‘তোমাকে কখনো ছেড়ে দেব না’—নিউক্যাসল কোচকে শিয়ারারের খোলাচিঠি
লেস্টার সিটির সঙ্গে কাল গোলশূন্য ড্র করে চ্যাম্পিয়নস লিগের আগামী মৌসুমে জায়গা নিশ্চিত করেছে নিউক্যাসল ইউনাইটেড। লিগ টেবিলের শীর্ষ চারে থেকে মৌসুম শেষ করা নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই দশক পর ইউরোপ–সেরার প্রতিযোগিতায় ফিরল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটি। সর্বশেষ ২০০২–০৩ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছে নিউক্যাসল। তখন ক্লাবটির অধিনায়ক ছিলেন প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা অ্যালান শিয়ারার।
ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ জেতার পর ১৯৯৬ সালে যোগ দেন নিজের শহরের ক্লাব নিউক্যাসলে। ইংল্যান্ডের প্রথম ‘মাল্টি–মিলিয়ন’ দামের স্ট্রাইকারের খেতাব পাওয়া শিয়ারারকে কিনতে তখন দেড় কোটি পাউন্ড খরচ করে রেকর্ড গড়েছিল নিউক্যাসল। দুবার এফএ কাপের ফাইনাল খেললেও শিয়ারার নিউক্যাসলের হয়ে শিরোপা জিততে পারেননি। তবে নিউক্যাসলের হয়ে তাঁর সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। সেই শিয়ারার নিউক্যাসলের চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেরার আনন্দের ক্ষণে খোলাচিঠি লিখেছেন ক্লাবটির কোচ এডি হাউয়ের প্রতি।
দ্য অ্যাথলেটিকে প্রকাশিত সেই চিঠি বাংলায় সংক্ষেপিত আকারে তুলে ধরা হলো—
প্রিয় এডি,
তোমাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ শীর্ষ চারের জন্য, চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য, এই মৌসুমে স্বরূপ সন্ধান করে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার জন্য এবং জয়ের আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য। সেন্ট জেমস পার্কে উত্তুঙ্গ আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্যও ধন্যবাদ। মে মাসে কী ঘটে, কী ঘটে—অনুভূতির উদ্রেক ঘটানোর জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ এডি। এই অনুভূতি পরিচিত—আর তার কারণ হলো, এবার আর আমরা শিকার নই, শিকারি।
তোমাকে ধন্যবাদ এই হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য।
নিউক্যাসলকে এভাবে গড়ে তোলার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ এডি। এই দল মনের মধ্যে ক্রোধ ও তাড়না নিয়ে খেলে। ফুসফুস ফেটে না যাওয়া পর্যন্ত এবং পা দুটো অবসন্ন না হওয়া পর্যন্ত দৌড়ায়। তবুও কি থামে? যতক্ষণ না পর্যন্ত দৌড়ানোর আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণই দৌড়ায়। এই রাজকীয় উন্মত্ততার জন্যও ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ, শহরের সড়কগুলোয় আমাদের কোলাহল ফিরিয়ে আনার জন্য। লোকের মুখে হাসি ফুটেছে, রেঁস্তোরাগুলোয় ভিড়, পানশালা জমজমাট—সবাই ক্লাবের সঙ্গে হারানো বন্ধন ফিরে পেয়েছে, যা একসময় অবিভাজ্য ছিল।
বছরের পর বছর ধরে আমরা হয় অন্যকে (অন্য দল) সাহায্য করেছি, নয় আমাদের কেউ পাত্তা দেয়নি। লোকে প্রশংসা করতে ভুলে গিয়েছিল। কেন এমন হচ্ছে? কেউ কেউ বলেছে, আমরা প্রত্যাশা করেছি বেশি, চাহিদা বেশি ছিল। কিন্তু এসব বিষয়কে যে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই, তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আমাদের ব্যক্তিত্ব ফিরিয়ে আনার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ। ক্লাব ও জায়গা হিসেবে আমরা প্রায় অর্ধেক বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি কেভিন কিগ্যান কিংবা স্যার ববি রবসন নও, অমন ডাকাবুকো কিছুও নেই তোমার মধ্যে, কিন্তু তুমি নিখাদ। সেপ্টেম্বরে তোমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বলেছিলে, ‘আমি এখানে (নিউক্যাসল) টিকে থাকতে আসিনি।’ কথাটা আমার মুখে বজ্রমুষ্টির মতো আঘাত করেছিল। অঞ্চল হিসেবে পরিচয়ের দিক থেকে আমরা একটু কোণঠাসা, সবাই এড়িয়ে যায়—হয় এটা মেনে নিতে হবে কিংবা পাল্টা লড়াই করতে হবে। লড়াইয়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ এডি।
ধন্যবাদ, এখানে এসে আমাদের তুলে ধরার জন্যও। আমাদের নিয়ে ভাবার জন্য ধন্যবাদ। কয়েক দশক ধরে ম্যাড়মেড়ে ধারাভাষ্য ছাড়া নিউক্যাসল কখনোই আত্মঘাতী ফুটবল খেলেনি, হলিউড তারকাদের মতো খ্যাতিসম্পন্ন কাউকে সই করায়নি, অবিশ্বাসী কাউকে আনেনি। খোলা মন আর ঔদার্যই নিউক্যাসলের মূল ভিত। আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখো, যেভাবে আমরা তোমাকে রাখি এবং কখনো ছেড়ে দেব না।
তুমি বোর্নমাউথের মানুষ। এখন তুমি নিউক্যাসলেরও। আমাদের একজন হয়ে ওঠার জন্য তোমায় ধন্যবাদ।
আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য এবং অন্য দলগুলোকে আমাদের নিয়ে কাঁপুনি তোলার জন্যও ধন্যবাদ। খেলার জন্য গোটা দেশ ঘুরেছি আমরা, আগে আশা নিয়ে যেতাম (প্রতিপক্ষের মাঠে) এখন বিশ্বাস নিয়ে যাই। আমরা জানি, খেলোয়াড়েরা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দেবে।
এই দারুণ দলটাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ। এই যে এখন তোমাকে লিখছি, অন্যদের প্রতিক্রিয়া কেমন, সেটাও দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি—‘শান্ত হও, তোমরা এখনো কিছু জেতনি।’ কিন্তু এসব লোক জানে না, উদ্যাপনের জন্য আমাদের তেমন কিছু ছিল না। খেলোয়াড়েরা এই প্রতিবন্ধকতা দূর করেছে—লোকে তার প্রশংসা করতে জানে না।
খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকে চলে যাবে, সে শূন্যতাও পূরণ হবে। কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ এই ‘ক্লাস অব ২০২২–২৩’ গড়ে তোলার জন্য। এই স্মৃতি থাকবে। খেলোয়াড়েরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিউক্যাসলকে অভিজাতদের কাতারে তুলে এনেছে।
তোমার প্রশংসা সহজেই করা যায়। কেউ কেউ বলতে পারে, তুমি সৌভাগ্যবান। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, ক্লাব একদম তলানিতে থাকতে তুমি দায়িত্ব নিয়েছিলে, প্রিমিয়ার লিগ টেবিলে একদম নিচে ছিল। বুঝেশুনে খরচ করে তুমি ভারসাম্য ফিরিয়েছ ক্লাবে। বুদ্ধিমানের খরচ করে ভিত শক্ত করার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ।
আরও ধন্যবাদ। কারণ, অল্পতেই তুষ্ট হওয়ার পথে তুমি হাঁটনি। ব্রুনো গিমারেজ, আলেক্সান্দার আইজ্যাক, সভেন বোটম্যানদের মতো খেলোয়াড়দের উপহার দেওয়ার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ। তারা হয়তো নিউক্যাসলের ঘরের ছেলে হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ক্লাবের সঙ্গে একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে। ড্যান ব্রানকে (নিউক্যাসলের বয়সভিত্তিক দলে বেড়ে ওঠা) ফিরিয়ে আনার জন্যও ধন্যবাদ। তাকে নিউক্যাসলের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছ, যেটা তার শৈশবের স্বপ্ন। ছোট থাকতে সে চ্যাম্পিয়নস লিগ দেখেছে, এখন সেখানে সে নিজের প্রিয় ক্লাবকে নিয়ে যেতে পেরেছে।
কিয়েরন ট্রিপিয়েরের জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ। সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, নেতৃত্বেও অসাধারণ। লা লিগা জিতেছে। সে বুঝেছে, অবনমন অঞ্চলে আমাদের এই অচলায়তনের পরও পথ আছে। তাকে সই করানোটা ছিল সেই পথে বের করার বার্তা। তাই তোমাকে ধন্যবাদ, আমাদের ইতিহাসটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অনুশীলন মাঠে আমাকে নিমন্ত্রণের জন্যও ধন্যবাদ, যখন আমি ছেলেদের বলেছিলাম, আমরা এরই মধ্যে তোমাদের নিয়ে গর্বিত। একটু বয়সী খেলোয়াড়দেরও এই বার্তাটা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। একটি অভঙ্গুর বন্ধনের অংশ আমরা—এ অনুভূতি তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ, যেখানে আছে সেই ঘাস, সেই স্টেডিয়াম, ক্লাব আর মনের ভেতরকার তাড়না—
আজ আমরা সবাই একত্রিত, যূথবদ্ধ।
এই শুরুটা এনে দেওয়ার জন্যও তোমাকে ধন্যবাদ।
একবার এক সাক্ষাৎকারে তুমি বলেছিলে ‘আমি আগামীকালকে ভয় পাই।’ কিন্তু আমি যদি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই এডি, স্রেফ একটা কথা—সেটা হলো, আগামীকাল গোল্লায় যাক। শুধু এখন একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখো, কী আনন্দের উপলক্ষ তুমি এনে দিয়েছ, সেটা উপভোগ করো।
ঘরকে ঘর মনে করার অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ এডি।
শুভেচ্ছান্তে,
অ্যালান।