কেমন হলো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি
ফিরে যাওয়া যাক ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে। একই রাতে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে মাঠে নেমেছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তখন পর্যন্ত দুই দলই এগোচ্ছিল একই গতিতে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। কিন্তু কে জানত, সে রাতেই দুই দলের ফুটবল দুই বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করবে। আর্জেন্টিনা যেখান থেকে সাফল্যের এভারেস্টে চড়েছে, ব্রাজিলের ফুটবল দেখেছে পাতালের তলানি।
সে রাতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয় ব্রাজিল। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চূড়ান্ত সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু করে আর্জেন্টিনার। এমনকি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দিয়েও শেষ হয়নি বিপরীতমুখী এ যাত্রার ধারা। পরের সময়টাতেও বিশ্ব ফুটবল সাক্ষী হয়েছে আর্জেন্টিনার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের।
অন্যদিকে টালমাটাল অবস্থায় ব্রাজিলের ফুটবল প্রবেশ করে অন্ধকার এক টানেলে। সর্বশেষ কয়েক ম্যাচ দিয়ে অবশ্য সেই টানেল থেকে বেরিয়ে আলোর রেখাও দেখতে শুরু করেছে তারা। যদিও চূড়ান্ত সাফল্য এখনো দূরের বাতিঘরই। এর মধ্যে অবশ্য কোপা আমেরিকা সামনে রেখে আর্জেন্টিনা–ব্রাজিল দুই দলই ইতিবাচকভাবে শেষ করেছে প্রস্তুতি পর্ব। এখন মূল লড়াইয়ে দুই দলের জ্বলে ওঠার অপেক্ষা।
এবারের কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনার জন্য মূলত বৃত্তপূরণের গল্পের। ২০২১ সালের মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই দিয়েই নতুন দিনের পথে যাত্রা শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। রিও ডি জেনিরোর ফাইনালে সেবার ব্রাজিলকে ১–০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ‘আলবিসেলেস্তা’রা। সে ম্যাচের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিওনেল মেসি–দি মারিয়াদের। একের পর এক ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপের মঞ্চে আসেন তাঁরা। মাঝে অবশ্য ইউরোপ সেরা ইতালিকে হারিয়ে জিতে নেন ফিনালিসিমার ট্রফিও।
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরে শুরু করলেও, পরের ম্যাচগুলোতে ঘুরে দাঁড়ায় দারুণভাবে। ৩৬ বছর পর পুনরুদ্ধার করে বিশ্বকাপ শিরোপাও। বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে প্রীতি ম্যাচ এবং বিশ্বকাপ বাছাইয়েও আর্জেন্টিনা ছিল অনবদ্য এক দল। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঐতিহাসিক মারাকানায় গিয়ে ব্রাজিলকে হারিয়ে আসে তারা। পাশাপাশি বিশ্বকাপজয়ী তারকাদের সঙ্গে দলটিকে সমৃদ্ধ করেছে একঝাঁক তরুণ তুর্কিও। এ সময়ের মধ্যে একমাত্র হারটি তারা দেখেছে উরুগুয়ের বিপক্ষে। তবে আগে বা পরের পারফরম্যান্স খতিয়ে দেখলে, এই হার ছিল শুধুই ব্যক্তিক্রম একটি দৃষ্টান্ত। আলেহান্দ্রো গারনাচো–ভ্যালেন্টিন কার্বোনিরা এরই মধ্যে নিজেদের প্রমাণ করতে শুরু করেছেন। যখন যে সুযোগ পাচ্ছেন, প্রমাণ করছেন নিজেকে।
আর্জেন্টিনার জন্য যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ছিল, তা হলো সাফল্য ক্ষুধা ধরে রাখা। বিশ্বকাপ জয়কে অনেক সমর্থক চূড়ান্ত প্রাপ্তি ধরে নিলেও, আর্জেন্টিনা দলের মধ্যে কখনোই সেই মনোভাব দেখা যায়নি। প্রীতি ম্যাচ হোক কিংবা প্রতিযোগিতামূলক লড়াই, নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়েই খেলেছে তারা। সাফল্য তাই এখন পর্যন্ত ক্লান্তি হয়ে লিওনেল মেসিদের ঘাড়ে চেপে বসেনি। সেই ক্লান্ত হয়ে না পড়াই আর্জেন্টিনাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে আরেকটি কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতার আর দলের এই অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে আছেন মেসি।
২০২২ বিশ্বকাপ দিয়েই অনেকে মেসির শেষ ভেবে নিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলে মেসি হয়তো সে পথেই হাঁটতেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফির ছোঁয়া নতুন করে উজ্জ্বীবিত করেছে মেসিকে। এমনকি এবারের কোপা আমেরিকাকেও নিজের শেষ ভাবছেন না ৩৬ পেরোনো আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। মনে মনে হয়তো স্বপ্ন দেখছেন ২০২৬ বিশ্বকাপেরও। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে মেসির প্রথম ধাপ হতে পারে এবারের কোপা আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে সাফল্য নিশ্চিতভাবেই মেসিকে দুই বছরের পরের বিশ্বসেরা লড়াইয়ের জন্য চাঙা করে তুলবে মেসিকে।
মেসিকে সঙ্গে নিয়ে কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি ম্যাচের পর্বও শেষ করেছে আর্জেন্টিনা। ইকুয়েডরের বিপক্ষে আনহেল দি মারিয়ার একমাত্র গোলে জেতার পর আজ গুয়াতেমালাকে তারা হারিয়েছে ৪–১ গোলে। এ জয়ে জোড়া গোল করেছেন মেসি, সহায়তা করিয়েছেন অন্য এক গোলেও। কোপাতেও মেসিকে কেন্দ্র করেই নিজের পরিকল্পনা সাজাবেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। দলটির মূল একাদশ ও বেঞ্চ দুটোই বেশ সমৃদ্ধ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জমাট রক্ষণ নিয়ে খেলা দলের বিপক্ষে সংগ্রাম করতে দেখা গেছে আর্জেন্টিনাকে।
গুয়াতেমালার বিপক্ষে যেমন প্রথম ৩০ মিনিট বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গ ভাঙতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল দলটিকে। সেই সময়ের মধ্যে গোলও হজম করে তারা। তাই কঠিন সময়ে মাঠে নিজেদের ঐক্য ধরে রাখাই আর্জেন্টিনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি প্রার্থনা করতে হবে সাম্প্রতিক সময়ে চোটপ্রবণ হয়ে ওঠা মেসি যেন নতুন করে চোটে না পড়েন। কোপার মাঝপথে তেমন কিছু হলে মনোবল গুঁড়িয়ে যেতে পারে দলটির। তবে এ আশঙ্কাটুকু দূরে সরিয়ে রাখলে, মেসির হাতে কোপার আরেকটি ট্রফি ওঠা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবলে খায়, ঘুমায় এবং জীবনধারণ করে—বেশ আগে এমন একটা কথা বলেছিলেন ফুটবলসম্রাট পেলে। সেই ব্রাজিলই কি না সাম্প্রতিক সময়ে পায়ের নিচে একটু মাটির জন্য মাথা কুটে মরেছে। কোচ নিয়োগ নিয়ে টানাপোড়েন এবং দলের ভেতরকার সমন্বয়হীনতা কোণঠাসা করে দিয়েছিল পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর লম্বা সময় পর্যন্ত দলটি অপেক্ষা করে ছিল কার্লো আনচেলত্তির।
ইতালিয়ান এই কোচের রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে ব্রাজিলে আসা একপর্যায়ে সময়ের ব্যাপার বলেও মনে হচ্ছিল। বলা হয়েছিল, কোপার ঠিক আগমুহূর্তে ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নেবেন আনচেলত্তি। কিন্তু সেখানেও বড় ধাক্কা খান তাঁরা। ব্রাজিলে বোর্ডে চলমান বিতর্কের জেরে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রিয়ালেই থেকে যান আনচেলত্তি। ফলে ভারপ্রাপ্ত কোচ অধ্যায়ের ইতি ঘটিয়ে ব্রাজিলকে তাকাতে হয় পূর্ণাঙ্গ কোচের দিকে। যে ধারাবাহিকতায় তারা নিয়োগ দেয় দরিভাল জুনিয়রকে।
দরিভাল আসার আগের চিত্রটা অবশ্য ছিল ভয়াবহ। প্রীতি ম্যাচে মরক্কোর মতো দলের কাছে হারের পর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে টানা তিন ম্যাচে হারে ব্রাজিল, যা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তাদের নামিয়ে দিয়েছে ৬ নম্বরে। এখনো সেই অবস্থানেই আছে দলটি। ব্রাজিলের জন্য পরিস্থিত আরও খারাপ হয় দলের অন্যতম সেরা তারকা নেইমার চোটে পড়ে লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে গেলে। তাঁকে বাদ দিয়েই এখন কোপা আমেরিকায় খেলতে হচ্ছে দলটিকে।
এত সব খারাপ সংবাদের ভিড়ে ব্রাজিলের জন্য আশার বাতিঘর হয়ে আসেন দরিভাল। মাত্র চার ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়ানো দরিভালকে নিয়ে রায় দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। হয়তো কোপা আমেরিকা দিয়েই তাঁর সামর্থ্যের ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু এর মধ্যে কিছুটা হলেও দলকে উজ্জীবিত করতে পেরেছেন তিনি। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয়ে চেষ্টা করছেন দলটিকে এটি আকার দেওয়ার। তাঁর অধীনে খেলা চার ম্যাচে ব্রাজিল পুরোনো সময়ের কিছু ঝলকও দেখিয়েছে। ইংল্যান্ডকে তাদের মাটিতে হারানোর পর ঘুরে দাঁড়িয়ে ড্র করেছে স্পেনের বিপক্ষে।
একইভাবে ব্রাজিলের চিরয়াত ‘মেন্টালিটি মনস্টার’ (হার না মানার মানসিকতা) দেখা গেছে মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচেও। যেখানে তারা ২ গোলে এগিয়ে গিয়েও লিড হারায় এবং পরে ফের ম্যাচে ফিরে আসে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ১–১ গোলে ড্র দিয়ে শেষ করেছে কোপার প্রস্তুতি।
স্কালোনির মতো দরিভালও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমন্বয় করেছেন তারুণ্যের। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর তুরুপের তাস হবেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো কিংবা এনদ্রিকের মতো তরুণেরা। এনদ্রিক আবির্ভাবেই দ্যুতি ছড়িয়েছেন। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে অনেকটা ম্লান সময় পার করছেন ভিনিসিয়ুস। নেইমারবিহীন ব্রাজিলকে কোপায় ভালো করতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে ভিনিসিয়ুসকে। তাঁর ছন্দে থাকার ওপর নির্ভর করছে ব্রাজিলের সাফল্য ও ব্যর্থতার অনেকটাই।
সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনার জন্য এবারের কোপা আমেরিকা হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার মঞ্চ। বিপরীতে ব্রাজিলের জন্য লড়াইটা নিজেদের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার। ভিন্ন দুই লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত কেউ কাউকে ছাড় দেবে না, যা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটাকে করে তুলতে পারে আরও রোমাঞ্চকর।