দেশ কবে মুক্ত হবে, ঢাকায় বসে সেই প্রতীক্ষায় ফর্টিসের ইউক্রেনীয় ফুটবলার

ফর্টিস এফসির ইউক্রেনীয় স্ট্রাইকার ভ্যালেরি গ্রিশিনছবি : শামসুল হক

যুদ্ধ শেষে ইউক্রেন কবে মুক্ত হবে, কবে ফিরবেন পরিবারের কাছে, ঢাকায় বসে সেই প্রতীক্ষাতেই দিন গুনছেন ভ্যালেরি গ্রিশিন।

গত শনিবার ভ্যালেরির একমাত্র গোলে প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী লিমিটেডকে হারিয়ে দিয়েছে ফর্টিস এফসি। এমন একটা জয়ের নায়ক হওয়ার আনন্দ আছে, তবে ভ্যালেরির বুকের ভেতর শূন্যতাটা তো তাতে কাটার নয়। সেটাই টের পাওয়া গেল রাজধানীর বাড্ডার বেরাইদে মগারদিয়া বাজার এলাকা–সংলগ্ন ফর্টিসের অনুশীলনে গিয়ে।

প্রতিষ্ঠানটির বিশাল রিসোর্টে সবুজ গালিচা বিছানো গোটা চারেক মাঠের একটিতে মঙ্গলবার বিকেলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন ইউক্রেনের ২৯ বছর বয়সী স্ট্রাইকার। শোনান তাঁর জীবনের গল্প। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে বিদেশবিভুঁইয়ে কীভাবে তাঁর উদ্বেগাকুল সময় কেটেছে, দেন সেগুলোর বর্ণনাও।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে লিমান শহরে তাঁর বাড়ি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার চার মাস পর আক্রান্ত হয় লিমান শহর। প্রায় প্রতিদিনই বোমা পড়তে শুরু করে। ভ্যালেরির বাড়ি থেকে ৩০০–৪০০ মিটার দূরে বোমা হামলায় অনেক লোক মারা যান। ভ্যালেরির পরিবারের কেউ অবশ্য এর মধ্যে ছিলেন না।

দাদির সঙ্গে ভ্যালেরি
সৌজন্য ছবি

বাড়িতে আছেন ৭২ বছর বয়সী দাদি, মা সোভেতলানা গ্রিশিনা, ১২ বছরের ভাই, সৎবাবা ইগর। মা-বাবা দুজনের বয়সই এখন ৪৭। জন্মদাতা বাবার সঙ্গে মায়ের ছাড়াছাড়ি হয় ২০১৫ সালে। বাবা মারা যান ৫ বছর আগে। সেই শোক বুকে চেপে যুদ্ধ শুরুর আগের মাসে ভ্যালেরি কম্বোডিয়ায় প্রিমিয়ার লিগে খেলতে যান। তখন জানতেন না, সামনে কী ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে!

আরও পড়ুন

ভ্যালেরি ফিরে যান সেই দিনগুলোয়, ‘যুদ্ধ শুরুর পর খেলায় আর মন বসাতে পারছিলাম না। প্রায় রাতেই ঘুম হতো না। সকালে উঠে প্রথম কাজটাই হতো বাড়ির খোঁজ নেওয়া। অনেক সময় মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফোনেই বোমার আওয়াজ পেতাম।’ বলতে বলতে যোগ করেন, ‘আমাদের শহর আক্রান্ত হলে তুলনামূলক কিছুটা নিরাপদ শহর নিপ্রোতে চলে যেতে বলি পরিবারকে (১৭৫ কিলোমিটার দূরে)। সেখানে তারা পাঁচ মাস থেকে আমাদের শহরে ফিরে যায়।’

শহরে ফেরার পরও বোমার ভয়েই কেটেছে প্রতিটি দিন। ভ্যালেরি তাই পরিবারকে উড়িয়ে নেন কম্বোডিয়ায়। ইউক্রেনে তখন বিমানবন্দর বন্ধ। আশপাশের দেশে যেতে ট্রেন–বাসই ভরসা। ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভ্যালেরির পরিবারের সবাই ট্রেনে চেপে পোল্যান্ড যায়। সেখানে ভ্যালেরিও যান। পোল্যান্ড থেকে সবাইকে কম্বোডিয়ায় নিয়ে আসেন। তাঁর দাদি অবশ্য রয়ে যান ইউক্রেনেই। তিনি নাকি বলেছেন, মরলে নিজের ভিটাতেই মরবেন। তাঁর পাসপোর্টও নেই। ভ্যালেরির ভাষায়, ‘একটু সেকেলে মানুষ দাদি।’

ভ্যালেরির মা, বাবা ও ভাই। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হলে পরিবারকে কম্বোডিয়ায় ৬ মাস নিজের কাছে রেখেছিলেন তিনি
সৌজন্য ছবি

ভ্যালেরির কাছে তাঁর পরিবার ছয় মাস ছিল কম্বোডিয়ায়। ইউক্রেনের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে জেনে ২০২৩–এর ১ জুন তাঁরা দেশে ফেরেন। ভ্যালেরির মা-বাবা দুজনই এখন লিমান শহরে স্থানীয় রেলওয়েতে চাকরি করেন। দাদি কাজ করেন একটি স্কুলে। প্রতিদিনই তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন ভ্যালেরি।

ভ্যালেরি নিজে ফেরেননি ফুটবলের সঙ্গে থাকবেন বলেই, ‘আমি ইউক্রেনে ফিরে গেলে আর বেরোতে পারব না। আমাকে সম্ভবত সেনাবাহিনীতে যেতে হবে, যুদ্ধে যেতে হবে। ফুটবলে ফিরতে পারব কি না, সেটাও অনিশ্চিত। ফলে ঝুঁকিটা আমি নিইনি।’ এটাও অবশ্য বললেন, ‘যুদ্ধে যাওয়ার দরকার হলে আমি যাব। কারণ, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।’

আরও পড়ুন

গত বছর ২ অক্টোবর ঢাকায় আসার দিন বিমানবন্দরে ভ্যালেরিকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন ফর্টিস এফসি ফুটবল দলের ম্যানেজার ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলাম। ভ্যালেরির পাশে বসে স্মরণ করেন সেই দিনটা, ‘ওকে আমি বিমানবন্দরে যখন প্রথম দেখি, ওর পরনে আর্মি প্যান্ট। জিজ্ঞেস করলাম, এই প্যান্ট কেন? হেসে বলল, আমি ইউক্রেনীয়, আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। ওর এই কথাটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।’

ফর্টিস এফসির অনুশীলনে ভ্যালেরি
ছবি : শামসুল হক

ভ্যালেরিতে মুগ্ধ রাশেদুল। বললেন মুগ্ধতার কারণটাও, ‘অন্য অনেক বিদেশির মতো ওর কোনো বাহানা নেই, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। শান্ত, হাসিখুশি, মিশুক। কোনো বাড়তি চাওয়া নেই।’

ভ্যালেরির জীবনে এখন বড় চাওয়া দেশে ফেরা। কিন্তু জানেন না কবে ফিরতে পারবেন। মাঠ থেকে পাশেই ফর্টিসের পরিপাটি ও গোছানো খেলোয়াড় হোস্টেলে নিজের কক্ষে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘যুদ্ধের দুই বছর হতে চলেছে। এখনো ইউক্রেনের নানা প্রান্তে বোমা ফেলে রাশিয়া। আজও খোঁজ নিয়েছি, রাজধানীতে প্রচুর বোমাবর্ষণ হয়েছে।’

আরও পড়ুন

তবে যেদিনই যুদ্ধ শেষ হোক, ভ্যালেরির বিশ্বাস, যুদ্ধে জয়ী হবে তাঁর দেশই, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সমর্থন দিয়েছে। তা ছাড়া ইউক্রেনের মানুষ অনেক শক্ত মনের। কখনো হার মানে না। তবে কেউই জানে না, কবে মুক্তি আসবে। যেদিনই আসুক, এই যুদ্ধে আমরাই শেষ পর্যন্ত জিতব।’

বান্ধবীর সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় রিক্সা নিয়ে ঘুরছেন ভ্যালেরি
সৌজন্য ছবি

মুক্ত দেশে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান মিয়ানমারের বান্ধবী ইনজার মিন মিয়াতকে। তাঁরা বিয়ে করতে চলেছেন। দুজনের মিলও খুঁজে পান ভ্যালেরি, ‘আমি এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ, সেও তা–ই।’ মিয়াত এখন ঢাকায়। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। গল্পের ফাঁকেই ফোন আসে হবু স্ত্রীর। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও ফর্টিসের বর্তমান ফুটবলার মামুনুল ইসলামের সঙ্গে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ভ্যালেরি বেরিয়ে যান বসুন্ধরার দিকে।

এলাকাটা তাঁর আগে থেকেই চেনা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় পর্বে শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রে খেলতে এসে ওখানেই ছিলেন। ১১ ম্যাচে সেবার ৩ গোল করেন, ২ গোলে সহায়তা। এবার ফর্টিসের হয়ে ২টি গোল মোহামেডান ও আবাহনীর বিপক্ষে।

ইউক্রেনের ১৬ থেকে ২১ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলেছেন। দেশটির বিখ্যাত ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের একাডেমিতে ছিলেন ১০ বছর। ২০১৩ সালে প্রাক্‌–মৌসুমে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও স্পার্তাক মস্কোর সঙ্গে দুটি ম্যাচ খেলেছেন মূল দলের জার্সিতে। ইউক্রেন প্রিমিয়ার লিগে ১০ ম্যাচ খেলে ১ গোল করেছেন। কম্বোডিয়ায় প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন নমপেন ক্রাউনে খেলেছেন আড়াই বছর।

ইউক্রেনের বিখ্যাত ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের একাডেমিতে ১০ বছর ছিলেন ভ্যালেরি (ডানে)
সৌজন্য ছবি

খেলার জন্যই দেশে ফেরেননি। এখন চান যতটা সম্ভব গোল করে যেতে। যুদ্ধের মধ্যে দেশে রেখে আসা প্রিয় মানুষগুলোর জন্য সেটাই হবে তাঁর বড় উপহার।