নেইমারকে কিনে পিএসজির কতটা লাভ হয়েছে—৫ বছরের হিসাব কী বলছে
২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো। ২০১৭ সালের আগস্টের শুরুর দিকে যেটা বাংলাদেশি মুদ্রায় ছিল ২ হাজার ৮৭ কোটি ৪৫০ লাখের বেশি। বার্সেলোনা থেকে বিশাল এই ট্রান্সফার ফিতে পিএসজিতে নাম লেখান নেইমার। এর সঙ্গে যোগ করুন রাজসিক সব সুযোগ-সুবিধা। চুক্তির একটি ধারা ছিল এমন যে সমর্থকদের সঙ্গে ভালো আচরণ, ক্লাবে সবার সঙ্গে বিনয়ী থাকলে আর নিয়মকানুন ঠিকঠাকভাবে মেনে চললে বোনাস পাবেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘এথিকাল বোনাস’।
ব্রাজিলের ফুটবলের পোস্টার বয়ের পেছনে এত টাকা খরচ করে ঠিক কী পেল পিএসজি? ৩টি ফ্রেঞ্চ কাপ, ৪টি ফ্রেঞ্চ লিগ, ২টি ফ্রেঞ্চ লিগ কাপ ট্রফি। এসব শিরোপা জিততে পিএসজির নেইমারকে কেন প্রয়োজন হবে? প্রশ্নটা তো উঠতেই পারে। কারণ, নেইমার পিএসজিতে পা রাখার আগেও তো ফ্রেঞ্চ লিগ, ফ্রেঞ্চ কাপ জিতেছে পিএসজি। এসব শিরোপা নিয়মিত জেতার পরও, দলবদলে ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়ে নেইমারকে যে কারণে পিএসজি কিনেছিল, সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা তো এখনো প্যারিসের ক্লাবটির কাছে অধরাই থেকে গেল! তবে কি ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘আরএমসি’র সংবাদকর্মী দানিয়েল রিওলোওর কথাটাই ঠিক?
‘আরএমসি’র এই সংবাদকর্মী দানিয়েল রিওলোও নেইমারের তুমুল সমালোচনা করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা কি বুঝতে পারছি, বেতন ও দলবদল খরচ বিবেচনায় নেইমার ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা? এর চেয়ে বড় ব্যর্থতার নজির আমার মাথায় নেই।’
নেইমার কি পিএসজির হয়ে আসলেই ব্যর্থ? হয়তো, কারণ নেইমারকে যে কারণে কিনেছিল ফরাসি এই ক্লাবটি, তা পূরণ করতে পারেননি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। তবে এর দায়টা যতটা নেইমারের, ততটাই তাঁর দুর্ভাগ্যেরও। কারণ, পিএসজির লক্ষ্যপূরণ কিংবা মাঠের ফুটবলে নেইমারের সেরাটা দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নেইমারের চোট।
পিএসজির জার্সিতে সেই শুরু থেকে নেইমারের গল্পটা ঠিক একই রকম। মাঠে নান্দনিক ফুটবল খেলা, এরপর ছন্দে থাকা অবস্থায় চোটে ছিটকে যাওয়া। এর সঙ্গে আছে নানা রকমের বিতর্কে জড়ানোর বিষয়।
২০১৭ সালে পিএসজির হয়ে অভিষেকের কথাটাই ভাবুন না। পিএসজির জার্সিতে খেলা প্রথম দুই ম্যাচেই এই ফুটবলার করছিলেন ৩ গোল, করিয়েছিলেন ১টি। তৃতীয় ম্যাচটায় সেঁত এতিয়েনের বিপক্ষে গোল পেলেন না, তবে চোখধাঁধানো ড্রিবলিং, ডিফেন্ডারদের বোকা বানানো, নেইমারসুলভ পারফরম্যান্সটাই করেছিলেন। চ্যাম্পিয়নস লিগেও প্রথম দুই ম্যাচেই করেছিলেন দুটি গোল।
দারুণ খেলতে থাকা নেইমার চোটে পড়েন ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। সেই চোটে খেলতে পারেননি শেষ ষোলোতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ। তাঁকে ছাড়া পিএসজি হারে ২-১ ব্যবধানে। শেষ ষোলোর প্রথম লেগে খেললেও অবশ্য গোল পাননি নেইমার। শুধু রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচ নয়, ডান পায়ে পাওয়া সেই চোটে পুরো মৌসুমেই আর খেলতেই পারেননি নেইমার। সেই মৌসুমে মাত্র ২৮ ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ৩০টি। যার মধ্যে লিগে ১৯ ম্যাচে ২০ গোল, আর চ্যাম্পিয়নস লিগে ৬টি।
পরের মৌসুমেও নেইমারের শুরুটা হয় দুর্দান্ত। কিন্তু আবারও সর্বনাশা চোটের হানা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পাওয়া সেই চোটে ৮৫ দিন মাঠের বাইরে থাকেন নেইমার। মিস করেন চ্যাম্পিয়ন লিগের শেষ ষোলোয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই লেগের ম্যাচই। নেইমারবিহীন পিএসজি ইউনাইটেডের বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম লেগ ২–০ গোলে জিতে এলেও ঘরের মাঠে আর পারেনি। দ্বিতীয় লেগে দলকে সমর্থন দিতে পার্ক দে প্রিন্সেসের ভিআইপি গ্যালারিতে ছিলেন নেইমার।
বিতর্কিত পেনাল্টিতে পিএসজি ম্যাচ হারার পর ইনস্টাগ্রামে উয়েফার সমালোচনা করেছিলেন নেইমার। এর জন্য ব্রাজিল তারকাকে চ্যাম্পিয়নস লিগে তিন ম্যাচের জন্য নিষেধাজ্ঞাও পেতে হয়। চোট সেরে নেইমার মাঠে ফেরেন ফ্রেঞ্চ লিগ কাপের ফাইনাল দিয়ে। তবে ফাইনালে টাইব্রেকারে রেঁনের কাছে হারে পিএসজি। সেই ফাইনালে আবারও বিতর্কে জড়ান নেইমার। ম্যাচ শেষে করেন দর্শকদের সঙ্গে হাতাহাতি।
২০১৯-২০ মৌসুমের শুরুটা অবশ্য আগের মতো নয়। এবার তিনি শুরুই করেন বিতর্কে জড়িয়ে। ছুটি কাটিয়ে নির্ধারিত সময়ে পিএসজির অনুশীলনে ফেরেননি এই ব্রাজিলিয়ান। তাতে শাস্তি হিসেবে ‘এথিক্যাল বোনাস’ কেটে রাখে ক্লাব। দেরিতে যোগ দেওয়ার কারণও ছিল তাঁর। এই মৌসুমেই আবারও পুরোনো ক্লাব বার্সেলোনায় ফেরার ‘দেনদরবার’ করেছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত ফিরতে পারেননি। ২০১৮ বিশ্বকাপ জেতার পর থেকেই ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমবাপ্পে তারার উত্থান। নেইমার হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন কাভানির সঙ্গে ‘অহং’–এর লড়াইয়ে তিনি জিতে গেলেও এমবাপ্পের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হবে! অনেকেই নেইমারের পিএসজি ছাড়তে চাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি বলে মনে করেন। এসবের সঙ্গে তাঁর ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে যাওয়া চোট তো ছিলই!
বিতর্ক দিয়ে শুরু হলেও এই মৌসুমটা দলীয় সাফল্য বিবেচনায় নেইমারের পিএসজির জার্সিতে সেরা মৌসুম। দুর্দান্ত পারফর্ম করে ঘরোয়া ৩টি শিরোপাই জেতে পিএসজি। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন লিগের ফাইনালেও খেলেন নেইমাররা। সব জায়গাতেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন নেইমার। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে আতালান্তার বিপক্ষে যোগ করা সময়ে গোলে সহায়তা করেন। গোলে সহায়তা করেন সেমিফাইনালে লাইপজিগের বিপক্ষেও। তবে দুর্ভাগা নেইমারের, পিএসজির চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকেই যায়। সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে আজ হয়তো নেইমারকে নিয়ে এই আলোচনাটাই উঠত না! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেবারের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতে নেইমার ছিলেন অনেকটাই ম্লান।
এরপরের মৌসুমেও ভাগ্যটা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি নেইমারের। এই মৌসুমেই পিএসজির হয়ে দ্রুততম ৫০ গোল করার রেকর্ড গড়েন। তবে হাতছাড়া হয় লিগ শিরোপা। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে হেরে বসে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে। সেমিফাইনালের দুই লিগেই নেইমার মাঠে ছিলেন। বলার মতো তেমন কিছুই করতে পারেননি। পিএসজি কর্তৃপক্ষ অবশ্য নেইমারের পারফরম্যান্সে খুশিই ছিল। এই মৌসুমেই যে নেইমারের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে পিএসজি।
২০১৭ সালে নেইমার কেন বার্সেলোনা ছেড়েছিলেন? অনেকে বলেন, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের হাতছানি এড়াতে পারেননি। কারও কথা আবার এ রকম—নেইমার চেয়েছিলেন লিওনেল মেসির ছায়া থেকে বের হতে! সেই মেসিকেই ২০২১ সালে দলে ভেড়ায় নেইমারের পিএসজি। শোনা যায়, এই দলবদলে বড় ‘এজেন্ট’ হয়ে কাজ করেছেন নেইমারই। মেসি পিএসজিতে নাম লেখানোর পর প্রথম মৌসুম দুজনের কারোরই ভালো কাটেনি। চোটের কারণে মৌসুমজুড়েই অনিয়মিত ছিলেন নেইমার। তবে দুজনের রসায়ন জমে উঠেছে চলতি মৌসুমে। যার ফল ভোগ করছেন নেইমার।
এ মৌসুমে পিএসজির হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৩ ম্যাচে ১৫ গোল করেছেন। সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ১৩ গোল। তবে কাতার বিশ্বকাপের পর এখনো নিজের সেরা ছন্দে ফিরতে পারেননি। এ ছাড়া গত ২৮ ডিসেম্বর স্ত্রাসবুর্গের বিপক্ষে লাল কার্ড দেখায় পরের দুই ম্যাচে খেলতে পারেননি।
সব মিলিয়ে একটা আলোচনা নেইমারের পিছুই ছাড়ছে না—এত দামে ব্রাজিলিয়ান তারকাকে দলে ভিড়িয়ে পিএসজির কতটা লাভ হলো? পিএসজি চ্যাম্পিয়নস লিগ না জেতা পর্যন্ত হয়তো এটা চলতেই থাকবে।