শেষ সুতাটিও ছিঁড়ে চললেন ‘বুড়ো নেকড়ে’ জাগালো
‘মেজাজ এবং পেশাগত জায়গা থেকে আমি একজন বিজয়ী’—১৯৯৪ বিশ্বকাপের আগে কথাটা বলেছিলেন মারিও জাগালো। শীতের সকালে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে উঁকি দেওয়া সূর্যালোকের মতোই এ কথা থেকে চুইয়ে পড়ছে অহংকার ও গৌরব। অবশ্য তখন পর্যন্ত তিনবার ফুটবল বিশ্বকাপ জেতা একজন ফুটবলার ও কোচের কাছ থেকে এমন কথা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেখানে ফেরেঙ্ক পুসকাস, ইউসেবিও কিংবা ইয়োহান ক্রুইফদের মতো কিংবদন্তিরা একটি বিশ্বকাপ না পাওয়ার হতাশা নিয়ে ফুটবলে নিজেদের এপিটাফ লিখেছেন, সেখানে জাগালোর নামের পাশে থাকা তিনটি বিশ্বকাপ ট্রফিই সাক্ষী দিচ্ছে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের।
আজ অন্য লোকে পাড়ি দেওয়া জাগালোর শুরুটা অবশ্য এমন সরল ছিল না। লাতিন ফুটবলারদের জন্য ‘ভিনি ভিডি ভিসি’ (এলাম, দেখলাম, জয় করলাম) তো কখনোই নয়। জাগালোর জন্যও ছিল না। ১৯৫০ সালে কিনারায় দাঁড়িয়ে ব্রাজিলের ফুটবলকে খাদে পড়তে দেখেছিলেন জাগালো। সেদিন একজন সেনাসদস্য হিসেবে মারাকানায় দর্শকদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর। সেদিন অবিশ্বাস্য হারে ব্রাজিলজুড়ে যখন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, তখন ৫ ফুট ৬ গড়নের ছোটখাটো মানুষটি মনে মনে ভিন্ন একটি গল্প লেখা শুরু করেছিলেন।
এত কাছ থেকে এমন আশ্চর্য পতন দেখার পরও পেশাগত কারণে আবেগ দেখানোর সুযোগ ছিল না, কিন্তু ভেতরে রীতিমতো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিলেন জাগালো। সেদিনই হয়তো অন্যদের আবেগের ওপর ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে নতুন এক শপথ নিয়েছিলেন জাগালো। নয়তো ফুটবলারই যে হওয়ার কথা ছিল না তাঁর। সেনাসদস্য হিসেবেই কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবন। কিন্তু সেদিনের পর সবকিছু বদলে গিয়েছিল।
সেদিন মারাকানায় ব্রাজিলের ফুটবলের কবর হতে দেখা জাগালোর অন্য রূপটা আমরা দেখব ৮ বছর পর। ব্রাজিলের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়কদের একজন হয়ে শিরোপা নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন জাগালো। বাইরে ও ভেতর থেকে খুব সম্ভবত ব্রাজিলের ফুটবলকে এমন উত্থান-পতনের গল্প লিখতে আর কেউ দেখেনি। তবে সুইডেনকে ফাইনালে হারিয়েই গল্পটার ইতি টানেনি জাগালো; বরং যাঁর জন্মই হয়েছে জেতার জন্য, তাঁর জন্য সেটা ছিল কেবলই শুরু।
ইতিহাসের পরের গল্পটা কেবল একজন দিগ্বিজয়ীর। ১৯৫৮ সালের পর ১৯৬২ সালেও খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতেন জাগালো। ১৯৬৪ সালে ইতি টানেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। দুটি বিশ্বকাপ জেতা একজন কিংবদন্তি হিসেবে জাগালোর গল্পটা শেষ হতে পারত সেখানেই। কিন্তু ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো জাগালোর গল্পটাও ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’! লেফট উইঙ্গার জাগালো এরপর আবির্ভূত হবেন একজন ‘মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান’ হিসেবে, যা তাঁর নামের পাশে জুড়ে দেয় ‘দ্য প্রফেসর’ খেতাবও।
জাগালো অবশ্য অনেকের কাছে ‘দ্য উলফ’ বা ‘বুড়ো নেকড়ে’ হিসেবেও পরিচিত; যদিও সেটা তাঁর ডাকনাম ‘লোবো’ হওয়ার কারণে। পর্তুগিজ এই শব্দের ইংরেজি অর্থ উলফ বা নেকড়ে। তবে এই ডাকনাম বাদ দিলেও খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে জাগালোর যে অর্জন, নেকড়ের মতো শিকারি প্রবৃত্তি ও বুদ্ধিমত্তা না থাকলে সেটি কি আদৌ সম্ভব হতো! অবশ্য কে জানে নিজের এই ডাকনামই হয়তো জাগালোকে আলাদাভাবে জাগিয়ে দিয়েছিল।
জাগালোর বিদায়ের পর ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ট্রফি জিততে ব্যর্থ হয় ব্রাজিল। সেই ব্যর্থতার পর ১৯৭০ সালের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় জাগালোকে। সেবার মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিল অবশ্য বাছাইপর্ব পার করেছিলে জোয়াও সালদানার অধীন। সালদানা ছিলেন একই সঙ্গে সাংবাদিক ও কোচ। সামরিক শাসন, পেলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া এবং প্রীতি ম্যাচে বাজে ফলাফলের কারণে মূলত দায়িত্ব হারান সালদানা। এরপর মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বিশ্বকাপের ডাগআউটে ব্রাজিলের নেতৃত্ব দিতে আসেন জাগালো। এরপর বাকিটা ইতিহাস।
জাগালোর নেতৃত্বেই ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল। এরপর ১৯৭৪ সালেও ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ নিয়ে যান জাগালো। তবে এবার আর পেরে ওঠেননি। সবাই হয়তো তখন বিশ্বকাপের সঙ্গে জাগালোর জুটির শেষও দেখে ফেলেছিল। কিন্তু কে জানত, আবার ২৪ বছর পর ব্রাজিলের ফুটবলের আরেকটি জাগরণের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে জাগালোর নাম। এবার তাঁকে দেখা গেল কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার সমন্বয়ক হিসেবে। আর ব্রাজিল চতুর্থ বিশ্বকাপ জিতে ছাড়িয়ে গেল সবাইকে। এরপর ২০০২ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলটির উপদেষ্টা হিসেবেও ছিলেন ব্রাজিলের এই ‘বুড়ো নেকড়ে’।
২০০২ সালের পর থেকে ব্রাজিলের ফুটবল অদ্ভুত এক পতনের দিকে এগিয়েছে, যার শেষ কৃত্য শুরু হয়েছে ২০২২ বিশ্বকাপের পর। কাতার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের পর থেকে বড় ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল। এখনো পূর্ণ মেয়াদে কোনো কোচ নিয়োগ দিতে পারেনি ব্রাজিল। একের পর এক হারে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে নেমে গেছে ৬ নম্বরে। দলের সেরা তারকা বিবেচিত হওয়া নেইমার চোট নিয়ে ছিটকে গেছেন কোপা আমেরিকা থেকে। এর মধ্যে এসব ক্ষতের যন্ত্রণা আরও বাড়াচ্ছে একের পর এক আইকন ও অনুপ্রেরণার বিদায়।
বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার কদিন পরই বিদায় নেন মহারাজা পেলে। আর আজ জীবন-সুতা ছিঁড়ে বিদায় হলো জাগালোর, ছিঁড়ছে ওই বিশ্বকাপজয়ী দলটির সঙ্গে এই প্রজন্মের সংযোগের সুতাও। কাকতালীয়ভাবে একইদিন ব্রাজিল তাদের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ফার্নান্দো দিনিজকেও ছাঁটাই করেছে।
যেন বলেই দেওয়া হচ্ছে, অতীতের ভান্ডার শেষ হচ্ছে, সুতা ছিঁড়ছে। এখান থেকেই শুরু করতে হবে নতুন করে উল বোনা। তবে না থেকেও অনুপ্রেরণায় পেলে-জাগালোরা তো আছেনই। সব সময়ই থাকবেন। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবল পারবে তো!