অক্টোবরেই সোনার জুতা নিয়ে কথা বলতে বাধ্য করলেন আর্লিং ‘বোল্ট’ হলান্ড
ইতিহাদে কাল ‘ম্যানচেস্টার ডার্বি’র আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি ভেসেছে। স্প্রিন্টের ট্র্যাকে ছুটছেন আর্লিং হলান্ড, রবার্ট লেভানডফস্কি, নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পে। ট্র্যাকে তাঁদের পায়ের পাশে লেখা গোলসংখ্যা। ক্যাপশন, ‘চলছে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জয়ের প্রতিযোগিতা।’
ছবিতে আরও একটি দৃশ্য আছে। হলান্ড-লেভারা যখন ছুটছেন, তখন স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে সেলফি তুলছেন চারবারের গোল্ডেন শু–জয়ী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেই ছবিতে নেই লিওনেল মেসিও। ছয়বারের গোল্ডেন শু–জয়ী আর্জেন্টাইন তারকা লিগ আঁতে ৫ গোল করলেও রোনালদো প্রিমিয়ার লিগে এখনো গোলের খাতা খুলতে পারেননি।
এই লেখার উপজীব্য রোনালদো–মেসি নন, একটা পরিস্থিতি বোঝাতে ছবিটার উদাহরণ দেওয়া। নিজের সেরা সময়ে রোনালদো মৌসুমের শুরু থেকে গোল্ডেন শু জয়ের দৌড়ে থাকতেন। ৩৭ বছর বয়স তাঁকে এবার ট্র্যাকে যেমন রাখেনি, তেমনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এতটা পথ এগিয়ে গেছেন যে সম্ভবত আর ধরা সম্ভব নয়।
আর্লিং হলান্ডের কথাই ধরুন, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আট ম্যাচেই তাঁর হ্যাটট্রিক–সংখ্যা তিনটি! প্রিমিয়ার লিগে এর আগে সবচেয়ে কম ম্যাচে তিন হ্যাটট্রিকের রেকর্ড ছিল লিভারপুলের সাবেক স্ট্রাইকার মাইকেল ওয়েনের। তাঁর ম্যাচসংখ্যা জানলেই পার্থক্যটা বোঝা যায়, ৪৮ ম্যাচ! কেউ কেউ তো রসিকতাও করছেন, হলান্ড যে গতিতে এগোচ্ছেন, তাতে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটা ভাঙতে পারেন এই মৌসুমেই!
অন্য লিগের তারকারাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। রবার্ট লেভানডফস্কি লা লিগায় ৭ ম্যাচে করেছেন ৯ গোল। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৯ ম্যাচে ১২ গোল বার্সেলোনার এই তারকার। লা লিগার চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতাও লেভা। ফরাসি লিগ আঁতে সর্বোচ্চ গোলদাতা নেইমার ৯ ম্যাচে করেছেন ৮ গোল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কিলিয়ান এমবাপ্পের গোলসংখ্যা ৮ ম্যাচে ৮।
মোটামুটি বলা যায়, এ যেন অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট! সবাই যথেষ্ট ভালো শুরু করেছেন, কিন্তু উসাইন বোল্ট কীভাবে যেন বাকিদের চেয়ে প্রমাণ ব্যবধানে এগিয়ে। আর প্রিমিয়ার লিগে এখনো গোল না পাওয়া রোনালদো যেন ‘ফলস স্টার্টের’ শিকার হয়ে প্রতিযোগিতার বাইরে!
ইউরোপে শীর্ষ পাঁচ লিগে তাই মৌসুম শুরুর দুই মাস শেষ হতে না হতেই রসিকতা চলছে, অন্যান্য মৌসুমে দেখা যেত ‘গোল্ডেন শু’ কে জিততে পারেন, সেই হিসাব শুরু হতো মৌসুমের অর্ধেক সময় যাওয়ার পর (বড়দিনের ছুটি ও ডিসেম্বর শেষ হওয়ার পর), কিন্তু এবার হলান্ড-লেভারা যা শুরু করেছেন, তাতে ফয়সালা হয়ে যেতে পারে কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগেই!
কথাটা অবশ্যই বেশি বেশি বলা মনে হতে পারে। কিন্তু হলান্ড-লেভারা যা শুরু করেছেন, সেটাও বেশি বেশি নয় কী! কাতার বিশ্বকাপ শুরু হবে ২০ নভেম্বর, আর প্রিমিয়ার লিগে এরই মধ্যে হলান্ডের গোলসংখ্যা ৮ ম্যাচে ১৪।
ইতালিয়ান সিরি আ ও বুন্দেসলিগার তথ্য না দেওয়ায় ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। চিরকালের রক্ষণনির্ভর সিরি ‘আ’ এবং কথিত ‘রক্ষণহীন’ বুন্দেসলিগায়ও গোলের দেখা মিলছে ভালোই। সিরি ‘আ’তে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা বোলোনিয়ার মার্কো আরনাউতোভিচ ৮ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল।
লাৎসিও স্ট্রাইকার চিরো ইম্মোবিলে ৮ ম্যাচে ৫ গোল নিয়ে দুইয়ে। জার্মান বুন্দেসলিগায় ভেরডার ব্রেমেন ফরোয়ার্ড নিকলাস ফুলক্রুগ ৮ ম্যাচে ৭ গোল নিয়ে শীর্ষে। কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিরতিতে যাবে ইউরোপের লিগগুলো। তার আগে আরনাউতোভিচ-ফুলক্রুগদের গোলসংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়বে। বসে থাকবেন না হলান্ড-লেভা-নেইমার-এমবাপ্পেরাও।
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বিরতিতে যাবে ১২-১৩ নভেম্বর ম্যাচের পর। মধ্যবর্তী বিরতির আগে এ দুই দিন শেষ রাউন্ডের খেলা হবে। লা লিগাও একই পথ অনুসরণ করবে। বুন্দেসলিগা মৌসুমের মধ্যবর্তী বিরতিতে যাবে ১৩ নভেম্বর ম্যাচ শেষে। সিরি ‘আ’ ও ফ্রেঞ্চ লিগ আঁও প্রিমিয়ার লিগ ও লা লিগার পথে হাঁটবে, অর্থাৎ মধ্যবর্তী বিরতির আগে শেষ রাউন্ডের ম্যাচ খেলা হবে ১২ ও ১৩ নভেম্বর।
এবার একটা তুলনা টানা যায়। গত মৌসুমে গোল্ডেন শু জেতেন লেভানডফস্কি। বায়ার্নের হয়ে বুন্দেসলিগায় ৩৫ গোল করেছিলেন। তার আগের মৌসুমেও (২০২০-২১) লেভাই পুরস্কারটি জেতেন ৪১ গোল করে। ২০১৬-১৭ মৌসুম থেকে গত মৌসুম পর্যন্ত শুধু একবারই ৪০ গোলের বেশি করে গোল্ডেন শু জিততে হয়েছে, সেটি ২০২০-২১ মৌসুমে। তা ছাড়া এই ছয় মৌসুমের মধ্যে পাঁচ মৌসুমেই ৩০ থেকে ৩৯–এর ঘরে ছিল বিজয়ীদের গোলসংখ্যা।
এবার ভাবুন তো, হলান্ড যে গতিতে এগোচ্ছেন, তাতে মৌসুমের মধ্যবর্তী বিরতি শুরুর আগেই গোল্ডেন শু জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গোলসংখ্যা আদায় করে নিতে পারবেন কি না? নরওয়ে তারকার পক্ষে বাজি ধরার লোকের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম হবে না। আর পুরো মৌসুম বিবেচনা করলে এই বাজির বিপক্ষে হয়তো কাউকেই পাওয়া যাবে না! লেভা-নেইমার-এমবাপ্পেদের জন্য হয়তো মধ্যবর্তী বিরতির তুলনাটা খাটে না। কিন্তু পুরো মৌসুম বিবেচনা করলে তাঁরাও পিছিয়ে থাকবেন না, তারকাদের অনেকেই তো ম্যাচ ধরে ধরে ছন্দে ওঠেন। অর্থাৎ যত ম্যাচ, তত ভালো ফর্ম।
হলান্ড-লেভা বুন্দেসলিগায় থাকতে গোলের পর গোল করলে লোকে উপহাস করেছে, সে তো বুন্দেসলিগায়, যেখানে রক্ষণ নিয়ে মশকরা করা যায়! জার্মানি থেকে উড়াল দিয়ে দুজনের একজন এখন স্পেনে, আরেকজন ইংল্যান্ডে। পাল্টেছে দেশ, পাল্টেছে লিগ, পাল্টেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধাঁচও। কিন্তু তাঁদের নিশানার ধার এখনো পাল্টায়নি, বরং বেড়েছে, তা হলান্ডকে সামনে রেখে বলাই যায়।
আগ বাড়িয়ে বলা যায় আরও একটি কথাও। সে কথা বলার আগে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো। ইউরোপের লিগগুলোর মধ্যে ১৯ গোল নিয়ে সবার ওপরে নরওয়েজিয়ান লিগের ক্লাব বোদো/গ্লিমটের ফরোয়ার্ড আন আমাল পেল্লেগ্রিনো। কিন্তু নরওয়ের লিগ আর ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে গোলপ্রতি পয়েন্টের মান তো সময় নয়। নরওয়ের লিগে গোলপ্রতি ১.৫ পয়েন্ট, তাই পেলেগ্রিনোর মোট পয়েন্ট ২৮.৫। আর হলান্ড ১৪ গোল নিয়েও পেয়েছেন ২৮ পয়েন্ট—যেহেতু ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে (প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা, বুন্দেসলিগা, সিরি আ, ফ্রেঞ্চ লিগ আঁ) গোলপ্রতি পয়েন্ট ২। এ কারণে সুইডিশ লিগের দল বিকে হ্যাকেনের ফরোয়ার্ড আলক্সান্দার জেরেমেজেফ ২১ গোল নিয়েও তৃতীয়। ইউরোপিয়ান লিগের ‘কো–অ্যাফিশেয়ন্ট’ অনুসারে সুইডিশ লিগে গোলপ্রতি পয়েন্ট ১, তাই জেরেমেজেফ ২১ পয়েন্ট নিয়ে তিনে।
অর্থাৎ হলান্ড যে গতিতে এগোচ্ছেন, আর এই ধারা বজায় রাখতে পারলে এবং তাঁর লিগে গোলপ্রতি যে পয়েন্টসংখ্যা—সে বিচারে এই মৌসুমের সম্ভাব্য গোল্ডেন শু জয়ী কে হতে পারেন, সেটা আগ বাড়িয়ে বলে ফেলা অন্তত কিছুটা হলেও নিরাপদ।
কে আবার, হলান্ড!