সমৃদ্ধ ইতিহাস পেছনে ফেলে ক্যাম্প ন্যু যখন স্মৃতি হওয়ার পথে
‘এটা চিরবিদায় নয়, বিদায়টা আপাতত।’
স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস ১৭৮৮ সালে লিখেছিলেন কবিতায়। ক্যাম্প ন্যুতে গত রোববার রাতটি লাইনটির সার্থক প্রতিচ্ছবি। মায়োর্কার বিপক্ষে শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে পর্দা নেমে গেল ১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা ক্যাম্প ন্যুর। ৬৬ বছরের পুরোনো এই স্টেডিয়াম কি শুধু ইতিহাসেই পরিপুষ্ট?
৯৯ হাজার ৩৫৪ আসনের এই স্টেডিয়াম আসনসংখ্যার বিচারে ইউরোপে সবচেয়ে বড়। আর বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়াম। উত্তর কোরিয়ার রানগ্রাদো স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যুকে টেক্কা দিলেও এটির ব্যবহার নানামুখী। কিন্তু ক্যাম্প ন্যুর জন্ম শুধু ফুটবলের জন্য। ক্লাব ফুটবল থেকে ১৯৮২ বিশ্বকাপ ম্যাচ, ১৯৯২ অলিম্পিকে ফুটবলের ম্যাচগুলো হয়েছে বার্সার এই মাঠে।
২০১৪ সালে নেওয়া ‘এসপাই বার্সা’ প্রকল্পের অধীনে এই স্টেডিয়াম সংস্কার করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বার্সা। সিদ্ধান্ত হয়েছিল এ মৌসুমে ঘরের মাঠে বার্সার শেষ ম্যাচটি দিয়ে ক্যাম্প ন্যুর পর্দা নামানো হবে। কী নাটকীয়! পরশু রাতে পুরোনো এই ক্যাম্প ন্যুতে বার্সার শেষ ম্যাচটি হয়ে গেল ঘরের মাঠে সের্হিও বুসকেটস ও জর্দি আলবারও শেষ ম্যাচ!
সতীর্থদের বাহুডোর ও উদ্যাপনের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছেন বুসকেটস-আলবা। বার্সার ৩-০ গোলের জয় তাতে ‘আইসিং অন দ্য কেক’—সেটি কি ক্যাম্প ন্যুর জন্যও নয়? অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের পুরোনো ইতিহাসের বাকল খুলে ক্যাম্প ন্যুকে সাজানো হবে নতুন করে। জয়টা তাতে মধুরেণ সমাপয়েৎ। সমর্থকদের তা আরও মধুর লেগেছে বার্সা আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখায়।
পুরোনো ক্যাম্প ন্যুতে এ শেষ ম্যাচের উদ্যাপনের ট্যাগ-লাইন ছিল ‘ফুল অব হিস্টরি, ফুল অব ফিউচার’—বোঝাই যায়, ঐতিহ্য আর ইতিহাসে ভরপুর ক্যাম্প ন্যুকে ঢেলে সাজিয়ে যেহেতু নতুন আরও কিছু সুবিধা সংযোজন করা হবে ভবিষ্যতে, তাই অতীত ও ভবিষ্যতের সম্মিলনেই এই ট্যাগ-লাইন। সমর্থকদের তাই ক্লাবের ঐতিহ্যবাহী লাল-নীল ও মেরুন রঙের পোশাক পরে আসার অনুরোধ জানিয়েছিল বার্সা। এর সঙ্গে স্কার্ফ। মোজাইকও সাজানো হয় গ্যালারিতে।
৮৮ হাজার দর্শককে সাক্ষী রেখে মাঠে ছয়টি বড় জার্সি নিয়ে ঢুকেছিলেন বার্সার বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা। এটি ক্যাম্প ন্যুর ছয়টি দশকের রূপক। কাতালান ভাষার লেখক হোসে মারিয়া দে সাগরার লেখা কবিতাও পাঠ করা হয়—যে রাতে ক্যাম্প ন্যু যাত্রা শুরু করেছিল, সেদিনও কবিতাটা পাঠ করা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ‘সারদানা’ নাচেও মাতানো হয়। আর ছিলেন বার্সার ১৪ নম্বর সদস্য ও সিনেটর মিকুয়েল এসকুইরোল—৬৬ বছর ধরে এই স্টেডিয়ামের নিয়মিত দর্শক। মায়োর্কা ম্যাচের কর্নার ফ্লাগ উপহার দেওয়া হয় তাঁকে।
কাতালান ব্যান্ড ‘লা ত্রিনকা’র ‘গুডবাই’ গানও গেয়ে শোনান স্থানীয় শিল্পী বেথ। এই স্টেডিয়ামে জেতা বার্সার গুরুত্বপূর্ণ শিরোপাগুলোর সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন সমর্থকেরা। আর স্টেডিয়ামের ঘোষক মানেল ভিচ একটি চমকও উপহার দেন। ১৯৫৭ সালে ক্যাম্প ন্যুতে খেলা প্রথম ম্যাচের দুই দলের খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করেন।
বিরতির সময় গান গেয়ে সমর্থকদের বিনোদন দিয়েছেন কাতালান গায়ক লিলদামি। আর শেষ বাঁশি বাজার পর? ক্যাম্প ন্যুকে চেনা সাজে আর কখনো দেখা যাবে না।
পরিকল্পনা ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়িত হলে আগামী বছর নভেম্বরের আগপর্যন্ত এই মাঠে আর ফিরবে না বার্সা। আগামী মৌসুমে মুন্তজুইকের অলিম্পিক স্টেডিয়ামকে ‘ঘর’ বানাবে ক্লাবটি। সেখানেই খেলবে হোম ম্যাচ। এর মধ্যে সংস্কারকাজ চলবে ক্যাম্প ন্যুতে। ৫০ শতাংশ আসন ঠিক করে ২০২৪-২৫ মৌসুমে ক্যাম্প ন্যুতে ফিরবে বার্সা। ২০২৫-২৬ মৌসুমে সংস্কারের কাজ শেষ হওয়ার কথা। ৭৮ কোটি ২০ লাখ পাউন্ডের এ প্রকল্পে ক্যাম্প ন্যুতে ভিআইপি আসন বাড়ানো হবে। ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ জানিয়েছে, ক্যাম্প ন্যুর মোট আসনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ ভিআইপি আসন—যেখান থেকে ম্যাচের দিন ইউরোপে অন্য সব স্টেডিয়ামের তুলনায় কম আয় হয় বার্সার। দর্শক আসনসংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজারে উন্নীত করেও আয় বাড়াতে পারবে ক্লাবটি, অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে যা সাহায্য করবে। সংযোজন করা হবে নতুন ছাদও।
পুরোনো ক্যাম্প ন্যুতে গত রাতে বার্সার শেষ ম্যাচে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও দিয়ে রাখলেন ক্লাবটির দুই তরুণ। বার্সার করা ৩ গোলের প্রথম দুটি ২০ বছর বয়সী আনসু ফাতি এবং শেষটি ১৮ বছর বয়সী গাভির। এই দুই তরুণে ভবিষ্যৎ দেখছে বার্সা। আর পরিসংখ্যানেও লেখা থাকল ক্যাম্প ন্যুতে শেষ অফিশিয়াল ম্যাচে শেষ গোলটি গাভির—যেহেতু ক্যাম্প ন্যু সংস্কার করে স্পনসরশিপ চুক্তির অধীনে এই মাঠে নতুন নাম হবে স্পটিফাই ক্যাম্প ন্যু।
ফুটবলের পরিসংখ্যানভিত্তিক টুইটার অ্যাকাউন্ট ‘মিস্টারচিপ’ জানিয়েছে, এই মাঠে প্রথম গোলটি বার্সার উরুগুয়ে ফরোয়ার্ড র্যামন ভিলাভের্দের। ১৯৫৭ সালের ৬ অক্টোবর গোলটি করেছিলেন রিয়াল গায়েনের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে ক্যাম্প ন্যুতে ১৬৭৭ ম্যাচ খেলেছে বার্সা। জিতেছে ১২৪৮ ম্যাচ, ড্র ২৬৮ ও হার ১৬১ ম্যাচে। ৪৩২৪ গোল করার পথে ১৩৩২ গোল হজম করেছে বার্সা। এই মাঠে বার্সা (৪৩২৪) যত গোল করেছে, তার মধ্যে ৫২৮ গোলে অবদান (গোল করা ও করানো) রয়েছে লিওনেল মেসির, যা মোট গোলের ১২ শতাংশ।
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি এখন আর নেই। বার্সায় ফেরার গুঞ্জন থাকলেও সেটি হবে কি না, তা অনিশ্চিত। যে মাঠে তিনি ইতিহাসের পর ইতিহাস গড়েছেন, সে মাঠও আর আগের মতো থাকবে না। পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে ক্যাম্প ন্যুতে এবং তা শুরু হয়েছে আজ সকাল থেকেই।
সংস্কার শুরু করতে রূপকভাবে প্রথম প্রস্তর-ফলক স্থাপন করেছেন বার্সার প্রতিনিধিরা। এর মধ্য দিয়ে বাস্তবতার পথে যাত্রা শুরু করল এসপাই বার্সা প্রকল্প। ক্যাম্প ন্যুতে একটু মাটি খুঁড়ে তাতে বিচিত্র সব স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখার মাধ্যমে এই কাজের উদ্বোধন করা হলো।
কোচ জাভি হার্নান্দেজ তাতে রেখেছেন বার্সার একটি জার্সি, বুসকেটস রেখেছেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড, বার্সায় পুরো ক্যারিয়ার কাটানো নারী দলের সাবেক লেফটব্যাক মেলানি সেরানো একটি বল রাখেন গর্তে। বয়সভিত্তিক দলের দুজন খেলোয়াড় রেখেছেন কিছু বুট, আর সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা বার্সা ও কাতালুনিয়া অঞ্চলের পতাকা রেখেছেন গর্তে।
গর্তটি ভরাট করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্প ন্যু সংস্কারের কাজও শুরু হলো। চিরচেনা সেই ক্যাম্প তো আর কদিন পরই স্মৃতি!