ক্লপের বিদায়ের পর লিভারপুলের নতুন কোচ হবেন কে
‘আমি প্রায়ই ভাবি মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা কী হবে, তা নিয়ে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন, জীবনে কী করেছিলে, আমি কীভাবে জীবনকে অর্থবহ করেছি? বলব, আমি চেষ্টা করেছি ম্যাচ জেতার। “এটুকুই?”—তিনি জিজ্ঞাসা করবেন। হতাশও হবেন। তখন তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করব, আপনি যেমনটা ভাবছেন, ম্যাচ জেতা তার চেয়ে অনেক কঠিন।’
নিজের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই লাইফ ইন রেড অ্যান্ড হোয়াইট’—এ কথাগুলো লিখেছেন কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। ২২ বছর ধরে আর্সেনালের কোচে দায়িত্ব পালন করার পর ‘ওয়েঙ্গার আউট’ স্লোগানের ভেতরই ২০১৮ সালে বিদায় নেন এই ফরাসি কিংবদন্তি।
ওয়েঙ্গারের কথা ধরেই বলা যায়, ম্যাচ জেতা আসলেই অনেক কঠিন। আর সেটি যদি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হয় তবে কাঠিন্যের মাত্রাটা নিশ্চিতভাবে আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এই প্রিমিয়ার লিগেই ৯ বছর ধরে ম্যাচ জেতাকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তবে লিভারপুলে ক্লপ শুধু ম্যাচ জেতার কাজটিই করেননি, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিরও জন্ম দিয়েছেন। কখনো কখনো মাঠে হার–জিতের চেয়েও বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। সেটি কেমন, গতকাল ক্লপের বিদায় ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পণ্ডিত ও কোচদের মন্তব্যে চোখ রাখলেই বোঝা যায়।
বলা হয়, ফুটবল কোচদের ব্যাগ-পেটরা সব সময় গোছানোই থাকে। আর ফুটবল কোচের চাকরির অনিশ্চয়তা বোঝাতে উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়ালেখক ও সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালেয়ানো বলেছিলেন, ‘আজ যে কোচকে নিয়ে সমর্থকেরা উল্লাস করে তার অমরত্ব চাইছে, পরের রোববারে সেই একই কোচকেই তারা মরতে বলবে।’ ওয়েঙ্গারের মতো কোচকেও যে এমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল, সে কথা তো আগেই বলা হয়েছে। কোচিং এমনই অনিশ্চিত এক পেশা! তবে কথাটা যে সব সময় সত্যি নয়, ক্লপের বিদায় ঘোষণার পরই তা স্পষ্ট। গতকাল সেই ঘোষণায় ক্লপ যেমন আবেগে ভেসেছেন, তেমনি তাঁর জন্য চোখ ভিজেছে সমর্থকদেরও।
লিভারপুলের সঙ্গে ক্লপের চুক্তি ছিল ২০২৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু গত নভেম্বরেই নাকি তিনি ক্লাব কর্তৃপক্ষকে বিদায় নেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেন। জানিয়েছেন, এ মৌসুম শেষে আর থাকছেন না লিভারপুলে। কিন্তু কেন আকস্মিক এ সিদ্ধান্ত, সেই উত্তর লিভারপুল সমর্থকেরা তো বটেই, খুঁজছেন অন্য ক্লাবের সমর্থকেরাও। গতকাল থেকে ফুটবলকেন্দ্রিক গ্রুপগুলোতেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিল এই একটি বিষয়ই। বিদায়ের পেছনে ক্লপ কারণ হিসেবে ক্লান্তির কথা বলেছেন। বলেছেন, দম ফুরিয়ে এসেছে তাঁর। যে কারণে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে এর পেছনে ভিন্ন কারণও খুঁজছেন কেউ কেউ।
একই দিন সামনে এসেছে লিভারপুলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর জর্গ শামদতকের ক্লাব ছাড়ার ঘোষণাও। জানুয়ারির দলবদল শেষেই লিভারপুল ছাড়বেন এই পরিচালক। কেউ কেউ ক্লপের বিদায় ঘোষণার সঙ্গে এর সংযোগও দেখছেন। অনেক লিভারপুল সমর্থক ক্লপের বিদায়ের জন্য ক্লাব মালিক ফেনওয়ে স্পোর্টস গ্রুপকেও (এফএসজি) দোষ দিয়েছেন। ক্লাবে খেলোয়াড় কেনা নিয়ে এফএসজির ওপর লিভারপুল সমর্থকেরা অনেক দিন ধরেই ক্ষুব্ধ। সমর্থকদের ধারণা মালিক পক্ষের সঙ্গেই বোধ হয় কোনো বিরোধের জের ধরে ক্লপের এই সিদ্ধান্ত! যদিও এসব শুধুই অনুমান। এখন পর্যন্ত ক্লান্তির কাছে হার মানার খবরটিই ক্লপের লিভারপুল ছাড়ার একমাত্র কারণ।
ক্রীড়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ নিজেদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘ক্লপ সন্দেহবাতিকদের বিশ্বাসীতে রূপান্তর করেছিলে। কিন্তু লিভারপুল যে দিনটির ভয়ে ছিল, সেটি চলেই আসল।’ ৯ বছর ধরে লিভারপুল ও ক্লপ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিলেন একে অপরের সঙ্গে। ব্যর্থতার সঙ্গে কখনো যে ক্লপের ক্লাব ছাড়ার খবর সামনে আসেনি, তা নয়। কিন্তু সেসব গুঞ্জন বুদ্বুদের মতো অল্প সময়েই মিলিয়ে গেছে।
গত মৌসুমে লিভারপুল যখন প্রায় সব প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়েছিল, তখনো ক্লপের চাকরি নিয়ে ন্যূনতম কোনো শঙ্কা ছিল না। আর এবার তো ‘কোয়াড্রপল’ জয়ের সম্ভাবনাও জিইয়ে রেখেছে লিভারপুল। তাই খবরটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ছিল। তবে বিদায় ঘোষণার সময়ও লিভারপুল সমর্থকদের গর্বের কারণ হয়েছেন ক্লপ। জার্মান এই কোচ স্পষ্ট বলেছেন, প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবেন, কিন্তু ইংল্যান্ডে লিভারপুলের বাইরে আর কোনো দলকে কোচিং করাবেন না। একটি ক্লাব ও তার সমর্থকদের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
ক্লপের বিদায়ের বেদনাকে বুকে নিয়েই অবশ্য এখন তাকাতে হচ্ছে সামনের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম যে প্রশ্নটা সামনে এসেছে, সেটি হচ্ছে, ক্লপের পর কে? লিভারপুলের এই দলটিকে বলা যায় ক্লপের ‘হাতে বানানো’ দল। মোহাম্মাদ সালাহ, সাদিও মানে, রবার্তো ফিরমিনো, ভার্জিল ফন ডাইকদের মতো তরুণ প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করে তাঁদের তারকাখ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গেছেন। নিজের ‘গেগেনপ্রেসিং’ ফর্মুলায় তাদের গড়ে তুলেছেন।
এর মধ্যে লিভারপুল ছেড়ে যাঁরা অন্য ক্লাবে গেছেন তাদেরও কম বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে। কারণ, ক্লপ খেলোয়াড়দের নিজের ছাঁচেই গড়েছেন। পাশাপাশি গত দলবদলে লিভারপুলে এসেছেন অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টার, দমিনিক সোবোসলাই এবং ওয়াতারু এন্দোর মতো তরুণেরা। যাঁদের লিভারপুলে আসার পেছনে নিশ্চিতভাবেই বড় কারণ ছিলেন ক্লপ। কিন্তু তিনি মৌসুম শেষে যাওয়ার পর এই দলকে সামলানো অন্য যেকোনো কোচের জন্যই চ্যালেঞ্জিং হবে। এমনকি নতুন কারও অধীন ক্লাবের পারফরম্যান্সে ধসের আশঙ্কাও করেছেন কেউ কেউ। তবে পেশাদার ফুটবলে অতীত ভুলেই শেষ পর্যন্ত সামনে এগোতে হয়। আর এটা তো জানাই যে সব ভালো কিছুই কখনো না কখনো শেষ হতে হয়।
ক্লপের পর লিভারপুলের কোচ হওয়ার দৌড়ে যে নামটি সবচেয়ে জোরে উচ্চারিত হচ্ছে—বায়ার লেভারকুসেন কোচ ও লিভারপুল কিংবদন্তি জাবি আলোনসো। কোচের দায়িত্ব নিয়ে লেভারকুসেনকে বদলে দিয়েছেন এই স্প্যানিয়ার্ড। চলতি মৌসুমে তাঁর অধীন শীর্ষে থাকা লেভারকুসেন এখনো পর্যন্ত হারেনি। ২৭ ম্যাচে হার না মানা দলটি মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষে পাঁচ লিগে একমাত্র অপরাজিত দলও। শুধু ফল দিয়েই মাঠের কৌশলেও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন আলোনসো। এই মুহূর্তে সমর্থকেরাও আলোনসোকে লিভারপুলের জন্য উপযুক্ত কোচ মনে করছেন। বিষয়টি নিয়ে কথাও বলেছেন জাবি নিজেও, ‘ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না। তবে এই মুহূর্তে আমি এখানে খুশি। এখনো উজ্জীবিত। ক্লাব এবং দল নিয়ে আমি আনন্দিত।’
অন্যদের মধ্যে ব্রাইটন কোচ রবার্তো ডি জেরবি, জিরোনার মিশেল, ইন্টার মিলানের সিমোন ইনজাগি, অ্যাস্টন ভিলার উনাই এমেরি, জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক কোচ ইউলিয়ান নাগলসমান এবং লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ডও বেশ ভালোভাবে আলোচনায় আছেন। যদিও ক্লপের উত্তরসূরি হয়ে লিভারপুলের ডাগআউটে শেষ পর্যন্ত কে দাঁড়াবেন, তা জানতে অপেক্ষা করতেই হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, লিভারপুলকে বিদায় জানিয়ে এখন কোথায় যাবেন ক্লপ? যেখানেই যান, প্রিমিয়ার লিগের কোনো ক্লাবে যে যাবেন না, তা নিজেই নিশ্চিত করেছেন। অন্তত এক বছর কোনো ক্লাব বা জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন না করার কথাও তিনি জানিয়েছেন। তবে এরই মধ্যে তাঁর সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা, দুই ক্লাবের নাম একসঙ্গে সামনে এসেছে। অন্য দলগুলোর মধ্যে বায়ার্ন মিউনিখ, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড এবং জার্মানি জাতীয় দলের কথাও শোনা যাচ্ছে। যদিও সেসব দূরের বাতিঘর। ক্লপের সামনে এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চলতি মৌসুমে লিভারপুলকে শিরোপা জিতিয়ে দায়িত্বের ইতি টানা। বাকি সব ভুলে ক্লপ নিজেও হয়তো এখন শেষটা রাঙানোয় সেরাটা ঢেলে দেবেন।