বেলিংহামের পথেই আসছেন আরেক বেলিংহাম

জুড বেলিংহামের ভাই জোব বেলিংহামইনস্টাগ্রাম

চেহারায় এতই মিল, হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে জুড বেলিংহাম! দুজনে একই পজিশনে খেলায় এই ভুল হওয়া অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ভুলটা হতে দিতে চান না জোব বেলিংহাম। কি ভাবছেন, জুডের জায়গায় ভুল করে জোব লেখা হয়েছে! আসলে তা নয়। ভুল তো একেবারেই নয়। যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি জোব-ই। চেহারা কিংবা নামের মিলের কথা শোনা অনেকে নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন, তিনি জুডের কাছের কেউ-ই হবেন। হ্যাঁ সেটাই, জুড বেলিংহামেরই ভাই জোব বেলিংহাম। জোব ভাইয়ের পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়তে চান না, বরং ফুটবল মঞ্চে নিজের পরিচয়টাকেই আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করতে চান স্যান্ডারল্যান্ডের ১৮ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ড।

এই গ্রীষ্মে দলবদলে বার্মিংহাম সিটি থেকে ১৯ লাখ ডলারে স্যান্ডারল্যান্ডে আসেন জোব। এসেই তিনি ক্লাবকে জানান নামের পাশে ৭ নম্বর জার্সিটি তাঁর চাই। এই দাবির মধ্য দিয়ে ফুটবলে নিজের পথে হাঁটার ঘোষণাটাও যেন দিয়ে দিয়েছিলেন জোব।
এটাও সত্যি যে জোবের বড় জুড এখন সময়ের অন্যতম সেরা তারকাদের একজন।

আরও পড়ুন

ব্যালন ডি’অরে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার এখন জুডের দখলে। শুধু এটুকুই নয়, বল পায়ে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অবিশ্বাস্য ছন্দে আছেন জুড। ভেঙে দিচ্ছেন একাধিক রেকর্ডও। তাঁকে নিয়েই প্রায়ই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দর্শকেরা ‘হেই জুড’ বলে গান ধরেন। এমন কারও প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু জোব সেই কঠিন কাজটাই করতে চান।

জোবের সামনে শুধু তাঁর ভাই নয়, বাবাও আছেন। ২০ বছরের বেশি সময়ে নন-লিগে জুড ও জোবের বাবা মার্ক বেলিংহামেরও আছে সাত শর বেশি গোল। খোদ পূর্বসূরিরা যখন চলার পথে সাফল্যের এমন কাঁটা বিছিয়ে রাখেন, তখন তা পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন তো বটেই।

দুই ভাই জুড বেলিংহাম ও জোব বেলিংহাম
ইনস্টাগ্রাম

জোব ও জুড দুজনই নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন বার্মিংহাম সিটির একাডেমি থেকে। যেখান থেকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড হয়ে জুডের ঠিকানা হয়েছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। অন্যদিকে জোব পাড়ি জমিয়েছেন চ্যাম্পিয়নসশিপের (ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্তরের লিগ) দল স্যান্ডারল্যান্ড। কে জানে, হয়তো কঠিন পথে চলবেন বলে দ্বিতীয় বিভাগের দলকে বেছে নেওয়া

বেলিংহাম ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে বড় জনের চেয়ে ছোট জনের বিকাশ একটু ধীরগতিতেই হয়েছে। জোবকে নিয়ে তাই আলোচনা ও আলোড়নও ছিল কম। কিন্তু বড় ভাইয়ের ওপর পড়া আলোর ঝলকানি চোখধাঁধিয়ে দেয়নি ছোটজনকে। আবেগ বা হতাশায় নিজেকে ভাসিয়েও দেননি। চেষ্টা করেছেন নিজেকে বদলাতে এবং নিজের উন্নতি ঘটাতে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এফএ কাপে প্লেমাউথের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বেঞ্চ থেকে অভিষেক হয় তাঁর।

আরও পড়ুন

নিজের ভাইয়ের পর তিনিই হন ক্লাবের সর্বকনিষ্ঠ অভিষিক্ত খেলোয়াড়। তাঁর পারফর‍ম্যান্স দেখে তখনকার কোচ লি বাওয়ের বলেছিলেন, ‘আমি তাকে বলেছি “তুমি অনেক ভালো করেছ। তোমার বয়স ১৬, যে কিনা বলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পা থেকে বলও হারায় না এবং সঠিক কাজগুলো করার চেষ্টা করে।”’ তবে শৈশবের ক্লাবে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারেননি জোব। ২৬ ম্যাচ খেলে কোনো গোল বা অ্যাসিস্ট করতে পারেননি।

এরপর জোবের ওপর চোখ পড়ে স্যান্ডারল্যান্ডের। তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাব বদলে স্যান্ডারল্যান্ডে এসে পায়ের নিচে মাটি শক্ত করার চেষ্টা করেন জোব।। জোবকে যখন নিজের পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে ভাইকে মনে করানোর চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছিল তখনো, কিন্তু তাঁর বয়স আঠারো হয়নি। স্যান্ডারল্যান্ডে এসে ইপসউইচের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় জোবের। তাঁকে দিয়ে মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে নতুন গতি আনতে চেয়েছিল ক্লাবটি। যদিও প্রথম ম্যাচে হার দিয়েই শুরু হয় নতুন পথচলা।

প্রেস্টনের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও পেতে হয়েছে হারের স্বাদ। কিন্তু এরপরও ক্লাব সমর্থকদের মধ্যে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে আশার সঞ্চার করেন জোব, যা বাস্তবতায় রূপ নেয় তৃতীয় ম্যাচে রোথেরামের বিপক্ষে। এই ম্যাচে আগে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে স্যান্ডারল্যান্ড। এরপরই দেখা যায় জোবের নৈপুণ্য। দুই গোল করে দলকে এনে দেন দারুণ এক স্বস্তির জয়। এই ম্যাচ দিয়েই মূলত নিজের আগমনী বার্তাটা দিয়ে রাখেন জোব। তাঁকে নিয়ে কদিন আগে ছাঁটাই হওয়া কোচ টনি মাউব্রে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, তার সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার শেখার আগ্রহ। তার বয়স ১৭, অথচ সে প্রতিদিন কোচকে প্রশ্ন করে।’

অভিষেকের পর থেকে স্যান্ডারল্যান্ডের হয়ে নিয়মিত একাদশে সুযোগ পেয়ে আসছেন জোব। যেখানে বেশির ভাগ সময় তাঁকে খেলানো হয়েছে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে। তবে তাঁকে চাইলে স্ট্রাইকার এবং অ্যাটাকিং মিডফিল্ডেও খেলানো যেতে পারে। যেকোনো পজিশনে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও জোবকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তবে জোবকে তাঁর স্বাভাবিক পজিশনে খেলানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ফুটবল বিশ্লেষক ড্যান হ্যারিসন, ‘চোট এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে জোবকে ড্যান নেইল বা পিয়েরে একওয়াহর সঙ্গে ডাবল পিভট হিসেবে খেলতে হয়েছে। আমার মনে হয় সে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের এ পজিশনে সে আসলে মাননসই নয়। এই পজিশনেই মূলত তাঁকে কম কার্যকর দেখা গিয়েছে।’

আরও পড়ুন

হ্যারিসন যতই বলুন, বাস্তবতা হচ্ছে, বিকশিত হওয়ার পর্যায়ে থাকা ফুটবলারকে কোচরা বিভিন্ন পজিশনে বাজিয়ে দেখবেন এবং তাঁকে বড় মঞ্চের জন্য নানাভাবে প্রস্তুত করবেন। তবে এর মধ্যে একটি ধাক্কাও খেয়েছেন জোব। স্যান্ডারল্যান্ড থেকে ছাঁটাই হয়েছেন কোচ মাউব্রে। এই কোচের অধীন ভালোভাবেই নিজেকে গড়ে তুলছিলেন জোব। কোচকে নিয়ে জোব বলেছিলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমাকে আরও পরিণত খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলেছেন।’

মাউব্রের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ মাইক ডোডের অধীন দারুণ খেলছেন জোব। অবশ্য এর আগেও ডোডের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে জোবের, যা হয়তো এখন কিছুটা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে তাঁকে। ডোডের অধীন সর্বশেষ ম্যাচে লিডসের বিপক্ষে দলকে জয় এনে দেওয়া গোলটিও এসেছে জোবের কাছ থেকে। তবে জোবের সময়টা এখন উড়ন্ত হলেও এটা কেবল শুরুই।
স্বাভাবিক প্রতিভার সঙ্গে কৌশল, শরীরী দক্ষতা এবং ম্যাচ পড়তে পারার ক্ষমতা মিলিয়ে জোবের মধ্যে আগামী দিনের বড় তারকার ছায়া দেখছেন অনেকে।

রিয়ালের হয়ে দারুণ ছন্দে জুড বেলিংহাম
টুইটার

কিন্তু পরের ধাপে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা তাঁর জন্য সহজ হবে না। যেখানে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা তাঁর গোল করা নিয়ে। এ মৌসুমে দলের প্রয়োজনে গোল করলেও স্বাভাবিক স্কোরারদের মতো গোলক্ষুধা জোবের মধ্যে এখনো দেখা যায়নি। আবার মাঝেমধ্যে অযথা ‘ওভার-প্লে’ করার অভ্যাসও তাঁর জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এমনকি রক্ষণেও তাঁকে অনেক কাজ করতে হবে। এসব ঠিক করা মোটেই কঠিন বা অসম্ভব কিছু নয়। উন্নতির মধ্য দিয়ে নিজেকে কীভাবে মেলে ধরতে হয়, তা ভালোই জানা আছে বেলিংহামদের কনিষ্ঠজনের।

তবে জোব যতই নিজেকে তাঁর ভাইয়ের চেয়ে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তুলনাটা তিনি কখনো এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এমনকি তিনি পরবর্তী জুড বেলিংহাম কি না, সে প্রশ্নও বারবার সামনে আসবে। বড় মঞ্চে অনেক সময় এমন তুলনা বাড়তি চাপও নিয়ে আসে। বেলিংহাম সেই চাপ সামলাতে কীভাবে প্রস্তুতি নেবে, সেটাও দেখার বিষয় হবে।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, জোবের ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায়? সম্প্রতি ২০২৩ গোল্ডেন বয়ের পুরস্কার জেতা জুডের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পরবর্তী সময় এই পুরস্কার কে পেতে পারেন? জবাবে জুড যে তিনটি নাম বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে একজন ছিল জোব বেলিংহাম। তবে সে জন্য জোবকে আগে বড় মঞ্চে এবং বড় ক্লাবে গিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। স্যান্ডারল্যান্ড সমর্থকেরা অবশ্য চান জোব তাদের প্রিমিয়ার লিগে যাওয়ার হারানো পথের সন্ধান দেবেন।

কিন্তু বড় কোনো ক্লাব থেকে প্রস্তাব এলে সেটাকেই হয়তো লুফে নেবেন জোব। এর মধ্যে ভাইয়ের ক্লাব রিয়ালের সঙ্গে জড়িয়েও সামনে এসেছে জোবের নাম। এই গুঞ্জন যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়, তবে জোবের সহায়তায় জুডকে কিংবা জুডের সহায়তায় জোবকে গোল দেখা দারুণ কিছুই হবে। যদিও দুটি নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করতে গিয়ে ধারাভাষ্যকারদের হয়তো একটু বিপত্তিতেই পড়তে হবে বৈকি!