গার্দিওলার নজরে পড়ার সুযোগ আজ রুনির সামনে
মাঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। গ্যালারিতে ‘রুনি! রুনি!’ ধ্বনি। ওল্ড ট্রাফোর্ডের ‘ক্ল্যাসিক’ মুহূর্তগুলোর একটি। কিন্তু সেদিন (৮ নভেম্বর, ২০২৩) জায়গাটা ‘থিয়েটার অব ড্রিমস’ ছিল না। কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়াম সেদিন ইউনাইটেডের জন্য হয়ে উঠেছিল ‘থিয়েটার অব নাইটমেয়ার্স’—দুঃস্বপ্নের রঙ্গমঞ্চ! এফসি কোপেনহেগেন সমর্থকদের বিশাল ‘তিফো’য় ঠিক এ কথাটিই লেখা ছিল। আর মাঠে সেটা সত্যি প্রমাণ করেছিলেন ১৭ বছর বয়সী এক রুনি।
আমার মতো বাবাও বয়সে তার তুলনায় বড়দের সঙ্গে খেলেছেন। তিনি সিরিয়ার অন্যতম বড় ক্লাবে খেলেছেন এবং বয়সভিত্তিক পর্যায়ে পুরস্কারও জিতেছেন। কিন্তু পরিবারের দেখাশোনা করতে খুব অল্প বয়সে ফুটবল ছেড়ে দিতে হয়।রুনি বারদিজি, কোপেনহেগেন
ইউনাইটেড-কোপেনহেগেন ম্যাচ তখন ৩-৩ গোলে সমতায়। ৮৭ মিনিটে রুনির গোলে হার নিশ্চিত হয়েছিল ইউনাইটেডের, পরের দুই ম্যাচে এক ড্র ও হারে গ্রুপ পর্ব থেকে ইউনাইটেডের বিদায়ের পথটা তৈরি করে দিয়েছিল পার্কেনের সে হার, আরও সংক্ষেপে বললে রুনির গোল!
আগেই বলে রাখা উচিত, এই রুনির সঙ্গে ইউনাইটেডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা ওয়েইন রুনির কোনো সম্পর্ক নেই। কিংবা তাঁর বাবাও ইউনাইটেডের ভক্ত নন। ভাই রায়ানের নামও ইউনাইটেড কিংবদন্তি রায়ান গিগসের নামে রাখা হয়নি। কথাটা বিশ্বাস না হলে রুনি বারদিজির মুখেই শুনুন। গত জানুয়ারিতে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘আমার নামের সঙ্গে ওয়েইন রুনির কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মা সৌভাগ্যের এই নামটা রেখেছিলেন।’
কিন্তু রুনি বারদিজির অন্য নামও আছে। ইউরোপিয়ান ফুটবলের একটু গভীরে চোখ রাখলে সেই নামগুলোও আপনার জানা—সুইডিশ মেসি, দ্য নেক্সট জ্লাতান, দ্য নিউ রুনি! তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানা, রুনির খেলার ধরনের সঙ্গে মিল আছে লিভারপুলের মিসরীয় তারকা মোহাম্মদ সালাহর। আর মাঠের বাইরে? বিবিসির মন্তব্যটি দেখুন—‘পাদপ্রদীপের আলো রুনি বারদিজির অহর্নিশ সঙ্গী।’ নতুন কোনো প্রতিভাকে দেখলেই যেখানে রব ওঠে, ‘নতুন মেসি’, ‘নতুন রোনালদো’ কিংবা ‘নতুন সালাহ’, সেখানে রুনি বারদিজি যেন একের ভেতর চার—মেসি, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, রুনি এবং সালাহ!
তবে এই রুনি অন্য কিছু উঠতি তারকাদের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম। ‘পরবর্তী মেসি/রোনালদো/সালাহ’—নাম নিয়ে হারিয়ে যেতে চান না। এই রুনি বিশ্বের সেরা ফুটবলার হতে চান এবং সে জন্য পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছেন, ‘আমি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতে চাই...সেই লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বসেরা হতে চাই...স্বপ্ন দেখলে বড় করেই দেখা উচিত।’
রুনির এই স্বপ্নের শিকড় খুঁজতে তাঁর বাবার দিকে একবার তাকাতে হয়। সুইডিশ ফুটবলের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ২০২০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন বাবার কথা, ‘আমার মতো বাবাও বয়সে তার তুলনায় বড়দের সঙ্গে খেলেছেন। তিনি সিরিয়ার অন্যতম বড় ক্লাবে খেলেছেন এবং বয়সভিত্তিক পর্যায়ে পুরস্কারও জিতেছেন। কিন্তু পরিবারের দেখাশোনা করতে খুব অল্প বয়সে ফুটবল ছেড়ে দিতে হয়।’
সিরিয়ার আলেপ্পোতে রুনির মা-বাবার পরিচয়। কাজের খাতিরে সিরিয়া ছেড়ে কুয়েতে চলে যান রুনির বাবা-মা। ২০০৫ সালে সেখানেই জন্ম রুনির। ছোটবেলায় খেলার পুতুল নয়, ফুটবল নিয়ে ঘুমাতেন রুনি। তাঁর বয়স যখন তিন বছর, বাবা স্থানীয় একটি পিচ (ছোট খেলার মাঠ) ভাড়া করেছিলেন ছেলের খেলার জন্য। নিজেও খেলতেন, আসলে রুনিকে দেখিয়ে দিতেন, ধরিয়ে দিতেন খেলার খুঁটিনাটি কৌশল। এভাবে তিন বছর কেটে যাওয়ার পর ২০১২ সালে উন্নত জীবনের খোঁজে রুনি, রায়ান এবং তাঁদের মা সাড়ে তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সুইডেনে চলে আসেন। সেখানে দক্ষিণাঞ্চলের শহর কালিঙ্গেতে বসবাস শুরু করেন। রুনির বাবা পরে এসে যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে।
বাবাহীন সেই সময়টা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু ফুটবল সবকিছু সহজ করে দিয়েছিল। সুইডেনে গিয়ে রুনির বিভিন্ন বাড়ি লাগোয়া ছোট ছোট ফুটবল মাঠ দেখে বুঝে ফেলেছিলেন, সময়টা একদম মন্দ কাটবে না। স্থানীয় খুদেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সুইডিশ ভাষাটাও শিখে ফেলেছিলেন মাত্র তিন মাসের মধ্যে!
সুইডেনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রুনি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলেননি। কিন্তু ফুটবলে শুরু থেকেই প্রচণ্ড সিরিয়াস ছিলেন। বয়সভিত্তিকে প্রথম ক্লাব কালিঙ্গেতে ছয় বছর বয়সে যোগ দেওয়ার পর দেখলেন ম্যাচ হারলেও দলটির তেমন হেলদোল নেই। ক্লাব পাল্টে তাই যোগ দেন রোদেবে এআইএফে—সেখানে খেলেছেন ৯ থেকে ১৩ বছর। ২০১৯ সালে সেই ক্লাবও পাল্টে প্রথম বড় পদক্ষেপ রাখেন সুইডিশ ক্লাব মালমোয় যোগ দিয়ে। ২০২০ সালে নিজের ১৫তম জন্মদিনের কেক কেটেছিলেন ডেনিশ ক্লাব কোপেনহেগেনে যোগ দিয়ে। ২০২১ সালে ডেনিশ ক্লাবটির মূল দলে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত সব সময় বয়সে বড়দের সঙ্গে খেলতে হয়েছে রুনিকে। কারণ? অমিত প্রতিভা!
রুনির মুখেই শুনুন, ‘সব সময় বড়দের সঙ্গে খেলতে হয়েছে। ৯ থেকে ১০ বছর বয়সে খেলেছি বয়সে আমার চেয়ে ২-৩ বছরের বড়দের সঙ্গে। এটা সয়ে গেছে, এটা নিয়ে আর ভাবি না। কারণ, ম্যাচে খারাপ খেললে সবাই এই কথাটা বলে, আমার বয়স কম, এখনো শেখার অনেক সুযোগ আছে।’
চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৮ বছর পূর্ণ করার আগেই ১৫তম খেলোয়াড় হিসেবে গোল পেয়েছিলেন রুনি। তাঁর পছন্দের কোনো দল নেই, এমনকি আদর্শ বলেও সেভাবে কাউকে দেখেন না। তবে খেলতে চান শুধু মেসি এবং নিজের ভাই রায়ানের সঙ্গে।
কোপেনহেগেনে যোগ দিলেও পরিবারের সঙ্গে রুনি সুইডেনেই থেকে যান। তাঁর দিন শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। ওরেসান্ড ব্রিজ পার হয়ে ডেনমার্কে ঢুকে স্কুল এবং অনুশীলন শেষ করে সুইডেনে নিজ বাসায় ফিরতে ফিরতে রান সাড়ে আটটা বেজে যায় রুনির। এই পরিশ্রম এবং নিয়মানুবর্তিতাই একদিন শিখরে পৌঁছে দেবে বলে বিশ্বাস তাঁর। এমনিতে তিনি রাইট উইঙ্গার। স্ট্রাইকার এবং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেও পারঙ্গম। তবে গোল বানাতে এবং রক্ষণ ভাঙতেই বেশি পছন্দ রুনির।
স্ট্রাইকারদের মতো শুধু বক্সে আটকে থাকতে চান না। বাঁ পা–টা কখনো চাকু, কখনো আবার তুলি হয়ে ওঠায় সালাহ এবং মেসি—দুজনের সঙ্গেই রুনির খেলার মিল রয়েছে। কুয়েতে থাকতে রুনির ঘরে শুধু মেসির পোস্টারই ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘শুধুই মেসি, অন্য কেউ না। তার ভিডিও দেখে মাঠে সেটাই করার চেষ্টা করেছি।’
চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৮ বছর পূর্ণ করার আগেই ১৫তম খেলোয়াড় হিসেবে গোল পেয়েছিলেন রুনি। তাঁর পছন্দের কোনো দল নেই, এমনকি আদর্শ বলেও সেভাবে কাউকে দেখেন না। তবে খেলতে চান শুধু মেসি এবং নিজের ভাই রায়ানের সঙ্গে। সুইডিশ, ডেনিশ, অ্যারাবিক এবং ইংরেজি—এই চারটি ভাষা তাঁর জানা। জার্সিতে শুধু ‘রুনি’ নামটা রেখেছেন কারণ ‘বারদিজি’ নামটা সবার উচ্চারণে সমস্যা হবে তাই। তাঁর ভাই ১৪ বছর বয়সী রায়ান কোপেনহেগেন অনূর্ধ্ব–১৭ দলে আছে। তার খেলার সঙ্গে সের্হিও আগুয়েরোর মিল পান রুনি।
রায়ানের কাছে জাতীয় দল এবং ক্লাবে ভাইয়ের সঙ্গে খেলাটা এখনো ‘স্বপ্ন।’ তবে তাঁদের বাবা বড় ছেলেকে নিয়েই বেশি স্বপ্নাতুর, ‘ওর ওপর আমার অমিত আস্থা। সে কখনো আমাকে হতাশ করেনি। সব সময়ই বিশ্বাস করেছি, সে শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসতে পারবে।’
রুনির সেই উঠে আসার পথে আজ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলোর প্রথম লেগে আজ কোপেনহেগেনের মাঠে নামবে ম্যানচেস্টার সিটি। সেই সিটি, যেখানে রুনির যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ডেনিশ সংবাদকর্মী নিকোলাস দেগানের ভাষায়, ‘সে হয়তো প্রিমিয়ার লিগের গ্রেট কোনো ক্লাবে যোগ দেবে। এমন কোনো ক্লাব, যারা বল দখলে রেখে খেলতে ভালোবাসে। সেটি ম্যানচেস্টার সিটি কিংবা লিভারপুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সালাহর খেলার সঙ্গেও তার অনেক মিল।’
তাহলে রুনির জন্য এই ম্যাচটা তো বড় সুযোগ। বিশ্বসেরাদের কাতারে উঠে আসতে তাঁর সেই যে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা—সেখানে আজকের ম্যাচটি অনেক বড় ধাপ। পেপ গার্দিওলার নজরে পড়লে নিশ্চয়ই আরেকটু হাওয়া লাগবে রুনির স্বপ্নে!