রুসকে কোচ আনচেলত্তি কীভাবে ব্যবহার করেন, সেটিও দেখার বিষয়। অন্যদের মধ্যে ফেদে ভালভের্দে, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা ও অরলিয়েঁ চুয়ামেনিরাও সিটির সঙ্গে জমিয়ে তুলতে পারেন মাঝমাঠের লড়াই।
তবে ক্রুস যদি মাঝে খেলেন, সে ক্ষেত্রে ভালভের্দে ও কামাভিঙ্গাকে দেখা যেতে পারে দুই পাশে আর বেঞ্চে বসতে হতে পারে চুয়ামেনিকে। আর চুয়ামেনি যদি হোল্ডার হিসেবে খেলেন, সে ক্ষেত্রে বদলি নামার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে কামাভিঙ্গাকে। পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে বেঞ্চ থেকে নামার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন লুকা মদরিচও।
অন্যদিকে সিটিও নিশ্চিতভাবে প্রথম মিনিট থেকে মাঝমাঠের দখল নিতে মরিয়া থাকবে। গার্দিওলা বরাবরই পজেশন ধরে রেখে দলকে খেলাতে পছন্দ করেন। সেটি করতে গেলে মাঝমাঠে ছড়ি ঘোরানোর বিকল্প নেই। আজও সেই মন্ত্র পড়িয়েই তিনি মাঠে নামাবেন খেলোয়াড়দের। যথারীতি মাঝমাঠের লড়াইয়ে জেনারেলের ভূমিকা নিতে হবে কেভিন ডি ব্রুইনাকে। তাঁর একক উপস্থিতিই প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরাতে যথেষ্ট।
এবার অবশ্য শুধু ডি ব্রুইনাকে নিয়ে ভাবলেই আর হচ্ছে না। এখানে তাঁর দোসর হিসেবে আছেন ফিল ফোডেন। দারুণ ছন্দে থাকা ইংলিশ মিডফিল্ডার প্রিমিয়ার লিগে সম্প্রতি অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে করেছেন দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক।
মাঝমাঠ থেকে ডি ব্রুইনা ও ফোডেনই মূলত সংযোগ তৈরি করবেন হলান্ডের সঙ্গে। আর পেছন থেকে মাঝমাঠে প্রয়োজনীয় বলের জোগান দিয়ে যাবেন রদ্রি। দলের প্রয়োজনে অবশ্য মাঝমাঠ ‘ওভারলোড’ করেও রিয়ালকে চাপে ফেলার চেষ্টা করতে পারেন গার্দিওলা।
সে ক্ষেত্রে রিয়াল অবশ্য প্রতি-আক্রমণের কৌশলে গেলে বাড়তে পারে সিটির বিপদ। আর বড় ম্যাচে অনেক সময় কৌশলে ‘চোক’ করার অভ্যাস আছে গার্দিওলার। গত মৌসুমে যদিও বাড়তি কিছু করতে গিয়ে ভজকট পাকাননি এই স্প্যানিশ কোচ। এবারও তেমন কিছুরই প্রত্যাশা থাকবে সিটি সমর্থকদের।
দুই কোচের মর্যাদার লড়াই
এ ম্যাচে ডাগআউটে পেপ গার্দিওলা ও আনচেলত্তির লড়াইটাও হবে দেখার মতো। আনচেলত্তি সব সময় বড় মঞ্চের নায়ক। ঠান্ডা মাথায় বড় ম্যাচগুলো কীভাবে বের করে আনতে হয়, সেটা তাঁর ভালোই জানা। এমনকি প্রয়োজনে দলকে ফলনির্ভর ফুটবল খেলাতেও দ্বিধা করেন না এই ইতালিয়ান কোচ। তবে আনচেলত্তি এমন কোচ, যিনি দেখিয়েছেন প্রতি-আক্রমণনির্ভর খেলাও অনেক সময় ধ্রুপদি হয়ে উঠতে পারে।
ইয়োহান ক্রুইফ-দর্শন স্কুলের ছাত্র গার্দিওলা অবশ্য সব সময় নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দলকে খেলাতে চান। তবে এমন নয় যে তিনি ফলের জন্য খেলেন না। বরং নিজের কৌশলে স্থির থেকেই ফল নিজের পক্ষে আনতে চান এই স্প্যানিশ কোচ। গার্দিওলা বল দখলে রাখা পছন্দ করলেও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তিনি সেটা করেন না। মূল লক্ষ্যই (গোল করা) তাঁকে চালিত করে এ কৌশলের দিকে। যে কারণে অনেক সময় খেলোয়াড়দের পজিশন বদলে দিয়েও চমকে দেন গার্দিওলা। এসব পরিবর্তন বেশির ভাগ সময়ই ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে দলের জন্য। আজও তেমন একটা ইতিবাচক ম্যাচের অপেক্ষায় থাকবেন সিটির সমর্থকেরা।
শেষ কথা
রিয়াল চ্যাম্পিয়নস লিগের চিরকালীন রাজা। তবে বর্তমান রাজত্ব সিটির দখলেই। এ দুই রাজার লড়াইয়ে জয় যারই হোক, ফুটবল রোমান্টিকদের প্রত্যাশা থাকবে সুন্দর ফুটবলের। এমন একটা রাতের জন্যই যে ফুটবলপ্রেমীরা থাকেন দীর্ঘ অপেক্ষায়। আর এমন অপেক্ষার রাত রাঙিয়ে দিয়ে ফল নিজেদের পক্ষে নিতে চাইবে রিয়াল-সিটি দুই দলই। কারণ, কে না জানে এ লড়াইয়ে যারা জিতবে, শিরোপা হয়তো তাদেরই হবে। অন্তত গত দুই মৌসুমের ফল সেটাই বলছে!