অর্থনীতির পছন্দের আর্জেন্টিনাই ফাইনালে

CARL RECINE

সময়টা খারাপ। মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া, মন্দার আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে পুরো বিশ্ব। তাই কবিতাটা খানিকটা বদলে এভাবে লেখা যায়, ‘প্রিয়, ফুটবল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা।’ তারপরও অবশ্য মোটেই কমবে না বিশ্বকাপ ফুটবলের চির পরিচিত উন্মাদনা।

বিশ্ব অর্থনীতির সংকট বিশ্বের প্রায় সব দেশকে স্পর্শ করলেও ব্যতিক্রম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ২৯ লাখের কিছু বেশি জনসংখ্যা নিয়ে মাথাপিছুর আয়ের দিক থেকে কাতার বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। ফলে বিশ্বকাপ আয়োজনে ২২ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ খরচ করা কাতারের পক্ষেই কেবল সম্ভব।

যেখানে রাশিয়া ২০১৮ সালে ব্যয় করেছিল ১১৬ কোটি ডলার এবং ২০১৪ সালে ব্রাজিলের ব্যয় ছিল ১৫০ কোটি ডলার। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপের আয়োজক দেশগুলো সব মিলিয়ে ব্যয় করেছে ৪৮ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এমনকি ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে যত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, কাতার একাই তার চেয়ে বেশি খরচ করছে। কাতারের বিশ্বকাপ ব্যয় বাংলাদেশের চারটি বাজেটের সমান।

কাতারের কী লাভ

সাধারণত আয়োজক দেশগুলো চায় বিশ্বকাপ ফুটবল তাদের অর্থনীতিকে আরও চাঙা করবে। যদিও কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চেয়েছে অর্থের জন্য নয়, বরং নিজেদের গুরুত্ব ও প্রভাব বাড়াতে। এর পেছনে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতির ভূমিকাই বেশি। সুতরাং যেকোনো উপায়ে আয়োজক হতে পারাটাই ছিল কাতারের একমাত্র লক্ষ্য।

মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনবিসি ৬ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বকাপ আয়োজনে অনেক দেশই অবকাঠামো নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয় করে, যা তাদের ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বাড়িয়ে দেয়। পরে সেসব স্টেডিয়াম বা স্থাপনা পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। যেমন ব্রাজিল ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের আয়োজন দেশ হিসেবে এক শ কোটি ডলারে নতুন করে বানিয়েছিল মানে গারিঞ্চা স্টেডিয়াম। সেই স্টেডিয়াম পরে বাস ডিপো হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।

আয়োজক দেশ হিসেবে কাতার এরই মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু দুর্নাম কুড়িয়েছে। ২০১৫ সালেই জানা যায় ৪১ জন ফিফা কর্মকর্তা আয়োজক দেশ বাছাই করতে ঘুষ নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

আর ২০১৬ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, কাতারে ১৭ লাখ অভিবাসী শ্রমিককে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়েছে, তাঁরা মজুরি পেয়েছেন অনেক কম, কর্মপরিবেশও ছিল যথেষ্ট খারাপ। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লিখেছে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে কাতারে সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক মারা গেছেন, যাঁরা ছিলেন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক।

কাতার নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, এবারের বিশ্বকাপ থেকে তাদের আয় হবে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি। তবে ক্রেডিট রেটিং সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস বলছে, আসরটি কেন্দ্র করে প্রায় ১৫ লাখ পর্যটক আসবে ঠিকই, তবে এ জন্য লাভবান হবে দুবাই। দুবাইয়ের পর্যটন খাত অত্যন্ত শক্তিশালী, আকাশপথে দূরত্ব মাত্র দুই ঘণ্টা। এ কারণে ফুটবল দেখতে আসা টিকিটধারীদের বড় অংশই দুবাইতেই অবস্থান করবে।

সব লাভ ফিফার

আয়োজক দেশ হতে ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা ফিফার জন্য মূলত দুটি বড় শর্ত মানতে হয়। যেমন খেলার উপযোগী স্টেডিয়াম তৈরি এবং সব ধরনের কর ছাড়। ফিফা যদিও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, তারপরও তারা বিপুল মুনাফা করে মূলত টিকিট বিক্রি, প্রচারস্বত্ব এবং মার্কেটিং আয় থেকে। খরচের মধ্যে আছে আয়োজক দেশের বরাদ্দ। যেমন তারা কাতারকে দিয়েছে ১৭০ কোটি ডলার। এর বাইরের অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য প্রাইজমানি হিসেবে বরাদ্দ আছে ৪৪ কোটি ডলার। ফিফা মনে করছে, সব মিলিয়ে এবার তাদের আয় হবে ৪৭০ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন

২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ থেকে ফিফার আয় ছিল ৪৮০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রচারস্বত্ব থেকে আয় ২৪৩ কোটি ডলার, পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে পায় ১৬০ কেটি ডলার, আর টিকিট বিক্রির আয় ৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর ফিফার মুনাফা ছিল ২৬০ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে ফিফার মোট আয় ছিল ৫৪০ কোটি ডলার, মুনাফা ৩৫০ কোটি ডলার।

জয়ী হলে কত লাভ

বিশ্বকাপ ফুটবলে জয়ের প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতেও। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের পর থেকে বিজয়ী দেশের জিডিপি গড়ে আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০১০ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০০৯ সালে স্পেনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু পরের বছরেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি থেকে পুরোপুরি সরে এসেছিল স্পেন।

দেখা গেছে, বিজয়ী দেশের অর্থনীতি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বছরেই বেশি বাড়ে, পরে আবার কমে যায়। অর্থনীতিবিদের ভাষায় ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’-এর প্রধান কারণ। জয়ী দেশের ভোক্তারা খুশি হয়ে বেশি ব্যয় করেন, পানশালা ভর্তি থাকে, ভিড় বাড়ে সুপারমার্কেটগুলোতে, বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির, বাড়ে পর্যটক, জাতীয়তাবাদের চেতনা বইতে থাকে পুরো দেশজুড়ে। তবে অর্থনীতির ভিত দুর্বল থাকলে কিছু পরেই দেশটির নাগরিকেরা বুঝতে পারেন যে বিশ্বকাপ আসলে অর্থনীতির সব সমস্যার সমাধান দেবে না।

আরও পড়ুন

ফাইনালে পরাজিত দেশগুলো নিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানাচ্ছে, গত আটটি বিশ্বকাপের মধ্যে হারলেও চারটি দেশের জিডিপি বেড়েছে, কমেছে বাকি চারটির। তবে হেরে যাওয়ায় ইতিহাসে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন আর্জেন্টিনার নাগরিকেরা। জার্মানির কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে ট্রফি হারানোর পরে ২০১৪ সালে দেশটির জিডিপি আড়াই শতাংশ কমে যায়।

অর্থনীতি এবার কাকে চায়

২০০৬ সালে ডাচ ব্যাংক এবিএন-আমরো বিশ্বকাপ শুরুর আগে ‘সকারনোমিকস-২০০৬’ নামে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ইতালি জয়ী হলে সেটাই হবে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ভালো। কেননা, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ইতালির অর্থনীতি তাতে চাঙা হবে। সেবার ইতালি ঠিকই বিশ্বকাপ জয় করে নিয়েছিল। এবার প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে। সুতরাং সবারই জয় দরকার।

আরও পড়ুন

জোয়াকিম ক্লেমেন লন্ডনভিত্তিক লিবেরাম ক্যাপিটালের একজন স্টক ব্রোকার। শেয়ারবাজারের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে ২০ বছরের অভিজ্ঞ ক্লেমেনও এর আগে দুবার পূর্বাভাস দিয়ে সফল হয়েছিলেন। তাঁর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৪ সালে জিতেছিল জার্মানি, ২০১৮ সালে ফ্রান্স। এবার সঠিক হলে তিনি এ বিষয়ে হ্যাটট্রিক করবেন।

ক্লেমেনের মতে, এবারের বিজয়ী দেশ হবে আর্জেন্টিনা। স্পেনকে হারিয়ে তারা ফাইনালে যাবে, এরপর হারাবে ইংল্যান্ডকে। তিনি মূলত খেলোয়াড়দের গুণগত মান, অর্থনীতি ও ভাগ্যের সমন্বয়ে একটি গাণিতিক মডেল ব্যবহার করেছেন।

বিসিএ রিসার্চ কানাডাভিত্তিক একটি বিনিয়োগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণাও বলছে, এবার বিশ্বকাপ নেবে মেসির আর্জেন্টিনা, তারা ফাইনালে টাইব্রেকারে হারাবে পর্তুগালকে। আর পর্তুগাল ফাইনালে উঠবে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। গত বিশ্বকাপের সময়ে অবশ্য তাদের পূর্বাভাস ছিল জয়ী হবে স্পেন, যা শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিসিএ এবার বলছে, গতবারের ব্যর্থতার কারণে তারা এবার গবেষণার পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছে।

লয়েডস নামের একটি ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অবশ্য বলছে, এবার ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তুলবে ইংল্যান্ড। আর নকআউট পর্যায়ে তারা হারাবে যথাক্রমে সেনেগাল, ফ্রান্স ও স্পেনকে।

মূলত খেলোয়াড়দের বেতন, বয়স, কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা এবং খেলোয়াড়ি অবস্থান বিবেচনা নিয়ে একটি মূল্যমান তৈরি করে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। বলে রাখা ভালো, লয়েডস গত দুই বিশ্বকাপেই সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিল।

যে যতই পূর্বাভাস দিক, আসল খেলা হবে মাঠে। খেলার মাঠ আর অর্থনীতির সূচক একেবারেই আলাদা। সুতরাং পুরো প্রায় একটি মাস খেলা দেখা যাওয়াটাই আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ।

আরও পড়ুন