ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।
ইউরোপের রাজনীতির খেলার মাঠ তখন চূড়ান্ত অসহিষ্ণু। দ্বি-মেরুকরণের উত্তপ্ত ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র, বৈশ্বিকতাবাদ বনাম জাতীয়তাবাদ। লড়াই লাগিয়ে রাখা হয়েছিল জাতিতে জাতিতে, শ্রেণিতে বনাম শ্রেণিতে। আর সেসব আগুনে ঘি ঢালছিল লোকরঞ্জনবাদের রাজনীতি। যেসব রাজনীতি ও বিশ্বাস কেবল ক্ষমতাকেই প্রশ্ন করেনি, ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছিল ইউরোপের মানুষের চিন্তা, প্রগতি আর সহমর্মিতাকে।
মাথায় রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটিশ ও মার্কিনিরা মিত্রশক্তির পক্ষ নিলেও যুদ্ধের হাওয়া উসকাতে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ব্রিটিশরা হিটলারকে বন্ধুই ভাবত, শত হলেও তিনি কমিউনিস্টবিরোধী! অন্যদিকে মার্কিনিদের কাছে তো নায়ক! নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৩৮ সালে তাঁকে ভূষিত করেছিল ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে।
কিন্তু আগের বছর প্রীতি ম্যাচ খেলার বাজে অভিজ্ঞতায় বিশ্বকাপের আয়োজকেরা সমস্ত রাহাখরচ দেওয়া এবং বাছাইপর্বে না খেলার প্রস্তাব করলেও তাতে অংশ নেয়নি ইংলিশরা। যেমনটা নেয়নি উরুগুয়ে। প্রথম বিশ্বকাপে ইউরোপীয়দের গণবয়কটের রাগ তো কিছুটা ছিলই, তবে এর চেয়ে বড় কারণ ছিল তত দিনে লাতিন আমেরিকার দেশটির অর্থনীতির বেলুন ফুটো হয়ে গেছে বৈশ্বিক মন্দার খোঁচায়। ফলে ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়া উরুগুয়েই এখন পর্যন্ত একমাত্র দল, যারা আগের আসরে জেতার পরও শিরোপা অক্ষুণ্ণ রাখার লড়াইয়ে অংশ নেয়নি।
আর্জেন্টিনা অবশ্য এসেছিল। তবে তাদেরও তখন ভগ্নদশা। লাতিন খেলোয়াড়েরা তত দিনে ইউরোপের লিগগুলোতে খেলে টাকাপয়সা কামানোর রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। বিশেষত লুইস মন্টির মতো ইতালীয় পূর্বপুরুষ থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও ইতালিতে থাকা অনেক আর্জেন্টাইনের মামা–কাকা সাজিয়ে খেলোয়াড়েরা ইতালিতে এসে পাড়ি জমাতেন।
আর্জেন্টিনার ইতিহাস লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আলাদা। সেখানে বেশির ভাগ অধিবাসী ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত। যদিও স্প্যানিশরাই ছিল এই এলাকার মূল দখলদার, তবে তাঁদের ছাপিয়ে যায় ইতালিয়ানরা। এখনকার দিনে এক হিসেবে দেখা যায়, প্রায় ৬২ শতাংশ আর্জেন্টাইনেরই কোনো না কোনোভাবে ইতালীয়র শরীরে পূর্বপুরূষের রক্ত বইছে। আশ্চর্যজনকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ইউরোপ থেকে পালিয়ে যাওয়া ইহুদি ও নাজি উভয়েরই আশ্রয়স্থল ছিল দেশটি।
আর্জেন্টিনা তাই ভৌগোলিক কারণে লাতিন ঘরানার, ড্রিবল–নির্ভর ফুটবল খেললেও ইতালীয় যোগাযোগের কারণে তাঁদের খেলায় রক্ষণাত্মক ও শরীরনির্ভর ‘গ্রিন্তা’ ফুটবলেরও আধিপত্য দেখা যায়। এই দুই চিন্তার সংঘর্ষই আর্জেন্টিনার ফুটবলকে গড়ে দিয়েছে।
আর সেই ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা মন্টিই এ যাবত একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুই দেশের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন। তিনি ছিলেন কোচ ভিত্তরিও পোজোর ‘মেতোদো’ সিস্টেমের তুরুপের তাস। এই সিস্টেমে সেন্টার হাফ হিসেবে খেলতেন। প্রতিপক্ষ যখন আক্রমণে উঠে আসত, তাঁর কাজ ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ডকে মার্ক করা, আবার নিজেরা যখন আক্রমণে উঠত, তখন মন্টির ভূমিকা হয়ে পড়ত মধ্যমাঠের মূল প্লেমেকার হিসেবে। মন্টির মতো দুর্দান্ত খেলোয়াড়দের কল্যাণেই পোজো নিজের কৌশলে সাফল্য পেয়েছিলেন।
পোজো একজন কিংবদন্তি। তিনি কেবল টানা দুইবার বিশ্বকাপ জেতা কোচই ছিলেন না। ফুটবলের আদি ফরমেশন পিরামিড (২-৩-৫) থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে তিনি মোতাদো বা ২-৩-২-৩ ছকের সূচনা করে খেলাটার খোলনলচে পাল্টে দেন। এমনকি আধুনিক যুগের পেপ গার্দিওলার মতো কোচও এই ছকের ওপর ভিত্তি করেই নিজের রণকৌশল সাজান।
লাতিন আমেরিকা থেকে আর কোনো দল অংশ না নিলেও ১৯৩৪ বিশ্বকাপে অংশ নিতে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই উৎসাহ দেখায়। ফলে প্রথমবারের মতো বাছাইপর্বের আয়োজন হয়। মোট ৩৬টি দেশ বাছাই পর্বে অংশ নেয় এবং সিদ্ধান্ত হয় চূড়ান্ত পর্বের ১৬টি দেশের ১২টা হবে ইউরোপের, তিনটি আমেরিকা মহাদেশের আর কেবল একটা আসবে পৃথিবীর দুটো বৃহত্তম মহাদেশ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে।
শুরু হলো বিশ্বকাপ
টুর্নামেন্টের ফরম্যাট ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দর্শনের মতোই, প্রথম ধাক্কাতেই ‘দুর্বল’ দলগুলোকে ছেঁটে ফেলা হবে। এ কারণে প্রথম রাউন্ডই হবে নকআউট, যেখানে একটা ম্যাচ খেলেই আট দল বাদ পড়বে। আর তা–ও কী! এই আটটি ম্যাচই হবে একই দিনে ২৭ মার্চ।
মুসোলিনি বা ‘এল ডুসো’র ইতালি যুক্তরাষ্ট্রকে উড়িয়ে দেয় ৭-১ গোলে। সুইডেনের কাছে ৩-২ গোলে হারে আর্জেন্টিনা, যাদের দলে তখন আগের বিশ্বকাপের একজন খেলোয়াড়ও ছিল না। লুইস মন্টি, রাইমুন্দো অর্সি এবং এনরিক গুয়াইতা সেবার ইতালির হয়ে খেলেন।
সে যুগের সেরা দল অস্ট্রিয়াকে চমকে দিয়ে ফ্রান্স ৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলে শেষ করে, তবে অতিরিক্ত সময়ের এক সন্দেহজনক গোলে অস্ট্রিয়া ৩-২ গোলে জেতে। হিটলারের জার্মানি শুরুতেই বেলজিয়ামের সঙ্গে ২-১ গোলে পিছিয়ে পড়লেও শেষতক এডমুন্ড কোনেনের হ্যাটট্রিকে ৫-২ গোলে জেতে।
সুইজারল্যান্ড ৩-২ গোলে হারায় নেদারল্যান্ডসকে আর সে খেলায় বিজয়ী দলের হয়ে দুই গোল করা ও চশমা পরে খেলতে নামা লিওপোল্ড কিয়েলহোলজের একটি গোল মাঠের মাঝখানে উঁচু হয়ে থাকা এক ঢিবিতে লেগে দিক বদলে সোজা পোস্টে ঢুকে যায়।
ইউরোপের গরিব দেশ রোমানিয়াও সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে ১১ মিনিটেই এগিয়ে গিয়েছিল। তবে শেষতক ২-১ গোলে হারে। আর চেকরাও ভাগ্যের ছোঁয়া পায়, কারণ নেজেদলির গোলটা এসেছিল ‘ওয়ান ড্রপ’ এর বাউন্সে পাওয়া ‘অ্যাসিস্ট’ থেকে।
এমনকি আফ্রিকার দেশ মিসরও ভড়কে দিয়েছিল সে যুগের অন্যতম সেরা দল হাঙ্গেরিকে। আবদুলরাহমান ফাওজির জোড়া গোলে প্রথমার্ধ ২-২ গোলে শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধে ফাউজি মাঠের মাঝবরাবর বেশ কয়েকজনকে কাটিয়ে একক প্রচেষ্টায় দারুণ এক গোল দিলেও রেফারি তা বাতিল করে দেন অফসাইডের অজুহাতে! আর্জেন্টিনা আর মিসরের পর ব্রাজিলও স্পেনের কাছে ৩-১ গোলে হেরে গেলে নিশ্চিত হয় যে দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে টুর্নামেন্টটা হবে শুধুই ইউরোপিয়ানদের।
দ্বিতীয় পর্বের নকআউটে সে যুগের দুই সেরা দল অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি মুখোমুখি হয়। কিন্তু ফুটবল খেলাটা সে সময়ের ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থার মতোই কুৎসিত ও সহিংস। একে তো এই দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই ছিল, পাশাপাশি একদা সুবিশাল ও শক্তিশালী অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য টুকরা হয়ে যাওয়া দুই অংশের মধ্যে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই চলছে সেই উনিশ শতকের গোড়া থেকে। একদিকে ‘ম্যাগিয়ার্স’ হাঙ্গেরিয়ানদের বীরত্বের গর্ব, অন্যদিকে অস্ট্রো–জার্মানদের আভিজাত্যের বড়াই। আর ভার্সাই চুক্তির ফলে এই বিরোধ আকাশে গিয়ে ঠেকল!
বোলোনিয়ার স্তাদিও লিতোরিওতে সেই খেলায় প্রবল লাথালাথি আর মারামারির পর অস্ট্রিয়া ২-১ গোলে জেতে। অস্ট্রিয়ার কোচ হুগো মেইসেল খেলা শেষে একে আখ্যা দেন ‘ফুটবলের প্রদর্শনী নয়, রীতিমতো দাঙ্গা’ হিসেবে। ছোট করে এই কিংবদন্তির কথা বলি। বোহেমিয়ায় ১৮৮১ সালে জন্ম মেইসেলের। অল্প বয়সে ভিয়েনায় চলে যাওয়ার পর ব্যাংকের কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন; কিন্তু নেশা ছিল ফুটবল।
ভিয়েনা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের হয়ে অল্প কিছুদিন খেলেনও তবে আসল সফলতা পান সংগঠক হিসেবে। অস্ট্রিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি পদে আসীন হবার পর তিনি মিত্রোপা কাপ ও সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইণ্টারন্যাশনাল কাপ চালু করেন যেগুলোকে এক অর্থে আধুনিক চ্যাম্পিয়নস লিগের আদি সংস্করণ বলা যায়, কারণ, সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দল খেলত। এর চেয়েও দারুণ কাজ তিনি করেন ১৯২৪ সালে অস্ট্রিয়াতে পেশাদার ফুটবল লিগ চালু করে।
এ তো গেল সংগঠক হিসেবে মেইসেলের কিংবদন্তিনামা, কোচ হিসেবেও তিনি অমর হয়ে আছেন ইংলিশদের আদি পিরামিড ফর্মেশনকে ভেঙে ‘দানিউব স্কুল অব থট’ আবিষ্কারের অন্যতম চিন্তক হিসেবে। এই কৌশলে সেন্টার ফরোয়ার্ড একটু নেমে এসে খেলতেন। ইংলিশদের মতো লম্বা পাসে ক্রস করলাম আর ‘বাকিটা আল্লাহর হাতে’ এই কৌশল বাদ দিয়ে খেলোয়াড়দের ড্রিবলিং, ব্যক্তিগত দক্ষতা ও ছোট পাসের মাধ্যমে দলীয় সমন্বয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হতো।
ফেরা যাক ১৯৩৪ বিশ্বকাপে। মিলানের সান সিরো স্টেডিয়ামে তুমল বৃষ্টির মধ্যেই ‘সোয়াস্তিকা’ খচিত পতাকা নিয়ে দর্শক হাজির হয় সুইডেনের বিরুদ্ধে জার্মানি দলকে সমর্থন দিতে, যারা ২-১ গোলে জেতে। এই রাউন্ডের সবচেয়ে দারুন খেলাটা হয় তুরিনে, চেকোস্লোভাকিয়া আর সুইজারল্যান্ডের মধ্যে। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের ঘনঘটায় শেষতক চেকরা জয়ী হয় ২-১ গোলে।
তবে সবচেয়ে আলোচিত খেলাটা হয় ফ্লোরেন্সে—স্বাগতিক ইতালি আর স্পেনের মধ্যে। ইতালির শারীরিক ফুটবলের সামনে রেফারি নত হয়ে থাকলেও স্প্যানিয়ার্ডরা পাল্লা দিয়ে লড়াই করে। সাড়ে তিন ঘণ্টা মারমার কাটকাট সে খেলার ফল ১-১ হলেও ইতালি জিতেছিল আরেক হিসাবে, ৭-৪ ব্যবধানে।
কারণ, মারধর খেয়ে এবং দিয়ে মাঠের বাইরেই চলে যেতে বাধ্য হয় ইতালির একাদশের চার আর স্পেনের সাত-সাতজন খেলোয়াড়। অতিরিক্ত সময়েও খেলার ফলাফল একই থাকলে পরের দিন আবার গোড়া থেকে খেলা শুরু হয়। চোটে ছিটকে পড়া সে যুগের সেরা গোলরক্ষক জামোরাবিহীন হতোদ্যাম স্পেন হারে ১-০ গোলে। এতে নিশ্চিত হয়, দুদিন পর সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে ইতালি ও অস্ট্রিয়া। একদিক দিয়ে দুই যুগশ্রেষ্ঠ কোচ মেইসেল আর পোজোর মধ্যে লড়াই। অন্যদিকে ফুটবলে বিপ্লব ঘটায়ে ফেলা অস্ট্রিয়া বনাম ফ্যাসিস্ট ইতালির লড়াই।
কিন্তু সেই লড়াইয়ে মেইসেলসহ সবার শরীরী ভাষা ছিল ক্লান্তিকর। দলের সেরা খেলোয়াড় সিন্ডলার ছিলেন মন্টির কড়া পাহারায়। আর মন্টির সঙ্গে আর্জেন্টিনার হয়ে ৩০ বিশ্বকাপ খেলা গুইতা ১৯ মিনিটের মাথায় একমাত্র গোলটি করেন। অস্ট্রিয়া শেষ দিকে জ্বলে উঠে, ডিফেন্স চিরে ওপরে উঠে যান যিশচেক কিন্তু তাঁর শটটা লক্ষ্য থেকে দূরে চলে যায়। ঠিক যেভাবে ইউরোপের ‘কফি হাউস’কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি লক্ষ্যহীন হয়ে পরাস্ত হয় উগ্র ফ্যাসিবাদের কাছে।
অস্ট্রিয়া : ফুটবল ইতিহাসের এক জ্বলজ্বলে নাম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার প্রায় একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব অস্ট্রিয়া আর তাঁদের সুবাদে শহরটির গণশিক্ষা, গণস্বাস্থ্য এবং আবাসনের প্রভূত উন্নতি হয়। বিশ্বযুদ্ধে হারের ধাক্কা সয়ে, রেড ভিয়েনা নাম পেয়ে যাওয়া শহরটি পরিণত হয় ইউরোপের অন্যতম বাসযোগ্য শহরে। এমনকি কার্ল পোলাইনি, যিনি ছিলেন গত শতকের অন্যতম সেরা চিন্তক ও নৃতাত্ত্বিক। তাঁর ভাষায়, ‘ভিয়েনা পশ্চিমের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাংস্কৃতিক বিজয় অর্জন করেছে…ভিয়েনা সিস্টেমের সুরক্ষায় এখনকার শ্রমিক সমাজ নৈতিক ও বৌদ্ধিক দিক দিয়ে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে আর এর ফলে মারাত্মক অর্থনৈতিক ধাক্কা সহ্য করেও ওরা এমন এক স্তরে পৌছতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে এর আগে কোন শিল্পোন্নত সমাজের জনতা কখনো পৌঁছাতে পারেনি।’
ইংল্যান্ডে যে খেলাটা ছিল ‘বস্তির লোকদের গন্ডগোল’ ভিয়েনার সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে তা হয়ে ওঠে জনতার শিল্পে। মেইসেলের কথা তো বলাই হলো, পুরো সংস্কৃতিতেই একটা আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে ফুটবলের শৈল্পিক সত্তাকে আরও উজ্জীবিত করে তোলার। ভিয়েনার পেশাদার লীগ আধুনিক ফুটবল এবং এর সঙ্গে দর্শকের সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সাহিত্য, চলচ্চিত্রের মতো ফুটবলও যে আসলে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের হাতিয়ার ও ফলাফল তা প্রমাণ হয়।
এর প্রমাণ কিংবদন্তি অস্ট্রিয়া জাতীয় দল বা ‘ভুন্ডারটিম’। সে যুগের ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, ফুটবল ‘শক্তপোক্তদের’ খেলা, এই খেলায় শৌর্য আর যুদ্ধংদেহিতাই প্রধান। কিন্তু এই ধারণার পরিপন্থী ছিলেন লিকলিকে শরীরের ‘পেপারম্যান’ বলে খ্যাত ম্যাথিয়াস শিন্ডলার। বলা বাহুল্য, ফুটবল ইতিহাসে প্রথম ‘ড্রিম টিম’ও বলা হয় অস্ট্রিয়ার এই সময়ের দলকে।
তবে শিন্ডেলারের আরেকটি ডাকনাম ‘দি ওয়েফার’ তাঁর সঙ্গে বেশি মানানসই। কারণ, তিনি প্রতিপক্ষের রক্ষণকে চিরে দিতেন। এই প্লে–মেকার বুঝতেন ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হচ্ছে জায়গা এবং তাঁর ব্যাবহার। শিল্পীরা যেমন ক্যানভাসে জায়গার ব্যবহার করে, সে দক্ষতায় আর যন্ত্রশিল্পীরা যেভাবে একসঙ্গে অর্কেস্ট্রা বাজায় সেই নানন্দিকতায় তিনি ফুটবলটা খেলতেন। সিন্ডেলার প্রমাণ করে দেন, কেবল শরীরের খেলার বাইরে ফুটবল নন্দনতত্ত্বে তিনি দুর্দান্ত এক উদাহরণ।
সেই শিন্ডলার রহস্যময়ভাবে মারা যান নাৎসিদের অধিকৃত অস্ট্রিয়ায়, নাৎসিদের হয়ে খেলতে রাজি না হওয়ার কিছুদিন পর।
সেমিফাইনাল ও ফাইনাল
অস্ট্রিয়ানদের অনুসরণে শৈল্পিক ফুটবল খেলা চেকোস্লোভাকিয়া টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা নেজেদলির হ্যাটট্রিকে ৩-১ গোলে হারায় গা জোয়ারি খেলা জার্মানদের। মিয়াজ্জার একমাত্র গোলে জেতে ইতালি।
ফাইনালে ৭১ মিনিটে পুকের গোলে এগিয়ে যাওয়া চেকরা জিতেই যেত যদি না সোবোতকা এরপর একটা সহজ সুযোগ হাতছাড়া না করতেন। আর সভোবদার শট পোষ্টে লেগে না ফিরতো। চেকোস্লোভাকিয়া হতে পারত প্রথম ইউরোপিয়ান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। হতো পারত ইউরোপের বঞ্চিত অংশ, পূর্ব ইউরোপের এখন অবধি একমাত্র চ্যাম্পিয়ন। শৈল্পিক দানিউব স্কুলের জয় হতো। কিন্তু এর বদলে পৃথিবীর আরও অনেক ইতিহাসের মতোই চাকা উল্টে গেল। আর্জেন্টাইন গুইতার পাস থেকে পাওয়া বলে আরেক আর্জেন্টাইন ওরসির শট চেক গোলকিপার প্লানিকার আঙুল ছুঁয়ে গোলে ঢুকে যায় ৮১ মিনিটে। আর অতিরিক্ত সময়ের ছয় মিনিটে ডান প্রান্তে খোঁড়াতে থাকা জিউসেপ্পে মিয়াজ্জা ক্রস করেন গুইতার উদ্দেশ্যে, যিনি কিছুটা দৌড়ে পাস দেন অ্যাঞ্জেলা শিয়াভিওকে। সারা জীবন বোলোনিয়ার হয়ে খেলা, ক্লাবকে চারটা স্কুডেট্টা জেতা শিয়াভিওর শট জালে জড়িয়ে যায়। উল্লাসে মাতে ইতালি আর জয় হয় মুসোলিনির।
ইতালি আয়োজক হিসেবে শুধু বিশ্বকাপই জেতেনি, ৩৫ লাখ লিরা খরচ করে আয়োজন করা এই টুর্নামেন্ট থেকে ১০ লাখ লিরা মুনাফাও তুলে নেয়। তবে সব ছাপিয়ে প্রথমবারের মতো রেডিওতে বিশ্বকাপের লাইভ কমেন্ট্রি প্রচারের পাশাপাশি এই বিশ্বকাপে তিন লাখ পোস্টার, স্ট্যাম্প এমনকি সিগারেটের বিজ্ঞাপন মিলিয়ে ফ্যাসিজমের বিশ্বকাপ প্রচার-প্রসারের এক নতুন বিজ্ঞাপনী মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়।
জুলে রিমে ট্রফির পাশাপাশি বিজয়ী দলকে দেওয়া হয় মুসোলিনির নির্দেশে নির্মিত কোপা দেল দুসে ট্রফি।
জুলে রিমে ট্রফির ছয় গুণ, ব্রোঞ্জে মোড়া, প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য আর ফ্যাসিবাদের বীরত্ব প্রকাশ করা দানবাকৃতির এক পুরস্কার, যা মুসোলিনি আর তাঁর আদর্শের উপযুক্ত প্রতীক। আদতে ইতালির আয়োজনে এই বিশ্বকাপ ছিল স্বৈরশাসন ও বিশ্বকাপের মধ্যে শুরু হওয়া এক বিপরীতমুখী সম্পর্কের অভিষেক।