ট্রাম্পের জয় ২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপে কী প্রভাব ফেলবে

২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁর হাতে বিশেষ জার্সি তুলে দেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোএএফপি

ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে যেসব বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিজের মতো করে চলা এবং অভিবাসীদের তাড়িয়ে বিদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা। ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অপেক্ষায়। তাঁর চার বছর মেয়াদের মধ্যেই ২০২৬ সালের জুন–জুলাইয়ে কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে যৌথভাবে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র।

ফিফা বিশ্বকাপের অন্যতম মূলমন্ত্র ‘বিশ্বকে একসুতায় গাঁথা’। তার ওপর ২০২৬ সালেই প্রথমবারের মতো ৪৮টি দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেবে, যা আগের যেকোনো আসরের চেয়ে অংশগ্রহণকারী ও ম্যাচের সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে বড়। স্পষ্টতই ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রকে একা চালানো আর বিদেশিমুক্ত নীতির সঙ্গে ফিফা বিশ্বকাপের ‘একতাবদ্ধ’ ও রেকর্ডসংখ্যক দেশের অংশগ্রহণ পুরোপুরি বিপরীতমুখী।

এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে, মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় বোধ হয় ২০২৬ বিশ্বকাপের জন্য ‘আপদ’ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তা–ই?

আর যদি ইতিবাচক কিছু হয়েও থাকে, সেটাও–বা কীভাবে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে সম্ভাব্য ওলট–পালট ঘিরে আলোচনা–বিশ্লেষণ চলছে বিস্তর। সারা বিশ্বের কয়েক কোটি সাধারণ মানুষ প্রতি চার বছর পর যে উপলক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকে, তেমন একটি বৃহৎ আয়োজনে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভূমিকাও তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আর গুরুত্বপূর্ণ বলেই হয়তো নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাতে একটুও দেরি করেননি ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। সেই বার্তা শুধু ‘কংগ্র্যাচুলেশনস মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ বাক্যেই আটকে থাকেনি, বিস্তৃত হয়েছে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকায় আমরা একটি দুর্দান্ত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ এবং দুর্দান্ত ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ পেতে যাচ্ছি’ পর্যন্ত। বলে রাখা ভালো, জাতীয় দলগুলোকে নিয়ে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে বিশ্বের ৬ মহাদেশের ৩২টি ক্লাব নিয়ে ২০২৫ ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপও আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বকাপে ট্রাম্পের কী ভূমিকা

একটি বিশ্বকাপ আসর আয়োজন মানে মহাযজ্ঞ। একটার পর একটা পরিকল্পনা, একটার পর একটা স্তর। বিশ্বকাপের মূল আয়োজক ফিফা। লাভের ভাগও বেশি তাদেরই। তবে আয়োজকদেরও থাকে বিশেষ ভূমিকা। বিশেষত স্থানীয় ব্যয় ও লজিস্টিক্যাল খাতে আয়োজক দেশকেই ভূমিকা রাখতে হয়। এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজক কমিটিও করা হয়।

আরও পড়ুন

যেমন ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন সরকার ও রাশিয়ান ফুটবল ইউনিয়ন যৌথভাবে একটি ‘কেন্দ্রীয় আয়োজক কমিটি’ গঠন করেছিল। ২০২২ আসরে কাতার বানিয়েছিল ‘সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসি’। ২০২৬ বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় যৌথভাবে হবে বলে এবার তেমনই স্থানীয় আয়োজক কমিটি আরও শক্তিশালীরূপে দরকার। ফাইনালসহ বেশির ভাগ ম্যাচ যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে, দেশটির স্থানীয়, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অর্থায়ন ও পরিচালন সহায়তার জন্য কমিটি গঠনের উদ্যোগও দরকার দ্রুতই। আর এখানেই আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ভূমিকা।

বিশ্বকাপ আয়োজন দীর্ঘ সময়ের কর্মকাণ্ড বলে আয়োজক দেশের সরকারের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ বজায় রাখে ফিফা। ২০২৬ বিশ্বকাপ কেন্দ্র করে যেমন জো বাইডেন প্রশাসন ও কংগ্রেসের সঙ্গে এরই মধ্যে কাজ শুরুও হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের নিরাপত্তা বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা চেয়েছে ফিফা। এমনকি এর জন্য বাইডেন প্রশাসনের আন্তসরকার–বিষয়ক কার্যালয়ে কাজ করা অ্যালেক্স সোপকোকে ফিফা হেড অব গভমেন্ট রিলেশন্স পদে নিয়োগও দিয়েছে।

তবে আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপনে এবার হয়তো নতুন কারও কথা ভাবতে হবে ফিফাকে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনে নতুন ব্যক্তিরা আসবেন বলে কাজের ধারায় যে সম্ভাব্য ছেদ ঘটবে বা ধীরগতির হবে, সেটি মাথায় রেখে এখনই উদ্যোগী হতে হবে ইনফান্তিনোর নেতৃত্বাধীন ফিফাকে। বিষয়টি পরিষ্কার করেছে এর সঙ্গে যুক্ত মার্কিন প্রশাসনের একটি সূত্রও। নাম প্রকাশ না করা ওই ব্যক্তি ইয়াহু স্পোর্টসকে মেইলে পাঠানো জবাবে বর্তমান প্রশাসন বিশ্বকাপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল জানিয়ে বলেন, ‘আমার ধারণা, ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুতে বিশ্বকাপের দিকে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হবে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে শুরুতেই পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

আরও পড়ুন

তবে এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন স্বয়ং ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সে বছর ২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন ফিফার প্রধান। পরে দুজনের সাক্ষাৎ হয় ২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামেও। ওই সময় ইনফান্তিনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশংসা করলে জবাবে ইনফান্তিনোকে ‘গ্রেট ফ্রেন্ড’ বলে অভিহিত করেন ট্রাম্প।

২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত একাধিকবার দেখা হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প–জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর
এএফপি

এ বছরের মে মাসে আবার দুজনের দেখা হয় মায়ামিতে, ফর্মুলা ওয়ান রেস দেখতে গিয়ে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ট্রাম্পের সঙ্গে দুই সাক্ষাতের মধ্যবর্তী সময়ে ইনফান্তিনোর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে জো বাইডেনের কোনো বৈঠক হয়নি। যদিও এ সময়েই আয়োজক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বিশ্বকাপের কাজ শুরু করেছে।
ইয়াহু স্পোর্টস লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রণালয় না থাকা এবং এরপরও বিশ্বকাপ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে বিলম্ব করায় ফিফা হতাশ ছিল। মার্কিন আমলাতন্ত্রের কারণেই বিষয়গুলো ত্বরান্বিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। কেউ কেউ ফিফার এই হতাশা নিয়ে মজা করে বলেন, ‘ফিফা ভুলে গেছে, গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করে।’

তবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইলে বিশ্বকাপের কাজ গতি পাবে বলে বিশ্বাস জেটর গ্লোবাল স্পোর্টস‍+এন্টারটেইনমেন্টের প্রধান নির্বাহী ট্রাভিস মারফির। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বকাপের জন্য অনেকগুলো দপ্তরের কাজের সমন্বিত কাজে ট্রাম্প যদি বিশেষভাবে নজর দেন, বিশ্বকাপের কাজ গতি পাবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে ইনফান্তিনোর অবস্থান। ইতালিয়ান বংশোদ্ভুত এই সুইস এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডায় থাকেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আছে তাঁর, ট্রাম্পের বর্তমান আবাস ফ্লোরিডার পাম বিচ এলাকায়।

আরও পড়ুন

দুশ্চিন্তাও কম নয়

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জামানায় বিশ্বকাপ কতটা ‘বৈশ্বিক’ হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তা নিয়ে শঙ্কাও আছে। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অনেকবারই বলেছেন, অভিবাসীদের তাড়াবেন তিনি। এমন ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করবেন, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় এবং কঠোর হবে’ বলেও হুমকি দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথম মেয়াদে (২০১৬–২০) কয়েকটি মুসলিম–অধ্যুষিত দেশের ওপর যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটার আওতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা ট্রাম্পের।

এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার অর্থ হবে বিশ্বকাপ দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হবেন অনেক দেশের নাগরিকেরা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে কনস্যুলার অফিস বিওয়ান/বিটু ভ্রমণ ভিসায় প্রায় ২৪ শতাংশ আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। ট্রাম্পের সময়ে এটি বাড়ার শঙ্কা তো আছেই, সঙ্গে ভিসা সাক্ষাৎকার পেতে সময়ও বেশি লাগতে পারে।

ট্রাম্প মনোযোগ দিলে কাজে গতি আসবে বলে আশার কথা শোনানো মারফি এ বিষয়ে বলেছেন ভিন্ন কথা, ‘এই দিকটা সহজ হবে না। নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের ভিসা আবেদন নিয়ে কাজ করতে হয়, যাঁদের কেউ ব্যবসায়িক কারণে, কেউ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য, কেউ দীর্ঘদিন ধরে থাকার জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যেই বিশ্বকাপের খেলা দেখতে আসা লোকের আবেদন নিয়ে কাজ সহজ কিছু হবে না। আমার মনে হয়, মানুষের (সাক্ষাৎকারের জন্য) অপেক্ষার সময় বাড়বে, অভিবাসন বাধ্যবাধকতা আরও কঠোর হবে। আর এটা বিশ্বকাপ দর্শকদের জন্য একটা মাথাব্যথার ব্যপার হয়ে দাঁড়াবে।’

তবে কারও কারও বিশ্বাস, ট্রাম্প বিশ্বকাপকে বিশ্বের একটি মিলনমেলা হিসেবে ইতিবাচকভাবে নিলে ভালো কিছুই হতে পারে। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চেয়ে ফিফা প্রেসিডেন্টকে তিনটি চিঠি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, তৃতীয় চিঠিতে ‘উন্মুক্ত ও উৎসবমুখর’ বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ‘সব খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এবং বিশ্বের সব দেশের ভক্ত–সমর্থক কোনো বৈষম্য ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্প তাঁর অবস্থানে কতটা অটল থাকেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চরমতম শত্রু ইরান যখন ৪৮ দলের বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে খেলবে বলে ধরেই নেওয়া যায়।

আরও পড়ুন