যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার বিলোপ, অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ, অস্কারজয়ী অভিনেতা ব্র্যাড পিট এবং সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিনের জন্ম—১৮ ডিসেম্বরে সব মিলিয়ে বড় ঘটনা বলতে এগুলোই। এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা অবশ্য আরও কিছু থাকতে পারে, তবে ১৮ ডিসেম্বরের বাকি সব ঘটনা ছাপিয়ে যাবে, যদি লিওনেল মেসি শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেন।
আর কেউ না হোক, বিশ্বব্যাপী কোটি আর্জেন্টাইন ভক্ত এই দিনটিকে স্মৃতির মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখবেন আমৃত্যু। ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসানের সঙ্গে মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখার তৃষ্ণাও যে মিটবে।
কাতার বিশ্বকাপ যতই সামনে এগোচ্ছে, পৃথিবীর একটি জনগোষ্ঠীর আবেগ, উৎকণ্ঠা ও রোমাঞ্চও সমানতালে বাড়ছে। মেসির হাতে শিরোপা দেখতে তাঁদের তর যেন সইছে না। সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ বলে যে কথা! পুরো দলটিই খেলবে মেসির জন্য। শক্তি, সামর্থ্য কিংবা পরিসংখ্যানও কথা বলছে আর্জেন্টিনার পক্ষে।
টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকা, ২০১৯ সালের ৩ জুলাইয়ের পর আর কোনো ম্যাচ না হারা তো তেমন কিছুই বলছে। লিওনেল স্কালোনির এই দল যে এবার আক্ষরিক অর্থেই ফেবারিটের তকমা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে। সম্ভবত গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা নিয়েই যাবে ‘আলবিসেলেস্তা’রা।
কেন এই আর্জেন্টিনার দল এতটা অপ্রতিরোধ্য? কীভাবে টানা ৩৫ ম্যাচ জেতার রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা তারা তৈরি করল? বিশ্বকাপে স্কালোনির কৌশলটাই কেমন হতে পারে, সেটাই মূলত খতিয়ে দেখা হবে এ আলোচনায়।
আক্রমণে মেসিদের কৌশল
কাগজে–কলমে ৪-৩-৩ ফরমেশনেই মূলত খেলে থাকে আর্জেন্টিনা, তবে কোচ লিওনেল স্কালোনির কৌশল কখনো নির্দিষ্ট একটি কাঠামোতে আটকে থাকে না। কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে খেলার সম্ভাবনা রেখেই মাঠে তাঁর দল।
আর্জেন্টিনা দলে আনহেল দি মারিয়া ছাড়া সত্যিকারের উইঙ্গারের অভাব আছে। এর বিপরীতে দলটিতে আছে বৈচিত্র্যময় ও গতিময় মিডফিল্ড। ফলে আর্জেন্টিনাও ২০১০ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনের মতো নিজেদের এই মিডফিল্ডের গভীরতার সুবিধা পুরোপুরিভাবে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
তবে এখানেই আর্জেন্টিনার বড় ধাক্কা হতে পারে জিওভানি লো সেলসোর অনুপস্থিতি। মিডফিল্ডে লিয়ান্দ্রো পারেদেস, রদ্রিগো ডি পল, লো সেলসো–ত্রয়ী সম্প্রতি অপরাজেয় আর্জেন্টিনার গতিময়তার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তবে লো সেলসো না থাকায় এখন তাঁর বিকল্প ভাবতে হচ্ছে স্কালোনিকে।
তাঁদের সামনে লিওনেল মেসি ও পাপু গোমেজের ভূমিকা অনেকটা ‘ফলস উইঙ্গার’-এর মতো। যাঁরা ক্রমাগত প্রতিপক্ষ রক্ষণে চাপ তৈরি করে আক্রমণের ঝড় বইয়ে দিতে চাইবেন। আর লাওতারো মার্তিনেজের কাজটা খুবই স্পষ্ট, গোল করার অপেক্ষায় থাকা। তবে দলের প্রয়োজনে অ্যাসিস্টও করতে পারেন এই ইন্টার মিলান তারকা।
খেলোয়াড়দের বয়স এবং তারুণ্যের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেল বাড়তি সুবিধা দেবে আর্জেন্টিনাকে। মেসি, ওতামেন্দি, দি মারিয়ার সঙ্গে যেখানে আছেন এনজো ফার্নান্দেজ, হুলিয়ান আলভারেজের মতো তরুণেরাও। সব মিলিয়ে কাগজে–কলমে বয়স, গভীরতা এবং মান বিবেচনায় নিলে আর্জেন্টিনা গত কয়েক দশকে তর্কযোগ্যভাবেই সেরা দল নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে।
তবে দলটিকে যা আলাদা করে, তা হলো তাদের স্টাইল। স্বতন্ত্র দর্শন দ্বারা পরিচালিত স্কালোনির কৌশল যথেষ্ট আকর্ষণীয়ও বটে। বলা যায়, স্কালোনির হাতে এবার রীতিমতো জাদুর কাঠি আছে। তাদের এই কৌশল মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—আচরণগত ও কাঠামোগত। যদিও এসব কৌশলকে আলাদাভাবে পরীক্ষা করার সুযোগ আছে, তবে আর্জেন্টিনা দলে এগুলোকে কখনো পৃথক বলে ভাবার সুযোগ নেই।
বলা যায়, হাতে হাত ধরে আর্জেন্টিনা মাঠে আধিপত্য বিস্তার করে এবং পজেশনভিত্তিক (বল দখল) খেলার স্টাইলে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বকাপের অন্য দলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আর্জেন্টিনার বল দখলের হার ৮৪.৮ শতাংশ বেশি। তাদের এই আধিপত্য ফুটে ওঠে ম্যাচের ফলেও।
ম্যাচপ্রতি গোল বিবেচনা করলে এটি দাঁড়ায় ৮১.৮ শতাংশে। তাদের লক্ষ্যে শট রাখার হারও দেখার মতো, সেটি ৯০.৯ শতাংশ। এ ছাড়া আরেকটি পরিসংখ্যান আর্জেন্টিনার খেলার কৌশলকে তুলে ধরতে পারে। সেটি হচ্ছে আর্জেন্টিনার লম্বা পাস খেলার সক্ষমতা, যা অন্যগুলোর তুলনায় মাত্র ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই কৌশল তারা পারতপক্ষে ব্যবহার করে না বললেই চলে।
বল দখলের ক্ষেত্রে স্কালোনির দল দারুণ ধৈর্য দেখাতে পারে। আর এই বিল্ডআপ মূলত নিচ থেকেই শুরু হয়। যেখানে নিজেদের পায়ে বল রেখেই মূলত তারা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। সঙ্গে মেসিদের বৈচিত্র্যময় ও সৃষ্টিশীল ফুটবলের যোগ তো রয়েছেই।
যদিও এভাবে আধিপত্য বিস্তারের অনেকগুলো উপায় আছে। তবে আর্জেন্টিনা এটি করে বেশ স্বতন্ত্র উপায়ে। দলের মিডফিল্ড গভীরতার কারণে খেলোয়াড়দের পরিচালনার ক্ষেত্রে স্কালোনির বিশেষ সুবিধা নেওয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। খেলার সময় মাঠে মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগ অবশ্য আগে থেকে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে চলে না।
শুধু আর্জেন্টিনার ডিফেন্সই মাঠে নিয়ম মেনে খেলে, যা সামনে থাকা খেলোয়াড়দের নিজেদের মতো করে স্বাধীনতা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। চার ডিফেন্ডারকে নিজেদের জায়গায় সমুন্নত রেখেই আর্জেন্টিনার তারকাঠাসা মিডফিল্ড খেলা তৈরি করে। পাশাপাশি বল যেখানে যাবে, সেখানে খেলোয়াড় বাড়িয়েও আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করে। আর এটি করতে খেলোয়াড়ের ধারাবাহিকভাবে বলের দখল নিজেদের কাছে রাখার ব্যাপারে সহায়তা করতে হয় এবং বল যাঁর কাছে থাকে, তাঁকে ঘিরে একটি পাসিং লাইন তৈরি করতে হয়।
এ জন্য অনেক সময় আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডকে নিচে নেমে আক্রমণের ধারা তৈরি করতে দেখা যায়। যেখানে সেন্টারব্যাকসহ অন্যদেরও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়।
একই নিয়ম মেনে চলতে হয় ফাইনাল থার্ডেও। তবে চাইলেই তো আর এভাবে ফুটবল খেলা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় গতিময়তা, ব্যক্তিগত শৈলী এবং দুর্দান্ত সমন্বয়ের। সেটি যে আছে, ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পরিসংখ্যানই মনে হয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আর এই কৌশলে মেসিও আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে পারেন।
একসময় আর্জেন্টিনা দলে মেসিকে ঘিরে খেলাটা তৈরি করতে তাঁর সতীর্থরা ব্যর্থ হতেন। ফলে নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে মেসিকেই জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব করতে হতো। অর্থাৎ তাঁকে যেমন গোল করার দায়িত্ব পালন করতে হতো, তেমনি নিচে নেমে খেলা তৈরিও করতে হতো। বর্তমান দলটি মেসির কাঁধ থেকে এত সব বোঝা নামিয়ে দিয়েছে। ফলে মেসিও অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে পারছেন।
স্বপ্ন দেখাচ্ছে রক্ষণও
যদি পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেন, তবে আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের সংখ্যাগুলো আপনার কাছে দুর্বল মনে হতে পারে। যেমন একটি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ৯০ মিনিটে আর্জেন্টাইন রক্ষণের বল দখলে রাখার হার গড়ে ৫৯.২১ শতাংশ। প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি বলের দখল রেখে খেলাটাই আর্জেন্টাইন রক্ষণকে সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে পিছিয়ে দিয়েছে এবং সেটা যৌক্তিকও। তবে এরিয়াল ডুয়েল কিংবা ডিফেন্সিভ ডুয়েলকে হিসাবে নিলে আর্জেন্টাইন রক্ষণের অবস্থা বেশ ভালো বলতে হয়।
যেহেতু বল দখলে আর্জেন্টিনা দাপট দেখাচ্ছে, সে কারণে আর্জেন্টিনার রক্ষণকে খুব বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে না। আর গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে ডিফেন্ডাররাও ঠিকই নৈপুণ্য দেখাতে পারছেন। বিশেষ করে ম্যান মার্কিংয়ের সময় আঠার মতো লেগে থেকে আগ্রাসী প্রেসে রীতিমতো প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডাররা। আর বল কেড়ে নেওয়ার পর যে প্রতি–আক্রমণগুলো তৈরি হয়, তা প্রতিপক্ষকে অনেক সময় হরর সিনেমার স্বাদ দিয়ে যায়।
যে কারণে বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনা ১৭ ম্যাচে মাত্র ৮ গোল হজম করেছে। আর্জেন্টিনা দলটি মূলত এখন অর্কেস্ট্রা দলের মতো। যাদের শুরুটা হয় রক্ষণ থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে গোলরক্ষক থেকে।
শেষ কথা
সব তো ভালো ভালো কথা বলা হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, আর্জেন্টিনার কি তবে কোনো দুর্বলতা নেই? বলা হয়, যখন মনে হয় কোনো দুর্বলতা নেই, তখনই আসল দুর্বলতাটা ওত পেতে থাকে। আর্জেন্টিনা দলের ভয়ও এখানে লো সেলসোর না থাকা কিংবা দি মারিয়া-দিবালার চোট বড় মঞ্চে অস্থিরতার ভেতর ঠেলে দিতে পারে দলটিকে।
বিশেষ করে লো সেলসো না থাকায় স্কালোনিকে পরিকল্পনা সাজানোর সময় দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে। আর বড় মঞ্চে অতিরিক্ত চাপে ভেঙে পড়া কিংবা হাল ছেড়ে মেসির দিকে তাকিয়ে থাকা আর্জেন্টিনার সাজানো সংসারকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। তেমন কিছু না হওয়ার প্রার্থনা নিয়েই অবশ্য খেলা দেখতে বসবেন বিশ্বব্যাপী কোটি আর্জেন্টিনা সমর্থক।