লামিনে ইয়ামাল: কৈশোরেই তার পা যেন হীরার ছুরি
মাখনে ছুরি চালানো বুঝি একেই বলে! পরশু রাতে ভিয়ারিয়াল-বার্সেলোনা ম্যাচে ১২ মিনিটের খেলা চলছিল, ডান প্রান্তে বক্সের বাইরে বল তখন লামিনে ইয়ামালের পায়ে। সামনে থাকা ডিফেন্ডার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইয়ামাল বল ফেলল ভিয়ারিয়ালের বক্সে। বলটা ভাসতে ভাসতে গিয়ে খুঁজে নিল দূরের পোস্টে অপেক্ষমাণ পাবলো গাভিকে। হেডে গোল!
সাধারণ চোখে সাদামাটা একটি ক্রস বলেই মনে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, ইয়ামালের ক্রসের মাহাত্ম্য। বাঁ পায়ে যে ক্রসটা ইয়ামাল করেছে, সেটি যেন পুরোটাই গজ ফিতা দিয়ে মাপা। বলের ওপর ইয়ামাল এমনভাবে পা চালিয়েছে, যেন এক টুকরা মাখনে ধারালো ছুরির টান! রোমান্টিক দর্শকেরা বলতে পারেন, এমন একটি ক্রসের জন্যই ফুটবল এত সুন্দর খেলা! এমন একটি মুহূর্তের জন্যই ফুটবল এত নান্দনিক।
গাভিকে দিয়ে গোল করিয়ে লা লিগায় সবচেয়ে কম বয়সে ‘অ্যাসিস্ট’ (গোল করানো) করা খেলোয়াড় হয়েছে ইয়ামাল। ১৬ বছর ৪৫ দিন বয়সী ইয়ামাল পেছনে ফেলেছে সতীর্থ আনসু ফাতির রেকর্ড। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ১৬ বছর ৩১৮ দিন বয়সে সতীর্থকে দিয়ে গোল করিয়েছিলেন ফাতি। তবে রেকর্ডটি দূরে সরিয়ে রাখলেও ক্রসটির সৌন্দর্য এতটুকু কমে না। এমনকি তার বয়স যে মাত্র ১৬ বছর, সেটি ভুলে গেলেও নয়!
ইয়ামালের ক্রস যেন হীরার খনি থেকে তুলে আনা একখণ্ড হীরার গল্প। সৃষ্টিশীলতার দ্যুতি ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ছড়িয়েছে ম্যাচের পরতে পরতে। ৫৬ মিনিটে বেরসিক পোস্টের কারণে ইয়ামালের গোল বঞ্চিত হওয়া সে মুহূর্তটির কথাই ধরা যাক। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মাথার ওপর দিয়ে যেভাবে ‘স্কুপ’ করে বল গাভিকে দিয়েছিল, সেটি সেরা সময়ের লিওনেল মেসিকেই মনে করিয়ে দেয়। ফিরতি বলে নেওয়া শটটা পোস্টে না লাগলে মৌসুমের দুর্দান্ত গোলের তালিকায় নিশ্চিতভাবে থাকতে পারত সেটি। পোস্ট একবার না একাধিকবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইয়ামালের সামনে।
পরে অবশ্য ইয়ামালের না পাওয়া গোলটির পাশে লেখা হয়েছে সতীর্থ রবার্ট লেভানডফস্কির নাম। যে গোলে ভিয়ারিয়ালকে ৪–৩ গোলে হারায় বার্সা। এদিন ইয়ামালকে আটকাতে প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়ই আসলে যথেষ্ট ছিলেন না, বরং দৈব কিছুরই প্রয়োজন ছিল। নয়তো ভিয়ারিয়ালের দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে নেওয়া শটটি কেন গোল হবে না! কে জানে, ভাগ্য কেন ইয়ামালের ওপর এত অভিমান করে ছিল! শেষ পর্যন্ত গোল না পেলেও ইয়ামাল এদিন যা করে দেখিয়েছে, তা বার্সা ভক্তদের ভুলতে সময় লাগবে।
অবশ্য ইয়ামালকে যে এমন কিছু করার জন্যই বার্সা দলে টেনেছে, সেটি তার বয়স দেখেই বোঝা উচিত। নয়তো গত জুলাইয়ে ১৫ পেরোনো ছেলেটাকেই কোন সাহসে মূল একাদশে নামিয়ে দেবেন জাভি! যা আমরা টেলিভিশনের পর্দায় এখন দেখছি, বার্সার কর্তারা নিশ্চয় তা আরও আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। ফুটবলে রত্ন তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ‘লা মাসিয়া’ থেকেই যে তার উত্থান। ইয়ামালের অভিষেক হয়েছে গত মৌসুমে। লা লিগায় রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে ম্যাচে ৮৩ মিনিটে গাভির বদলি হিসেবে মাঠে নামার সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর ২৯০ দিন।
স্পেনের শীর্ষ প্রতিযোগিতায় বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ইয়ামাল। বয়স ১৬ পূর্ণ হওয়ার আগে লা লিগায় অভিষিক্ত খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিল পঞ্চম। এরপর ইয়ামাল নিজেকে চিনিয়েছে হুয়ান গাম্পার ট্রফিতে। ৮০ মিনিটে নেমেই বদলে দেয় ম্যাচের গতিপথ। গোল না পেলেও বার্সার দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোলটিতে রাখে বড় অবদান। ভবিষ্যতে কী ঝড় তুলতে যাচ্ছে, সে ইঙ্গিত যেন সেদিনই দিয়ে রেখেছিল এই উইঙ্গার।
মেসি-ফাতির সঙ্গে ইয়ামালকে তুলনা করে জাভি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সে (ওদের মতো) একই ধরনের খেলোয়াড়। আক্রমণভাগে খেলার সহজাত প্রতিভা আছে। লামিনেকে (ইয়ামাল) ১৫ বছর বয়সী মনে হয় না। সে খুবই পরিপক্ব। খেলার জন্য প্রস্তুত, অনুশীলনেও ভালো করে। এই দলে একটি যুগের সূচনা ঘটাতে পারে সে।’
ইয়ামালের জন্ম ২০০৭ সালের ১৩ জুলাই কাতালুনিয়ান শহর মাতারোয়। তাঁর বাবা মরোক্কান এবং মায়ের বাড়ি গিনি। ২০১৪ সালে মাত্র ৭ বছর ফুটবল পায়ে জড়িয়ে যাত্রাটা শুরু করে ইয়ামাল। বার্সার বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে শুরু করে অনুশীলন।
লাজুক প্রকৃতির ছেলেটি অল্প সময়ের মধ্যে দলের ভেতর বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে। তবে মাঠে বল পায়ে মুহূর্তের মধ্যে বদলে ফেলে চরিত্র। গতি, ড্রিবলিং, নিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত পাস এবং শট—কী নেই ইয়ামালের ঝুলিতে! এসব গুণের সঙ্গে ঠান্ডা মাথা তাকে করে তুলেছে আরও বিধ্বংসী। প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে একাই। ইয়ামালের প্রতিভার ঝলক এরই মধ্যে ভিয়ারিয়াল-কাদিজের মতো দলগুলো দেখেছে। তবে এত নক্ষত্র-ফোটার মুহূর্ত মাত্র, পূর্ণ প্রস্ফুটিত হওয়ার যাত্রাটা আরও অনেক দূরের পথ।
ইয়ামালের গা থেকে এখনো শৈশবের গন্ধ যায়নি। যে বয়সে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকার কথা, সে বয়সে বার্সার হয়ে মাঠে নেমে হয়েছে ম্যাচসেরা খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে ইয়ামাল একটু ঘাবড়ে যাচ্ছে কি? উত্তরটা তার মুখেই শুনুন, ‘আমি ভীত নই। আমি মাঠে যাই এবং ফুটবল খেলি।’
ফুটবল কি তবে এতই সহজ যে মাঠে গেলেই খেলা হয়ে যায়? ইয়ামালের খেলা দেখলে অবশ্য তেমনটাই মনে হওয়ার কথা। তার পায়ে বল গেলেও তো মনে হয়, দুনিয়ায় এর চেয়ে সহজ খেলা আর কিছু নেই!
যখনই বল গেছে, ফুটবলকে খুব সহজ খেলা বলেই যে মনে হয়েছে।ই