প্রথম দেখায় দুজনের সম্পর্কের রসায়ন বোঝার উপায় নেই। মাঠে পুরোপুরি পেশাদার। মাহবুবুর রহমানকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছেন মাহমুদা আক্তার। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়ে একই সঙ্গে ঘরে ফিরছেন দুজন।
পেশায় দুজনই কোচ। কর্মস্থলও একই জায়গায়। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান। স্ত্রী মাহমুদাও একই দলের সহকারী। মাহবুবুর এএফসি ‘বি’ লাইসেন্স করেছেন, ‘সি’ লাইসেন্সের সনদ আছে মাহমুদার। কোচ দম্পতির এমন সহাবস্থান ক্রীড়াঙ্গনে একটু বিরলই বলতে হবে।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের সঙ্গে দুজনই জড়িয়ে আছেন অনেক দিন। অনেক ত্যাগের গল্পও লেখা হয়েছে এতে। এই দম্পতির দুই কন্যা। বড় মেয়ে মায়মুনা রওজার বয়স ১১ বছর। ছোট মাইমুনা রাইসার ৬।
দুই মেয়ে মা–বাবার আদর খুব কম সময়ই পেয়ে থাকে। ব্যস্ত এই কোচ দম্পতি মেয়েদের সময় দিতে পারলে তো! মা–বাবার ব্যস্ততার কারণে দুই মেয়েই বেড়ে উঠছে তাদের নানির কাছে।
বাংলাদেশ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতার পরদিন কাঠমান্ডুর টিম হোটেলে বসে মাহবুবুর বলছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য একটা রাত কেটেছে আমাদের। অনন্যা (মাহমুদা) এবং আমি দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাই মতিঝিলের ফুটবল ভবনে। ভোর সাড়ে চারটায় শুরু হয় আমাদের কাজ। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোনো না কোনো কার্যক্রম থাকেই। আমাদের স্বপ্ন ছিল সাবিনা–সানজিদারা সাফে চ্যাম্পিয়ন হবে। ওরা সেই স্বপ্ন সত্যি করেছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে। এই দিনটার জন্যই এত কষ্ট, এত ত্যাগ আমাদের।’
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোচিং স্টাফের অংশ মাহবুবুর। বড় মেয়ে রওজার জন্ম ২০১১ সালে। রওজার বয়স যখন ৬ মাস, তখন তাকে নানির কাছে রেখে ক্যাম্পে যোগ দেন মাহমুদাও। আর ছোট মেয়ে রাইসার ৩ মাস বয়সেই ক্যাম্পে আসতে হয়েছিল মাহমুদাকে।
ব্যস্ত বাবা, ব্যস্ত মা। কিন্তু মেয়েদের এ নিয়ে নাকি কোনো অভিযোগ নেই! তারপরও মাহবুবুর বলছিলেন, ‘বাবা হিসেবে মেয়েদের ঠকিয়েছি। ওদের একদমই সময় দিতে পারি না। তারপরও ওরা খুশি। বাংলাদেশ জিতলেই ছোট মেয়ে লাফালাফি করতে শুরু করে।’
২০১৬ সাল থেকে নারী ফুটবলারদের নিয়মিত আবাসিক ক্যাম্প হচ্ছে বাফুফে ভবনে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী নারী দলের সঙ্গে নারী কোচ রাখা বাধ্যতামূলক। সেটি মেনেই মাহমুদাকে নিয়োগ দেয় বাফুফে। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে মাহমুদাকে বাফুফে ভবনেই থাকতে হয়।
এই কোচ দম্পতির সম্পর্কটা শুরুতে ছিল গুরু-শিষ্যের। ২০১০ সালে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দলে খেলেছেন মাহমুদা। ওই দলের সহকারী কোচ ছিলেন মাহবুবুর।
স্বামী-স্ত্রী হয়ে ওঠার গল্পটা বলছিলেন মাহবুবুর, ‘২০১০ সালের দিকে পরিবার থেকে আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে। একদিন আমার বোন জানতে চায়, পরিচিত কোনো মেয়ে আছে কি না। তখন আমি অনন্যার (মাহমুদা) কথা বলি। এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে পারিবারিকভাবে সবকিছু হয়েছে।’
২০১৬ সাল থেকে নারী ফুটবলারদের নিয়মিত আবাসিক ক্যাম্প হচ্ছে বাফুফে ভবনে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী নারী দলের সঙ্গে নারী কোচ রাখা বাধ্যতামূলক। সেটি মেনেই মাহমুদাকে নিয়োগ দেয় বাফুফে। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে মাহমুদাকে বাফুফে ভবনেই থাকতে হয়।
সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি না। শুক্রবার অনেক সময় অনুশীলন বন্ধ থাকে। ওই দিন সকালে নারায়ণগঞ্জের বাসায় গেলেও আবার রাতের মধ্যেই ফিরতে হয়। কিছু করার নেই। যদিও আমার মায়ের কাছে ওরা ভালোভাবেই বড় হচ্ছে।
বিশেষ করে রাতের বেলায় ফুটবলারদের সবকিছু দেখভাল করেন মাহমুদা।
এই ফুটবলার মেয়েদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে নিজের দুই মেয়েকে আর সময় দিতে পারেন না মাহমুদা। এটা নিয়ে একটু দুঃখ তো আছেই, ‘সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি না। শুক্রবার অনেক সময় অনুশীলন বন্ধ থাকে। ওই দিন সকালে নারায়ণগঞ্জের বাসায় গেলেও আবার রাতের মধ্যেই ফিরতে হয়। কিছু করার নেই। যদিও আমার মায়ের কাছে ওরা ভালোভাবেই বড় হচ্ছে।’
মা আর শাশুড়ি না থাকলে এভাবে চালিয়ে যেতে পারতেন না, এটাও জানেন মাহমুদা, ‘আমার মা–ই ওদের বড় করছে। আমার শাশুড়িও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। এই দুজন না থাকলে আমার ফুটবলে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ত।’
ঈদ, পূজা, বড়দিন—কখনোই ক্যাম্প বন্ধ থাকে না। যেহেতু ক্যাম্প কমান্ডার, তাই ক্যাম্পেই ঈদ কাটে মাহমুদার, ‘বাচ্চাদের ঈদের দিনেও সময় দিতে পারি না। যখন বাসায় যাওয়ার সুযোগ পাই, দুই মেয়েই বলে—আবার কবে আসবে?’