চ্যাম্পিয়ন হয়েই চলেছে কিংস, অন্যরা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে
কখনো ১০, কখনো ১১ বা ১২ দলের প্রতিযোগিতা। সবাই চ্যাম্পিয়ন হবে না। তবে অন্তত তিন-চারটি দল চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে সেটা যেন মানা। চ্যাম্পিয়নের দাবি নিয়ে মাঠে নামবে শুধুই বসুন্ধরা কিংস এবং দাবি পূরণ করেই লিগ শেষ করবে। এটাই যেন লিগের নিয়তি এখন। ২০১৯ সালে পেশাদার ফুটবলে আসার পর করোনায় একটা লিগ পরিত্যক্ত হওয়া ছাড়া বাকি পাঁচটিতেই চ্যাম্পিয়ন কিংস। সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন গত পরশু ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামে মোহামেডানকে হারিয়ে।
স্বাধীনতা-উত্তর ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান দুই দলই হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিগে। সত্তর, আশি, নব্বই দশক পর্যন্ত এই দুই দলের খেলার টিকিট কাটতে লম্বা লাইন পড়ত। লিগ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে তখন দল দুটির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ঝড় তুলত সারা দেশে। লিগের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত জ্বলত উত্তেজনার আগুন।
সময় পাল্টেছে। কয়েক মৌসুম থেকে লিগে আর উত্তেজনার বারুদ জ্বলে না। লিগ হয়ে গেছে একপেশে। ৫-৭টা ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পরই লিগটা হেলে যায় কিংসের দিকে। শেষ পর্যন্ত লাল জার্সিরা লিগ জেতে ৩-৪ ম্যাচ হাতে রেখেই। গত বছর বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র দল হিসেবে টানা চতুর্থ লিগ জিতেছে কিংস। সেটি ছাপিয়ে এবার টানা পাঁচবার লিগ জয়ের নতুন রেকর্ড! বিশ্বের যেকোনো লিগই টানা পাঁচবার জেতা মোটেও সহজ নয়।
কিংসের এই সাফল্যের রহস্য এখন প্রায় সবারই জানা। করপোরেট ঘরানায় দল পরিচালনা, পেশাদারি আদলে সবকিছু দেখা, টাকার দিকে না তাকিয়ে দেশসেরা ফুটবলারদের নেওয়া, খেলাতে পারবে না জেনেও বড় অঙ্ক খরচ করে ফুটবলার নিয়ে বেঞ্চ শক্তিশালী করাই কিংসকে অজেয় অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ঘন ঘন কোচিং স্টাফ বদল না করারও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। অস্কার ব্রুজোন এবং তাঁর কোচিং স্টাফ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। ফুটবলারদের কাছ থেকে পারফরম্যান্স আদায় করার ফর্মুলা তাঁদের জানা। ভালো মানের বিদেশি আনায়ও কিংস টেক্বা দিয়েছে অন্যদের।
একটা চ্যাম্পিয়ন দল হওয়ার পূর্বশর্ত এসবই। কিংসের নিজস্ব মাঠও আছে। সেটি ঘটা করে বলার কারণ, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্লাবেই তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা কিংসের ইচ্ছাশক্তি। চ্যাম্পিয়ন হতে চাইতে হবে, তা যত টাকাই লাগুক। সেরা দল গড়ার মানসিকতা হাল আমলে একমাত্র কিংসের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সেটাই দলটাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শিখরে। ২০১৯ থেকে টানা ৫টি লিগসহ ১০টি ট্রফি উঠেছে কিংসের শো-কেসে। ভাবা যায়!
তবে কোটি কোটি টাকায় দল গড়লেই যে সব সময় সাফল্য পাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তা নেই। এখানেই ব্যবস্থাপনা-তত্ত্ব চলে আসছে। কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসানও সেটাকেই সাফল্যের বড় কারণ বলছেন, ‘শিরোপা জেতার জন্য ভালো দল গড়াই যথেষ্ট নয়। খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলাও গুরুত্বপূর্ণ। আর এ ব্যাপারে আমরা খুব কঠোর। এটাই খেলোয়াড়দের ভালো কিছু করতে শারীরিক ও মানসিকভাবে সহায়তা করে।’
কিংস-জমানার আগে ২০০৭ সালে শুরু হওয়া পেশাদার ফুটবলে প্রথম তিনবারসহ ছয়বার চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। তিনবার শেখ জামাল ধানমন্ডি, একবার শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জামাল আর রাসেলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নটা উবে গেছে। বড় বাজেটের দল গড়লেও ব্যবস্থাপনার গলদে কোথায় যেন আটকে গেছে এ দুটি দল। আর আলোচনাতেই নেই। এবার তো লিগে দুটি দলের অবস্থা শোচনীয়। কিংসের যেখানে ১৫ ম্যাচে ৪০ পয়েন্ট, শেখ জামালের ১৬ আর শেখ রাসেলের মাত্র ১৫!
‘শিরোপা জেতার জন্য ভালো দল গড়াই যথেষ্ট নয়। খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলাও গুরুত্বপূর্ণ। আর এ ব্যাপারে আমরা খুব কঠোর। এটাই খেলোয়াড়দের ভালো কিছু করতে শারীরিক ও মানসিকভাবে সহায়তা করে।’
কিংসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আশা ছিল আবাহনীকে নিয়ে। কিন্তু পারল না। বরং দিন দিন কিংসের কাছে খাবি খাচ্ছে আকাশি নীলেরা। অথচ কিংসের চেয়ে আবাহনীর টাকা কম, এটা বিশ্বাস করতে চাইবেন না অনেকেই। কিংস যদি বছরে দলের পেছনে ৫০ কোটি টাকা খরচ করে, আবাহনীও চাইলে এর কাছাকাছি অঙ্ক খরচ করার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু আবাহনী দল গঠনেই পিছিয়ে পড়ছে। সেরাদের নিয়ে কিংস দল নিশ্চিত করার পর আবাহনী একটা দল গড়ে। যেটিকে বড়জোর আপনি দ্বিতীয় সেরা বলতে পারেন। বিদেশি খেলোয়াড় আনাতেও আবাহনী দিতে পারছে না কোনো চমক। শক্তিশালী নয় তাদের কোচিং স্টাফও। ফলে কিংসকে সামান্য আঁচড় কাটাও সম্ভব হচ্ছে না এই আবাহনীর পক্ষে। তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই লিগে কিংসের চেয়ে আবাহনীর ১৪ পয়েন্ট পিছিয়ে পড়া এর প্রমাণ। অবিশ্বাস্য শোনাবে, আবাহনী-কিংসের ১৫ লড়াইয়ে কিংস জিতেছে ১১টি, বাকিগুলো ড্র।
কেউ কেউ বলেন, আবাহনীর উচিত কিংসকে ভেঙে দুর্বল করা। কিংস দুর্বল হলে তবেই হয়তো আবাহনীর সুযোগ আসবে। আবাহনীর সমর্থক গোষ্ঠীর এক নেতা কদিন আগে যেমন বলছিলেন, ‘ক্লাবের এক শীর্ষ নেতাকে বলেছি এখন থেকেই নতুন দল গড়েন। কিংস থেকে খেলোয়াড় বের করেন।’ তবে এই ‘মতবাদ’ সমর্থন না করে আবাহনীর সাবেক স্ট্রাইকার ও বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলছেন, ‘আবাহনীর উচিত নতুন খেলোয়াড় তৈরি করে নিজেদের ভিত্তি শক্ত করা।’
‘কিংসকে টানা ৫ম শিরোপার জন্য সাধুবাদ জানাই। তবে তাদের টানা চ্যাম্পিয়ন হওয়া ফুটবলের জন্য ইতিবাচক নয়। লিগ লড়াইটা শেষ ম্যাচ পর্যন্ত গেলে তবেই না ভালো। তাহলেই লিগটা জমে এবং লিগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু কিংস এততরফা খেলে কয়েক ম্যাচ আগেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় ফুটবলের জন্য এটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়।’
১৭ বছরের পেশাদার যুগে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায়নি মোহামেডান। আসলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দলও গড়তে গড়তে পারছে না সাদা-কালোরা। মোহামেডান সহসাই চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে লিগে, তেমন আলামতও নেই। তারপরও সাদা-কালোরা সম্প্রতি টানা তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে। কিংসের রাজত্বের এই সময়ে আবাহনীর ব্যর্থতায় মোহামেডান এবার লিগে আবাহনীকে তিনে ঠেলে রানার্সআপ হওয়ার লড়াইয়ে এগিয়ে আছে। এতেই সান্ত্বনা খুঁজতে পারেন কোনো কোনো সাদা-কালো সমর্থক।
‘আবাহনীর উচিত নতুন খেলোয়াড় তৈরি করে নিজেদের ভিত্তি শক্ত করা।’
সাদা-কালোর ফুটবল চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর কদিন আগে ক্লাবে এসে ফুটবলারদের উজ্জীবিত করেছেন। ফুটবলারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ওঠার জন্য। ভবিষ্যতে মোহামেডান লিগসেরা হতে লড়াই করবে, বলেছেন তিনি। ক্লাবটির ফুটবল সম্পাদক আবু হাসানের ভাষায়, ‘দেশে আসলে ভালো খেলোয়াড়ের অভাব। কিংসের রিজার্ভ বেঞ্চও জাতীয় দলের খেলোয়াড়ে ঠাসা। ফলে অন্যরা পারছে না।’
মোহামেডানের টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা সাদা-কালোর সাবেক তারকা ইমতিয়াজ সুলতান জনির কথা, ‘কিংসকে টানা ৫ম শিরোপার জন্য সাধুবাদ জানাই। তবে তাদের টানা চ্যাম্পিয়ন হওয়া ফুটবলের জন্য ইতিবাচক নয়। লিগ লড়াইটা শেষ ম্যাচ পর্যন্ত গেলে তবেই না ভালো। তাহলেই লিগটা জমে এবং লিগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু কিংস এততরফা খেলে কয়েক ম্যাচ আগেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় ফুটবলের জন্য এটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়।’
ইমতিয়াজ সুলতান যোগ করেন, ‘কিংস যে টাকা খরচ করে, তা অবিশ্বাস্য। তাদের বেঞ্চের খেলোয়াড়েরাও সবাই তারকা। তাদের নিয়েই ভালো একটা দল হয়ে যায়। খেলোয়াড় সংকটের এই সময়ে অন্যরা চাইলেও মনমতো দল গড়তে পারে না। এটাও মনে রাখা উচিত সবার।’
তবে যত যা-ই হোক, আবাহনী-মোহামেডানের যেকোনো মূল্যে আরও ভালো দল গড়া উচিত মনে করেন ইমতিয়াজ সুলতান। সেই সঙ্গে হতে হবে ভালো ব্যবস্থাপনা। তাহলেই যদি লিগটা একটু জমে!