গোলরক্ষকেরা সময় নষ্টের রাজা, আর মার্তিনেজ সেই গোলরক্ষকদের রাজা
গত কয়েক মাসে ফুটবলে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত নাম এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। কাতারে বিশ্বকাপের ফাইনালে এক মহা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন এই গোলরক্ষক। অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে গোল বাঁচানো, পেনাল্টিতে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের উত্ত্যক্ত করে তাঁদের মনোযোগ নষ্ট করা এবং দৃষ্টিকটু উদ্যাপন—সব মিলিয়ে ফাইনালকে অন্য রকম মাত্রা দিয়েছিলেন মার্তিনেজ।
মার্তিনেজ অবশ্য সেই ফাইনালের পর পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছেন তা নয়, এই তো কদিন আগে আর্সেনালের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের যোগ করা সময়ে হাস্যকর এক ভুলে নিজেদের জালেই বল জড়ান এই গোলরক্ষক। তবে আত্মঘাতী এই গোলের জন্য নিজেকেই শুধু দায়ী করতে পারেন মার্তিনেজ।
তাঁর সময় নষ্ট করার কারণেই মূলত বাড়তি সময়টুকু যোগ করা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছিল অ্যাস্টন ভিলার। ফুটবল মাঠে সময় নষ্ট করার ধারা বহু পুরোনো। অনেক সময় কৌশলগতভাবেও সময় নষ্ট করে থাকে খেলোয়াড়েরা। তবে এটি যে অনেক সময় নিজেদের বিপদের কারণ হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত মার্তিনেজ নিজেই।
সময় নষ্ট করাকে অনেকে ‘ডার্ক আর্ট’ হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকে। আর মাঠে সময় নষ্ট করার প্রসঙ্গ এলে সবার আগে মনে পড়ে গোলরক্ষকের কথা। বল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে, কিংবা বলকে কর্নার ফ্লাগের দিকে নিয়ে গিয়ে মাঠের অন্য খেলোয়াড়েরাও এটা করতে পারেন। তবে একক খেলোয়াড় হিসেবে গোলরক্ষকদের মতো করে সম্ভবত আর কেউই সময় নষ্ট করতে পারেন না। তাই যাঁরা সময় নষ্ট করে কার্ড দেখে থাকেন, তাঁদের র্যাঙ্কিংয়ে যে গোলরক্ষকদের নাম সবার ওপরে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
এমনকি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গত ১০ মৌসুমে (২০২২-২৩ মৌসুমসহ) তিনজন খেলোয়াড় এই অপরাধে আটবার কার্ড দেখেছেন, আর তাঁরা সবাই গোলরক্ষক। বেন ফস্টার একজন এবং অন্যজন হচ্ছেন জর্ডান পিকফোর্ড। আর তৃতীয়জন? ওপরে যাঁর কথা বলা হলো—সেই মার্তিনেজ। শীর্ষ স্তরের ফুটবলে এটি তাঁর তৃতীয় পূর্ণ মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেখেছেন অষ্টম হলুদ কার্ড।
এই তালিকার চতুর্থ স্থানটি এক ডিফেন্ডারের দখলে থাকলেও (রায়ান বার্ট্রান্ড) পরের পাঁচটি স্থান আবার গোলরক্ষকদের। সেই নামগুলো হলো—ভিসেন্তে গুয়াতিয়া, নিক পোপ, এদেরসন, অ্যালেক্স ম্যাকার্থি ও আর্থুর ব্রুস।
গত মৌসুমে প্রফেশনাল গেম ম্যাচ অফিশিয়াল লিমিটেড (পিজিএমওএল) রেফারিদের ম্যাচ আবার চালু করার ক্ষেত্রে তৎপর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। এর কারণ ছিল সময়কে পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা এবং খেলার প্রবাহকে চলমান রাখা। এখন পর্যন্ত এ মৌসুমে সময় নষ্ট করার জন্য দেখানো হয়েছে ৪৩টি হলুদ কার্ড। গত মৌসুমে যে সংখ্যা ছিল ৭০।
সময় নষ্ট করাকে গোলরক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। এমনকি এর জন্য কিছু কৌশলও রয়েছে। সাবেক মার্কিন গোলরক্ষক ম্যাট পাইরোস্কি দ্য অ্যাথেলিককে যেমনটা বলছিলেন, ‘খেলার শেষ দিকে আমি প্রায় বলটিকে বক্সের কোনায় নিয়ে যেতাম। আর সেটি ধরার ভান করতাম। কাজটি আমি বারবার করতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড প্রেস করতে না আসছে, ততক্ষণ করতাম।’
সময় নষ্ট করার কৌশল নিয়ে বলতে গিয়ে পাইরোস্কি আরও বলেছেন, ‘গোল কিকের সময় খুব সতর্কভাবে আমি বলের দিকে হেঁটে যেতাম। সেটাকে ছয় গজি বক্সে ছুড়ে ফেলতাম। এরপর বোতল নিয়ে কয়েক চুমুক পানি পান করতাম। যখন বাচ্চারা বল আমার দিকে ছুড়ে দিত, আমি সেটিকে হাতের ভেতর দিয়ে যেতে দিতাম। আমি এমন ভান করতাম যে তাদের আমি দেখিইনি। আবার শেষ দিকে অনেক সময় আমি বলটিকে ধরতাম এবং তারপর মাটিতে শুয়ে যেতাম। সেখানে কয়েক সেকেন্ড নষ্ট করতাম।’
অনেক সময় দেখা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে গোল কিক নিয়ে বলটিকে প্রতিপক্ষ ডি-বক্সে পাঠানো হয়। তবে সবচেয়ে স্বাভাবিক উপায়টি হচ্ছে, যতক্ষণ সম্ভব বলটিকে হাতে ধরে রাখা। এ ছাড়া অবশ্য আরও কিছু কৌশলও আছে।
তবে এ সময় নষ্টের আলাদা করে পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ করেছিলেন সৌদি ক্লাব আল-ওয়েহদার গোলরক্ষক আবদুলকুদ্দুস আতিয়াহ। হাজের এফসির বিপক্ষে ম্যাচে সময় নষ্টে সব সীমায় যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এই গোলরক্ষক। প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকার কাছে আসা পর্যন্ত বলকে দুই হাতে আঁকড়ে মাটিতে বসেছিলেন আতিয়াহ। পরে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় যখন হাল ছেড়ে দেন, তখন দৌড়ে তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো চোটের ভান করা। চোটে পড়লে তো আর খেলা চালিয়ে যাওয়া যায় না, নাকি?
প্রশ্ন হচ্ছে, সময় নষ্ট করার এই কৌশল আসলেই ‘ডার্ক আর্ট’ কি না? এটা কি আমাদের নৈতিক সংবেদনশীলতাকে আঘাত করে? বেশির ভাগ গোলরক্ষক মার্তিনেজের মতো সবকিছু জেনেবুঝেই করেন এবং এই কৌশল কাজও করে। তবে অনেক সময় এই কৌশলের শিকার নিজেদেরও হতে হয়।