সময়টা এখন আর মেসি-রোনালদোর নেই—আজ এ কথাটা পোক্ত হওয়ার রাত।
২০০৮ থেকে ২০১৭—এই ১০ বছরে ব্যালন ডি’অরে নিরঙ্কুশ আধিপত্য চলেছে দুই কিংবদন্তির। দুজনের মধ্যে কেউ না কেউ জিতেছেন। আর গত ১৪ বছরে ১৩ বারের মধ্যে ১২ বারই জিতেছেন তাঁদের মধ্যে কেউ। লিওনেল মেসি এর মধ্যে জিতেছেন ৭ বার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ৫ বার।
লুকা মদরিচ বেরসিক। ২০১৮ সালে বাদ সাধলেন তাঁদের রাজত্বে। সে বছর রোনালদোর রানার্সআপ হওয়া, মেসির পঞ্চম হওয়া দেখে কেউ কেউ বলেন, ভোটাররা সম্ভবত ঠিক করে রেখেছিলেন তাঁদের রাজত্বের অবসান ঘটাতে হবে!
কিন্তু পরের বছর মেসি জেতায় তা আর হয়নি। ২০২০ সালে মেসি-রোনালদোর রাজত্ব হারানোর সম্ভাবনাটা আবার জেগেছিল। রবার্ট লেভানডফস্কির হাতে ব্যালন ডি’অর দেখছিলেন সবাই। করোনাভাইরাস খেয়ে দিল! মানে, ব্যালন ডি’অরই দেওয়া হয়নি। পরের বছর যখন দেওয়া হলো, তখন আবারও মঞ্চে মেসি, ট্রফিটা উঠল তাঁর হাতেই। চাইলে তাঁদের রাজত্বের পটভূমিও বিবেচনায় আনা যায়।
২০০৭ ব্যালন ডি’অর কাকা জিতলেও দুইয়ে ছিলেন রোনালদো, তিনে মেসি। সেই কাকা এখন ব্যালন ডি’অর নিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা কুইজের বিষয়বস্তু—‘মেসি-রোনালদোর রাজত্বের পত্তন ঘটার আগে সর্বশেষ ব্যালন ডি’অর জয়ী কে?’
অর্থাৎ, গত ১৬ বছরের মধ্যে এবারই প্রথমবারের মতো পুরস্কারটি জয়ের ধারেকাছেও নেই মেসি-রোনালদো। প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁকে নিয়ে খবর ভাসছে, এত বেশি ভোট পেয়েছেন যে চমকে গেছে পুরস্কারটি যারা দেয় সেই ‘ফ্রান্স ফুটবল’—তিনি করিম মুস্তফা বেনজেমা।
লিঁওতে একসময় যিনি ৪৪ নম্বর জার্সি পরে খেলতেন, মনের মধ্যে স্বপ্ন ছিল বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকার হবেন। ৯ নম্বর জার্সির প্রতি লোভ ছিল। আদর্শ ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো। বেনজেমার ভাষায়, ‘রোনালদোর খেলায় মজে ছিলাম। তিনি সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার। তার ভিডিও দেখে নকল করার চেষ্টা করেছি। কাজটা সহজ ছিল না।’
একেবারে যে পারেননি তা নয়, বক্সে ওয়ান টাচ ফিনিশ, বডি ডজে রক্ষণ চিরে ফেলা, নিখুঁত নিশানা—নিখাদ স্ট্রাইকার হওয়ার সব গুণই ছিল বেনজেমার। ছিল—বলতে হচ্ছে কারণ, সেই গুণগুলো যে এখন আর তাঁর নেই, তা নয়। কিন্তু স্ট্রাইকারের সব দক্ষতা মেলে ধরার চেয়ে এক দশক ধরে ফুটবলার, বল প্লেয়ার বেনজেমাকেই বেশি দেখা যায়। গোল করছেন, করাচ্ছেন, খেলা তৈরি করছেন বা কখনো কখনো বল কাড়তেও দেখা যায়। রিয়াল মাদ্রিদ চাপে পড়লে ভূমিকাটা থাকে নেতার, শুধু স্ট্রাইকারের নয়—গোল করে দায়িত্ব সারাই যাঁর কাজ।
ফ্রান্সে ব্যালন ডি’অর দেওয়ার মঞ্চ তিয়াটর দু শাতলেতে তাই আজ যে বেনজেমার হাতে ব্যালন ডি’অর ট্রফি দেখা যাবে, তার নেপথ্যে বিসর্জনের গল্পও আছে। বেনজেমা ও রোনালদো দুজনেই ২০০৯ সালে রিয়ালে এলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রোনালদো যে তারকা-দ্যুতি নিয়ে এসেছিলেন, তত দিনে উইঙ্গার থেকে গোল করাতেও দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন পর্তুগিজ তারকা, হিসাবটা তাই পরিষ্কার হয়ে যায়—রিয়ালের আক্রমণভাগে রোনালদোই ‘ব্যাটম্যান’, বেনজেমা তাঁর সহকারী ‘রবিন’।
তারপর সেই নিখুঁত নিশানায় মরচে না পড়লেও চর্চার অভাবে মাঝেমধ্যে যেমন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন, তেমনি মুদ্রার অপর পিঠও আলোকিত হয়েছে—খেলা তৈরি, গোল বানানো এসব। তাতে সত্যটা লুকোনো যায় না। রোনালদোর ছায়ায় ঢাকা পড়েন বেনজেমা। আলোটা ফুটল ছায়াটা সরে যাওয়ার পর, যখন প্রায় গোধূলি হয়ে এসেছে।
তা–ই তো! ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত খেলোয়াড়দের তালিকায় থাকলেও বেনজেমা একটি ভোটও পাননি। কখনো সেরা তিনেও জায়গা হয়নি এ সময়। ২০১৮ সালে রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর ধীরে ধীরে ছবিটা পাল্টে গেল। ফুটবলের ভাষায়, বক্সের বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকা শুরু করলেন বেনজেমা। বলা যায়, করতে হলো।
রোনালদোর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারছিল না রিয়াল। বাঁ প্রান্ত কিংবা ডান প্রান্ত থেকে বাঁকানো কিক নিতে হলো নিয়মিত। কখনো ওয়ান-টু করে ঢোকা, কখনো আবার অফ দ্য বল মুভমেন্টে রক্ষণ চিরে ফেলা—মোটকথা, ইকার ক্যাসিয়াসের ভাষায় একজন ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’-এর প্রয়োজন ছিল রিয়ালের। বেনজেমার ছটায় তা মিটছেও।
তত দিনে সবাই একটি বিষয় ভুলেও গেছেন, এই ইউরোপিয়ান ফুটবলে আরেকজন ‘রোনালদো’ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন বেনজেমা। কিন্তু পরিস্থিতি ও দলের প্রয়োজনে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতায় তাঁর সেই পরিচয় সবাই ভোলার পথে। ফরাসি তারকা না শুধু রিয়ালের স্ট্রাইকার, না মিডফিল্ডার, না উইঙ্গার—প্রাণভোমরা। কিন্তু ফুটবলে ‘প্রাণভোমরা’ নামে কোনো পজিশন নেই।
অলিখিতভাবে যা আছে রিয়ালে, সেটা আগেই বলে দিয়েছেন রদ্রিগো। ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ২০১৯ সালে রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর বেনজেমার কাছ থেকে পাওয়া সেরা পরামর্শটা কী, তা জানেন? রদ্রিগোর মুখেই শুনুন, ‘বলটা আমাকে দেবে—এটা।’
অর্থাৎ, পরিস্থিতি যা–ই হোক, দলের প্রয়োজনে কখনো রুডিগার, কখনো মদরিচ, কখনো ভালভের্দে আবার কখনো রোনালদো হতেই আপত্তি নেই বেনজেমার। সব সময় বল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তো তাই বলে! যেকোনো কাজে ভূমিকা রাখতে চান। এই ক্ষুধা তাঁকে কোথায় তুলেছে, তা দেখে নেওয়া যাক।
২০২১-২২ মৌসুমে রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগা জয়ের পাশাপাশি ৪৬ ম্যাচে ৪৪ গোল করেছেন বেনজেমা। রিয়ালে প্রথম ১২ মৌসুমে মৌসুমপ্রতি তাঁর গড় গোল ছিল ২৩টি করে। গত মৌসুমে সেটাই বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ! রোনালদো যাওয়ার পর রিয়াল প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতল সে মৌসুমে—যেখানে বেনজেমা সর্বোচ্চ গোলদাতা; উয়েফার সে মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় এবং বর্ষসেরাও।
মজার বিষয়, বেনজেমা নিজেকে এভাবে রূপান্তরের মাঝেই ভুলে যাওয়া স্বপ্নে তা দিয়েছেন, দিচ্ছেন। পিএসজির বিপক্ষে শেষ ষোলো ফিরতি লেগে ১৭ মিনিটের মধ্যে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই হ্যাটট্রিক, কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগে চেলসির জালে হ্যাটট্রিক, ফিরতি লেগে উইনিং গোল ও সেমিফাইনালের দুই লেগ মিলিয়ে আরও ৩ গোল—বেনজেমাই তো রিয়ালকে তুলেছেন ফাইনালে।
আর ফাইনাল পর্যন্ত ম্যাচের গতি ঘুরিয়ে দেওয়া সেসব মুভ ও পাস—নিখাদ স্ট্রাইকার যেভাবে দলের সব ম্যাচে গোল করে ভূমিকা রাখতে চান, বেনজেমা মনে মনে এখনো নিজেকে সে ভূমিকাতেই দেখেন, তাই দরকারের সময় তাঁর সব কাজের কাজি হয়ে ওঠা। তাই দলের প্রয়োজনে এই ৩৪ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়তে হয়।
লা লিগায় গত মৌসুমে জিতেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম পিচিচি—৩২ ম্যাচে ২৭ গোল। এর মধ্যে অনেক গোল আছে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া। শুধু ক্লাবের হয়েই নয়, ফ্রান্সের হয়ে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করেছেন বেনজেমা। উয়েফা নেশনস লিগের ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে ফ্রান্সের ২-১ ব্যবধানে জেতার রাতে গোল করেছিলেন এই স্ট্রাইকার।
বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, ব্যালন ডি’অরের মোড় এবার বেনজেমার দরজায় গিয়েই থামবে। লেভানডফস্কি যেমন বলেই রেখেছেন, ‘পুরস্কার বাতিল না করলে বেনজেমাকেই দিতে হবে।’
এটাই! আজ রাতটাই বেনজেমার সেই রাত। যে রাতে একটি ঘোষণায় জ্বলে উঠবে তাঁর বিসর্জনের প্রদীপ।
৩৫ বছরে পা রাখার দুই সপ্তাহ আগে, যখন তারকা খেলোয়াড়েরা অবসরের দিনক্ষণ নিয়ে হিসাব করেন, তখন বেনজেমার হাতে উঠবে তাঁর শুধু স্ট্রাইকিং-সত্তা বিসর্জন দিয়ে পরিপূর্ণ ফুটবলার হয়ে ওঠার পুরস্কার, রিয়ালের নেতা হয়ে ওঠার বৈশ্বিক স্বীকৃতি। ১০ বছর বয়সে বেনজেমা যখন লিঁওর যুব দলে ঢুকলেন, তখন হয়তো এ স্বপ্ন দেখেননি। তখন তাঁর চোখে রোনালদো নাজারিও হওয়ার স্বপ্ন।
ব্ল্যাকমেল বিতর্কে তো প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জাতীয় দল থেকেই দূরে ছিলেন। সেই চোরাবালি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেনজেমা প্রমাণ করেছেন, এভাবেও ফিরে আসা যায়!
কীভাবে? গত এপ্রিলে রিয়াল কিংবদন্তি ইকার ক্যাসিয়াসের একটি টুইট দিয়ে তা বোঝানো যায়। রিয়ালে বেনজেমা কতখানি, তা বোঝাতে আবেগমাখা টুইটটি করেন ক্যাসিয়াস, ‘কে৯ (৯ নম্বর জার্সি পরা বেনজেমারের উদ্দেশে) স্পাইডারম্যান। কে৯ উলভারিন। কে৯ আপনার সেরা বন্ধু। কে৯ আপনার দাদি। কে৯ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কে৯ হলো সেই পথদ্রষ্টা, যার সঙ্গে আপনি প্যারাস্যুটে ঝাঁপ দিতে পারবেন। কে৯ আপনার গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল, কে৯ ঈশ্বর!’
শেষ কথাটি রূপক। বেনজেমা রক্ত-মাংসেরই মানুষ। আর মানুষ বলেই ভুল থেকে শিখেছেন। পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের দক্ষতাকে মানিয়ে আজ ক্যারিয়ারের সেরা রাতটার দেখা পেতে যাচ্ছেন। এই ৩৫ বছরের গোধূলিতে পা রাখার লগ্নে বেনজেমার হাতে যখন ব্যালন ডি’অর ট্রফিটা উঠবে, তখন তাঁকে স্ট্রাইকারই বলা হবে। তবু এই বেনজেমাই ব্যক্তিগত জীবনে কারও কারও জন্য উদাহরণও—নিজের স্বপ্ন (স্ট্রাইকার হওয়া) পূরণ না হলেও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে অন্য উচ্চতায় ওঠা যায়, যেখানে সেরার স্বীকৃতিও মেলে, আর মেলে আত্মোপলব্ধি।
সফলতা পেতে জীবনে দেরি বলে কিছু নেই!